মেটালিক স্বপ্ন আমাকে ছোঁয় না: স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত

নাট্যমুখ নাট্যপত্রে মে ২০০৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা থিয়েটারের বিশিষ্ট অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর একটি সাক্ষাৎকার— ‘যা আজও বলা হয়নি’ বিভাগে ছাপা হয়েছিল। তাঁকে স্মরণ রেখে পুনর্মুদ্রণ করা হল।

২২ মে, ১৯৫০ সালে এলাহাবাদে জন্ম, পিতা রামদাস হালদার। কলকাতার অফিস ক্লাবে অভিনয়, প্রথম নাটক ‘কলকাতার ইলেক্ট্রা’, তাও পেছনের ক্রাউডে। তারপর ‘খড়ির গণ্ডি’-তে। এভাবেই শুরু হয় নাট্যজীবন। বর্তমানে ‘ফুটবল’ নাটকে তিনি হরির মাসি চরিত্রে একভাবে অভিনয় করে চলেছেন। ‘শানু রায়চৌধুরী’-তে তিনি একক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে জাতশিল্পীর পরিচয় দেন। একাধারে অসাধারণ বেহালা, পিয়ানো বাজান। এবং তিনি একজন দক্ষ সংগঠক। বাংলা থিয়েটারের এই অসামান্যা অভিনেত্রী শ্রদ্ধেয়া স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে নিয়ে ‘যা আজও বলা হয়নি’ পর্বে কথা বলেছেন— অভি চক্রবর্তী ও অসীম দাস।

স্বাতীদি, আপনি তো ভাল বেহালা বাজান, পিয়ানো বাজান— গানটাও ভালই করেন— তা এসব থেকে হঠাৎ থিয়েটারে কেন?

আসলে তিন বছর বয়স থেকেই আমি বাজনাটা শিখি। বিশেষ করে চেম্বার মিউজিক মানে western classical music-এর প্রতি আমার ভীষণ ন্যাক্ ছিল। এক জার্মান শিক্ষকের কাছে পিয়ানো আর নিত্যানন্দ ঘোষের কাছে বেহালা শিখেছি। এভাবেই এগিয়েছি পায়ে পায়ে আর বাড়িতে একটা নাটকের পরিবেশও ছিল। সেখান থেকেই শুরু।

তাহলে নান্দীকার কীভাবে…

১৯৭৮-এ কলকাতার অফিস ক্লাবে ‘কলকাতার ইলেক্ট্রা’ নাটকে অভিনয় করি। সেখান থেকে বিভাস চক্রবর্তী রুদ্রবাবুকে আমার কথা বলেন। তখন নান্দীকার ‘খড়ির গণ্ডি’ নাটকে মহিলা চরিত্রের সন্ধানে ছিল।

তাহলে প্রথমে নান্দীকারের হয়ে কাজ ‘খড়ির গণ্ডি’-তেই?

না। প্রথমে ‘ফুটবল’ নাটকে পিছনে ক্রাউডে ছিলাম, তারপর ‘খড়ির গণ্ডি’।

একজন যথেষ্ট দক্ষ অভিনেত্রী হয়েও চলচ্চিত্র বা টেলিমিডিয়াতে আপনাকে দর্শক সেভাবে পেল না কেন?

কেন আবার? ওখানে দাদা ধরার ব্যাপার আছে। আর আমার সেই সময় বা মেন্টালিটি নেই, তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ বা কয়েকটি ইংরেজি ছবি যেমন ‘City of joy’-তে অভিনয় করেছি।

রুদ্রবাবুর স্ত্রী হয়ে কবে থেকে একসাথে? আর এই পথচলার সাথে নান্দীকার কীভাবে মিশে যাওয়া?

