স্বাধীনতার সদ্য কিছুকাল আগের ভারতবর্ষ। পরাধীন জাতি, অসহায় ভারতবাসী। অত্যাচার চলছে ইংরেজ শাসক দলের। আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ। লড়াই, শুধু স্বাধীনতার জন্য লড়াই। ইংরেজ বিতাড়িত হবার পূর্বে সফল করে গেলো বঙ্গভঙ্গ। অবশেষে ভাগ হল মাটি, জল, সংস্কৃতি, গোটা দেশ। লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় হল, প্রাণের দায়ে পূর্ববঙ্গ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমানে বাংলাদেশ) ছেড়ে চলে এলো পশ্চিমবঙ্গে, অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়ায়’।
অনাহার, বেঁচে থাকার লড়াই, সংগ্রাম। ১৭৫৭ অখন্ড ২৪ পরগনা বা ২৪ টি মহল হল মীরজাফরের দেওয়া লর্ড ক্লাইভকে উপটৌকন। আলোচ্য অশোকনগর হাবড়া, অঞ্চল তখন ছিল দুটি মৌজায় শেরপুর এবং বাইগাছি। চাষযোগ্য ভাবে পড়ে আছে ব্রিটিশের সম্পত্তি রূপে। সময়টা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সাল। দমদম বিমানবন্দরের বিকল্প স্বরূপ একই সময়ে কয়েকটি এয়ার ফেজ (সাময়িক বিমানবন্দর) নির্মাণ করল ব্রিটিশরা। যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত সেই সব ধ্বংসাবশেষ চিহ্ন আজও দেখা যায় বর্তমান এই মফস্বল উপনগরে। এরই মধ্যে সারা বাংলাদেশ জুড়ে পঞ্চাশের মন্বন্তর’ ( বাংলা ১৩৫০, ইংরেজি ১৯৪৩ সাল) হাজার-হাজার মানুষ আনাহারে মারা গেছে।
১৯৪৫ যুদ্ধ শেষ, এলাকা ছেড়ে চলে গেল ইংরেজবাহিনী। দেশ স্বাধীন হল। দেশভাগ হল। দিল্লির মসনদে বসলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু আর স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (১৫ অগাস্ট ১৯৪৭ — ১৪ জানুয়ারি ১৯৪৮)। অধিকাংশ মুসলিম পরিবার চলে গেল পূর্ববঙ্গে আর ওপার থেকে নিঃস্ব উদ্বাস্তু হয়ে নিরাপত্তার কারণে হিন্দুরা চলে এলো এপারে। ভারত সরকার বিভিন্ন জায়গায় রিফিউজি ক্যাম্প করে দিল, দিল খাদ্য, দিল বেঁচের থাকার আশা।
দর্শনা, গেদে রানাঘাট হয়ে অচেনা শিয়ালদহ স্টেশনে প্রথম উদ্বাস্তুদের প্রবেশ। শেকড়ের খোঁজে নতুন অন্বেষণ বাস্তুহারাদের। ১৯৪৮ সালে ড: বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রীরূপে এসে পুনর্বাসনের জন্য হাবড়া রিফিউজি টাউনশিপ্ সহ আরো কতগুলি এলাকা বেছে নিলেন। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারকে এই আরবান অঞ্চলে ‘কোয়াটার’ সমেত বসতি গড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন তৎকালীন সরকার। মূলত অশোকনগর ঘিরে যে শিল্প সংস্কৃতির আন্দোলন অর্থাৎ অশোকনগরের শুরুর দিনগুলি অবশ্যই তা পাশাপাশি অঞ্চলগুলিকে নিয়েই। বনগ্রাম, গোবরডাঙ্গা, হাবড়া, বারাসাত প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের সহচর্যেই কিন্তু অশোকনগরে সংস্কৃতির জোয়ার আসে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকে ঘিরে ক্রমান্বয়ে তা উজ্জীবিত হয়। সৃষ্টি হয় নানা শিল্পের, নানা বৈচিত্র্যের। জন্ম নেয় সাহিত্যিক, গায়ক, চিত্রকর, নাট্যকার। ভয়ঙ্কর দিন যাপনের মধ্যে দিয়ে আজকের এই সময়ে পৌঁছনো। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই উৎড়াই গেছে এই চলার পথে।
স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা, সম্পূর্ণ বাংলা ভাষার একটি দেশ। ভাষার জন্য শহীদ। পরতে পরতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে চলেছে এই বঙ্গে। জয় বাংলার জনজোয়ারের রেশ এসে পরেছে এ পারের বাঙালির মনে। এরই মধ্যে ১৯৬৬ তে হাহাকারের শুরু, খাদ্য আন্দোলন, খাদ্যের জন্য লড়াই। আরও এক মহামারি।
গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা। নকশাল আন্দোলনের মাথাচাড়া। তবু এই অঞ্চলের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে সংগ্রাম করছে। ‘বাম’ আন্দোলনে যখন পশ্চিমবঙ্গের আকাশ সন্ত্রাস মুক্ত হল তখন আরো উজ্জীবিত হল শিল্প সংস্কৃতি মহল। বামপন্থী আন্দোলনের জোয়ারে মূলত পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতির পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ। অশোকনগরেও তার বিস্তার লাভ। বৈচিত্র্যে ও মানে হাবড়ার সংস্কৃতিকে দ্রুত ছাপিয়ে গেলো। অশোকনগরে কৃষ্টিকে স্থায়ীমান করে রাখার মূলে প্রধানত মধ্য অশোকনগর বাসিন্দা – কিছুটা কল্যানগড়কে নিয়েও অর্থাৎ আমার বক্তব্যটা হল – সবাই মিলে একত্রে আসা নয়। বরং বিক্ষিপ্ত সংস্কৃতির মূলে আজকের এই সময়েও কিন্তু মধ্য অশোকনগরকে ঘিরেই মূল আন্দোলন । সেভাবে বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত হওয়া নয়।
নির্ধারিত হলো গরীব খেটে খাওয়া চাষী নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য ( বর্তমান কল্যাণগড়)রুরাল অঞ্চল। সেখানে দশ কাটা জমিসহ ব্যবসা বানিজ্যের জন্য লোনের ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে হয়েছিল। আরবান অঞ্চলে জমি সীমাবদ্ধ ছিল পাঁচকাটা বাড়িসহ। এই অঞ্চলের মানুষ তখন লড়াই করছে খাদ্যের সঙ্গে, অর্থের সঙ্গে অসহযোগিতার সঙ্গে। সরকারের পরিকল্পনা থাকলেও রাস্তা ঘাট, বিদ্যুৎ সেই অর্থে ছিল না। ধীরে ধীরে শিক্ষিত সমাজ থেকে মানুষরা বেড়িয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করে সম্মিলিত নাগরিক সমিতি। সেই সমিতির যুব নেতা ছিলেন ননী কর। নাগরিক সমিতির সদস্যরা প্রায় কেউ আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত অঞ্চল, কৃষ্টি, সংস্কৃতি। সেদিনের নিঃস্ব উদবাস্তুরা হয়তো অর্থ আনতে পারেননি কিন্তু সঙ্গে এনেছিলেন শিক্ষা, সংস্কৃতি ‘ যা এক মহৎ ঐতিহ্য ‘।
মহামতি সম্রাট অশোকের বাণীকে স্মরণ রেখে এই অঞ্চলের নাগরিক সমিতির সভায় প্রস্তাবিত নাম হিসেবে সমর্থন পায় অশোক এর নাম এবং নাগরিক পদের অন্তর হলো নগর। নামকরণ হলো অশোকনগর। ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে শিক্ষাকেন্দ্র। সংস্কৃতি চর্চার জন্য প্রথমে মূলত বিভিন্ন সমিতি গড়ে ওঠে। সঙ্গে মঞ্চ। সাহিত্য পিপাসু মানুষ হাতে নেয় কলম। সুষ্ঠু সংস্কৃতির লক্ষ্যে পাঁচের দশকের শুরুতে প্রতিটি ক্লাব সংগঠন তৈরি হয় এবং প্রতিবছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ক্রিয়া প্রতিযোগিতা, চিত্র প্রদর্শনী খেলাধুলার ব্যবস্থা করে প্রথম ‘শক্তি সাধনা’ ক্লাব। ওই সময় কলকাতার শিল্প সংস্কৃতির তালে অশোকনগরেও ছাপ পড়ছে। দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে সেই সময়ে মানুষ আরো বেশি বেশি করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে কাছে এসেছিল মানুষের। কোনো নাট্য সংস্থা তখনও গড়ে ওঠেনি। গণনাট্যের ক্ষীণ ছায়া তখন সবে পড়তে শুরু করেছে। সুধীপ্রধানের ভাবনায় প্রথম কল্যাণগড়ে মঞ্চায়িত হয়েছে নীলদর্পণ নাটক(নীলদর্পণ শতবার্ষিকী উৎসবে)।
লেখালেখির সূত্রে জন্ম নিল ‘সংস্কৃতি পরিষদ’ এর উদ্যোগে জন্ম নিল প্রথম সাহিত্য পত্রিকা ‘ ঋতুপত্র’ ১৯৫৭ সালে। কথা ছিল প্রতিমাস অন্তর প্রকাশিত হবে এই পত্রিকা কিন্তু বাধ সাধলো অর্থ। একটি সংখ্যা প্রকাশের পরই ঋতুপত্র পত্রিকার মৃত্যু ঘটে। ওই পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীতে ছিলেন – ইন্দুভূষণ দাস, বীরেন্দ্র নিয়োগী, সাধন সেন, অরুণ চ্যাটার্জী তাঁদের মধ্যে অন্যতম।