বাইশে শ্রাবণ এলেই মেঘের পরে মেঘ সেজে ওঠে শ্রদ্ধায় | সংকলন অসীম দাস

“মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে॥
তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি,
পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে॥”

২২শে শ্রাবণ, মহামানবের মহা নির্বাণের দিন।
বাঙালির জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনের পড়েই যাঁর সঙ্গে আমাদের প্রথম মাতৃ জঠর থেকে মায়ের হাত ধরে আলাপ হয় তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে ঠাকুরের কোনো ধর্ম নেই, জাতের কোনো বর্ম নেই, মন্ত্র মানে গান আর গ্রন্থ মানে গীতবিতান। তিনি সত্য এবং শ্বাশত। সর্ব কালীন, সদা জাগ্রত। মানবের দুঃসময়ের অবলম্বন, অসহায়ের সহায়। ভালোবাসার এক বটবৃক্ষ। কাউকে নিরাশ করেননি। উপহাসের পাত্র করেছেন যিনি তিনিই চরম দারিদ্র্যে তাঁর হাত ধরে উতরে গেছেন বিপদ তরী। বাইশে শ্রাবণ এলেই মেঘের পরে মেঘ সেজে ওঠে শ্রদ্ধায়। আমরা পদতলে রাখি মস্তক।

এখন ভীষণ এক অদ্ভুত সময়। সময়ের গহ্বরে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন সঙ্কট। এসব সঙ্কটের নাম অভিমান হতে পারে। এই অভিমানের তীব্র আর্তনাদ ঘর থেকে শুনতে পাই। বিষাক্ত সে-সব আর্তনাদের রূপ দাগ কাটে মনের অলিন্দে । মনের আনন্দে এই দাগগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখি। কখনও নির্জন অন্ধকার ছেয়ে এলে কখনও হলুদ হয়ে আসা সঙ্কট মুহূর্তে দেখি। বড় অসহায় মনে হয় কবি।

কিছুদিন আগে ডা: বিধান চন্দ্র রায় ও নীলরতন সরকার এর মানা সত্বেও পুত্র রথীন্দ্রনাথের অজান্তেই কবি কালিম্পং মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি চলে যান। সেখানে কবির প্রচন্ড শরীর খারাপ হয়। এখান থেকে মহালনবীশ ডাক্তার নিয়ে গিয়ে কবিকে নিয়ে কলকাতায় ফেরেন। দেড়মাস কলকাতায় থেকে চিকিৎসা করে নিজের শান্তিনিকেতন ফেরেন। কিন্তু শরীর একদম ঠিক হচ্ছে না। ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী খুবই সাবধানে থাকছেন। খুব জরুরি না হলে কারুর সঙ্গে দেখা বা কথা বলা বারণ।
গুরুদেবের অসুস্থতা খবর শুনে সবার মন খারাপ। সবাই ছুটে আসতে চান কবির কাছে। রোজ ভিড় করে শান্তিনিকেতনে আসছেন মানুষ। একটি বার দেখার আশায়। ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি দেওয়া সত্ত্বেও মানুষ প্রতিদিন উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন একটিবার কবিকে যদি দেখতে পান। কবির শরীরের কথা ভেবে কাউকেই অনুমতি দেওয়া হয় না। তাঁরা আশ্রম প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ান উদ্দেশ্যহীন। কেউ বসে অপেক্ষা করেন, কেউ ব্যর্থ মনে ফিরে যান।
ময়মনসিংহ থেকে একটি অল্পবয়সি তরুণ তিন-চার দিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কবিকে দেখবে বলে। অনুমতি পাচ্ছে না, ফিরেও যাচ্ছে না বাড়ি। রানী মহালানবিশকে সামনে পেয়ে ছেলেটি কেঁদে পড়ল,
“একটিবার গুরুদেবকে চোখের দেখাও দেখতে পাব না! তিন দিন ধরে বসে আছি।”
রানী সেই কাতরতায় বিচলিত হলেন। কিন্তু কবির কাছে কাউকে নিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে সম্ভবও নয়। তিনি ছেলেটিকে বুঝিয়ে বললেন,
“কবির ক্লান্ত, দূর্বল শরীর। কাউকেই তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ওঁর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।”
ছেলেটি কেঁদে পড়ল,
“একবার বাইরে থেকে দেখেই চলে আসব।”
রানী অসহায় ভাবে তাকে ‘না’ বলে চলে এলেন। কিন্তু ছেলেটির মুখ তিনি ভুলতে পারছিলেন না। কবির ঘরে গিয়ে তিনি দেখলেন সুধাকান্তবাবু আছেন। সুধাকান্তবাবুকে কাছে ডেকে ফিসফিসিয়ে ছেলেটির কথা বললেন। শুনেই সুধাকান্ত লাফ দিয়ে উঠলেন,
“অসম্ভব। একজনকে অনুমতি দিলেই সর্বনাশ। কাউকেই আর ঠেকানো যাবে না।”
রানী অগত্যা বললেন,
“আপনি একটু ছেলেটিকে মিষ্টি কথা বলে বিদায় দিয়ে আসুন।”
সুধাকান্তবাবু চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ ওদের কথাবার্তা লক্ষ্য করলেন। রানী কবির শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই রবীন্দ্রনাথ রানী ও সুধাকান্তের গোপন পরামর্শের খবর জিজ্ঞেস করলেন।
কবির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রানী ছেলেটির কথা জানালেন রবীন্দ্রনাথকে। সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,
“আহা, ছেলেটিকে একবার আসতে দাও না। আমি চুপ করে থাকব। কথা না বললে তো আর ক্লান্ত হ’ব না। একবারটি দেখা দিলেই কি ক্ষয়ে যাব? আমার ভাল লাগে না সবাইকে তোমরা এই ভাবে ঠেকাও বলে।”
কথা শেষ হতে না হতে সুধাকান্তবাবু ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনিও এড়াতে পারেননি সেই যুবককে। অবাক চোখে তরুণটি অসুস্থ, বৃদ্ধ, বিশ্বজয়ী কবিকে দেখছেন। চোখের পলক পড়ছে না যেন। অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দৃশ্য। কত ভালবাসে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে। যেন তিনি বাঙালির দেবতা। বুড়ি (নন্দিতা দেবী) গিয়ে ছেলেটিকে বলল ঘরে এসে গুরুদেবকে প্রণাম করে যেতে। জীবন যেন ধন্য হয়ে গেল ছেলেটির। প্রণাম করার সময় ভক্ত ছেলেটি কোনও কথা বলল না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল।

২২ শে শ্রাবণ প্রিয় শ্রদ্ধার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হারাবার দিন। যে ঠাকুরের কোনো ধর্ম নেই, জাতের কোনো বর্ম নেই, মন্ত্র মানে গান আর গ্রন্থ মানে গীতবিতান। জানিনা কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে, সেতো আজকে নয়। বিশাল সাহিত্যের ভান্ডার আমাদের দিয়ে গেছেন, আগামীর প্রজন্ম যেন তেমনি করে তোমাকে পায়, বিধাতার কাছে এই প্রার্থনা করি।
আর আমি যে কিছু চাহিনে, শুধু তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি তোমার গানের সুরে।

3 thoughts on “বাইশে শ্রাবণ এলেই মেঘের পরে মেঘ সেজে ওঠে শ্রদ্ধায় | সংকলন অসীম দাস

Comments are closed.