১৯৮০। আর এই পথচলাতে আমাদের কাছে নান্দীকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবে নান্দীকারকে কাজে লাগিয়ে আমরা কোনও ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা তৈরি করিনি। কখনও কোনও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের মূল্য থাকে না। বরং সবাই একসাথে বসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

উৎপলবাবুর মৃত্যুর পর P. L. T.-এর অবস্থান মৃতপ্রায়, বহুরূপী শম্ভু মিত্রের মৃত্যুর পর রূপ হারিয়েছে। কিন্তু নান্দীকার একটা ধারাবাহিক সাংগঠনিক পর্যায়ক্রম অতিক্রম করে আসছে, মানে, অজিতেশ থেকে গৌতম হালদার…

আসলে রুদ্রবাবু কখনও মৃত্যুর কথা বলেন না। সবসময় নিজে এবং দলকে নিয়ে প্রচণ্ড সজীব থাকার চেষ্টা করেন। নতুন কাজ, নতুন ভাবনায় রোজই আমাদের তিনি ভাবিয়ে তোলেন। আমরা রোজই বসি। সবার কথা বলতে পারব না, তবে প্রায় গ্রুপ থিয়েটার দলগুলোই নির্দিষ্ট দিন ও সময় বেছে মহড়া দেয়। এই যে আজ তিনি দিল্লি গেছেন, তা সম্পূর্ণ দলের জন্য দলের কথা ভেবেই। নিজের কথা একদমই ভাবেন না— কারও সাথে সম্পর্ক শেষ এ কথা কোনওদিন কাউকে বলেননি। এই জন্যই নান্দীকার আজও ভরা যৌবন বা সামনে মৃত্যুরও কোনও হাতছানি নেই।

নান্দীকারের বহু কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতি বছর ছোটদের নিয়ে কাজ, যেখানে আপনারা অনেক ওয়ার্কশপ-ভিত্তিক কাজ করেন। এর কারণ বা উদ্দেশ্য কী?

ছোটদের নিয়ে কাজ না করলে নিজেদের কাজ করে কী করব। আসলে দেখবেন জন্মাবার পর হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বাচ্চা বাবার মত দেখতে না মায়ের মত! কিন্তু আমরা চাই বাচ্চাটা বাড়ুক তার নিজের মত করে— কেউ কারও মত হয় না— আজকাল মাস্টাররা চান ছাত্ররা আমার প্রোটোটাইপ হোক কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্যেই বাচ্চাদের নিয়ে কাজটা করি। থিয়েটার বাচ্চাদের সত্যিকারের বেড়ে উঠতে দেয়, পৃথিবীটাকে দেখতে দেয়, চিনতে শেখায়। বড় অভিনেতা না হোক, খোলা মনের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলাই আমাদের এ কাজের উদ্দেশ্য। আমরা শুধু পাইলটের কাজ করি।

এ বছরই গণিকাদের নিয়ে কাজটা…

প্রথমে ওরাই আমাদের খবরটা দেয়। আমরা নতুন কাজ হিসেবে আগ্রহের সাথে সেখানে যাই এবং কথাবার্তার মাধ্যমে ব্যাপারটা ফাইনালাজইড করি। এবং চল্লিশ দিনের টানা ওয়ার্কশপে কাজটির পরিসমাপ্তি ঘটে। আমি মিউজিকের দায়িত্বে ছিলাম। নাটকের থিমটা ভেবেছিলাম আমি ও দেবশংকর মিলে। তবে সংলাপ ওরা ওদের মত করে ভেবেছে, বলেছে। কোনও কিছু আরোপ করা এ কাজের উদ্দেশ্য ছিল না। শিক্ষার অভাবের জন্য ওরা সংলাপ মুখস্থ করতে পারত না। নাটকটির নাম ছিল ‘ভালো মানুষ নই গো মোরা’।

বাংলা থিয়েটারে মহিলার বড় অভাব। বিশেষ করে মফস্বলে। এ ব্যাপারে,আপনার কী মনে হয়?

দেখুন, শুধু মফস্বলে নয়, কলকাতাতে মহিলা-সমস্যা আছে। যেমন নান্দীকারে পঁচিশটা ছেলে, পাঁচটা মেয়ে। আবার কিছু দলে মেয়ের সংখ্যা ও ছেলের সংখ্যার অনুপাত সমান। আসলে সেসব দল বেশি মাত্রায় সিরিয়ালমুখী বলে আমার মনে হয়।

সেভাবে মফস্বলে মহিলারা যারা কাজ করেন, তারা কিন্তু কিছুই পান না। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন? কোনও উপদেশ তাদের জন্য?

আমি! উপদেশ? তবে একটা কথা বলতে পারি যা আমি রিসেন্টলি আবিষ্কার করেছি, প্রথমে নিজের মনটাকে স্বাধীন করা দরকার। মনের যাবতীয় কনভেশন, জড়তা, ভেঙে ফেলা দরকার। আসলে এখনকার মেয়েরা ভাবে জিন্স, মিনিস্কার্ট পরলেই স্বাধীন হওয়া যায়! বাস্তবে তা নয়। ভারতীয় বাঙালি মেয়ে আমরা, কেন ওসব ড্রেস পরতে যাবে বলুন তো! নিজের বাড়িটাকে আগে সুন্দর করে দেখতে, জানতে হবে, তারপর সমাজ, তারপর পৃথিবী। আগে বাবা-মা বাড়ি। বাবা-মাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেউ থিয়েটার করতে চলে এলো, ভাবল সে খুব স্বাধীন, কিন্তু তা নয়। বাবা-মাকে বোঝাতে হবে, কনভিন্স করতে হবে, প্রত্যেককে ছোঁয়ার একটা মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

একজন অভিনেত্রী হিসেবে আপনার স্বপ্ন কী বা যেভাবে আপনি বাঁচতে চান সেভাবে বাঁচতে পারছেন কি?

প্রথমত বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি কোনও স্বপ্ন দেখি না। ছ’মাস টানা বেহালা বাজাতে বাজাতে এমন একটা সুর বেজে উঠল, নান্দীকারের সবাই এবং আমিও চমকে উঠলাম, তখন মনে হয় এই সুরের স্বপ্নটা তো আমি দেখতেই পারতাম। বা ‘শানু রায়চৌধুরী’ নাটকের দর্শক যেভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে সেটাই আমার কাছে স্বপ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো কখনও ভাবিনি যে এমন একটা নাটক লেখা হোক, তাতে আমার একক অভিনয় থাকবে। তাই কোনও মেটালিক স্বপ্ন আমাকে ছোঁয় না।

আর বাঁচতে চাওয়ার ব্যাপারটা— এখনও সোহিনী বলে, ‘জানো মা, বাসে উঠতে গেলে কীরকম আঁটোসাঁটো লাগে, গায়ে একবার না একবার হাত দেবেই’! যে দেশে অভিনেত্রীদের এই অবস্থা, সেখানে আর কী বাঁচা, কেন বাঁচা?

নান্দীকার আয়োজিত মহিলা নাট্যোৎসবে সাবিত্রী হেইসনাম অভিনীত ‘দ্রৌপদী’ নাটকে যে ঝটকা দিয়েছে, আপনার কি মনে হয় বাংলা থিয়েটারে তা সম্ভব?

কী সম্ভব আর কী সম্ভব না জানি না, তবে ধাক্কা কি পেয়েছেন? যদি পেয়ে থাকেন, সেটা অনুভব করুন। HBO বা AXN-এর নগ্ন মহিলাদের দেখে কি কোনও ধাক্কা লাগে?

না…

তাহলে যেটা পেয়েছেন, সেটা সামলান, তারপর পরে ভাবা যাবে।

অজিতেশবাবু ও রুদ্রবাবুর সম্পর্কচ্ছেদের কারণটা কী?

শুনুন, দুজনে অত্যন্ত কাছের বন্ধু ছিল, মতাদর্শগত বিভেদই এই সম্পর্কচ্ছেদের কারণ। তবে কেউ ভাল কেউ মন্দ এমনটা নয়, দুজনেই দুজনের জায়গায় অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ছিল। এটা মহান মানুষদের মনের ব্যাপার, তা ছোঁয়া আমাদের মত নগণ্যদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব!

আপনার স্বপ্নের চরিত্র…

(হেসে) শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ নাটকের কিং লিয়ার (রাজার চরিত্রে) ও ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর শাইলক (বণিক চরিত্র)। তবে দুটোই কিন্তু পুরুষ চরিত্র।

আপনার জীবনে এমন কোনও কথা আছে, যা আজও কোথাও বলেননি?

গত দেওয়ালিতে প্রদীপ ধরাতে গিয়ে আমার শরীরের একটা সাইড আচমকা পুড়ে যায়। দেড় মাস হসপিটালে ভর্তি থেকে দেখেছি, পাশাপাশি কত মানুষ দিনের পর দিন কীভাবে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষছে!
তাই আমার মনে হয়, এমনভাবে জীবনযাপন করো যেন মৃত্যুর সময় কষ্ট না দেয়।