তিন
সে সময় জেলায় জেলায় সারা বাংলা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো সম্পূর্ণ শীতকাল জুড়ে। অর্থাৎ বাংলার নানা ধরনের উৎসব, পার্বণ এসব ছিল সেই সময়কালের অঙ্গ। আর এ সব মূলত অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চেই বেশি হতো। সারা বাংলা থেকে নাট্যদলগুলি অংশগ্রহণ করতো এই প্রতিযোগিতায়। আমাদের গ্রামের প্রতিযোগিতায় আমরা যারা স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম তারা চাইতাম কোন দলের গ্রীণরুমের দায়িত্ব নিতে। তাহলে কিভাবে তারা সাজগোজ অর্থাৎ make-up করেন, পোশাক পরেন; সেট তৈরী করেন তা দেখার এবং মাঝে মধ্যে কথাবার্তা বলার সুযোগ পাওয়া যেত। এভাবেই বহু বহু নাট্যদলের নির্দেশক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সাথে কথা বলার সুযোগ হতো । তাঁরা যদি শো শেষে ফেরার সময় আমাদের কারোর সম্বন্ধে প্রধান কর্তাদের কাছে প্রশংসা করে যেতেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সেটা হতো আমাদের কাছে উপরি পাওনা। প্রতিদিন নাটক শেষে নিজে নিজেই ঠিক করে ফেলতাম সেদিনের শ্রেষ্ঠ নাটক কোনটি। শেষদিন বিচারকদের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের সাথে যদি কিছু অংশ মিলে যেতো তাহলে ভিতরে ভিতরে গর্ব বোধ করতাম এই ভেবে যে, নাটক কিছুটা বুঝতে শিখেছি। যদিও সেভাবে পাত্তা পাওয়া যেত না কর্তৃপক্ষের কাছে তবু এই প্রতিযোগিতায় আসা সেরা নাটকগুলোর কাছ থেকেই ছিল আমার যাবতীয় নাট্য শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ। বহু কষ্ট, বহু শ্রমের বিনিময়ে যদি একটা মঞ্চ, আলো আর দর্শক উৎসাহ পাওয়া যায় তাহলে তার থেকে বড় প্রাপ্তি কিছু নেই বা হতে পারে না। এমনটা অনেক বেশি টের পেয়েছি যখন নিজে উঠেছি মঞ্চে, ছুটে ছুটে গেছি গ্রাম থেকে গ্রামে। কোথাও শো শেষে হাতে উঠেছে ইটের মত শক্ত লাড্ডু, টিনের মত কঠিন রুটি অথবা রঙিন চিনির গোলা মিষ্টি, অথবা দু-পিস সত্যিকারের দম লেগে যাওয়া আলু। তবুও শো শেষে ভ্যান-রিক্সা না পেয়ে বাক্স কাঁধে দৌড়েছি শেষ ট্রেন ধরার জন্য অথবা ট্রেন না পেয়ে দল বেঁধে রাত কাটিয়ে দিয়েছি প্ল্যাটফর্মের অবিন্যস্ত মেঝেতে। তারপরেও সেইসব দিনরাত্রির কাব্য আমার বা আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে থিয়েটারের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি।
চার
সংস্কৃতিচর্চায় গোবরডাঙ্গা বরাবর খুবই সমৃদ্ধশালী জনপদ। ইতিহাস চর্চা করলে দেখা যাবে যে এই অঞ্চলে যেমন উচ্চমার্গের সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ ছিল ঠিক তেমনই প্রান্তিক সংস্কৃতিচর্চারও একটা পরিসর তৈরি হয়েছিল। তবে সময়ের পরিবর্তন ও আচার-আচরণের পরিবর্তনের ফলে সংস্কৃতি পরিশীলিত রূপটাই মফস্বল শহর গোবরডাঙ্গায় বেশি মাত্রায় প্রকাশের অন্যতম জায়গা ছিল গোবরডাঙ্গা টাউন হল অর্থাৎ পৌরসভা পরিচালিত পি এন বোস মেমোরিয়াল হল। যেখানে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় বসতো নানা ধরনের শিল্পচর্চার আসর। কোনদিন সংগীত, কোনদিন নৃত্য, কোনদিন আবৃত্তি, শ্রুতিনাটক আবার কোনদিন মঞ্চ নাটক। সন্ধ্যা ঘনাবার সাথে সাথে আমার দেখা সেই সময়ের প্রায় ভাঙাচোরা অর্ধজীবিত টাউন হল ভরে যেত অসংখ্য দর্শকের উপস্থিতিতে। যারা কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি দর্শক হিসেবেই আসতেন না, তাঁরা কথা বলতেন একে অন্যের সুখ দুঃখের, বিনিময় করতেন কুশল আর মন ভরে উপভোগ করতেন সেই সন্ধ্যার আয়োজন।
এমনই এক সন্ধ্যায় আমি আমার পরিবারের সাথে উপস্থিত হয়েছিলাম একটি নাটক দেখবার জন্য। যে নাটকে গোবরডাঙ্গা অঞ্চলের স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে আমার বাবাও অভিনয় করেন একজন পুলিশ অফিসারের চরিত্রে। নাটকটি সেই সময়ের নিরিখে প্রশংসা লাভ করেছিল। আমার স্মৃতিতে কয়েকটি দৃশ্য আজও রয়েছে এবং আমার বাবার নাট্যসংযোগের ঘটনাটি উদাহরণ স্বরূপ রয়ে গেছে যা আমাকে আজও উদ্দীপ্ত করে।
পাঁচ
আমাদের গ্রামের নাটক প্রতিযোগিতার কথা আগেই বলেছি। কি ভীষণ হুল্লোর লাগতো আমাদের মধ্যে। তো সেই প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করতে প্রতি বছর কোন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমন্ত্রিত হতেন। তিনি মূলত নাট্যচর্চা বা অভিনয় জগতের মানুষ হতেন। তেমনই এক আয়োজনে উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র। তখন আমার ছাত্রাবস্থা। আমি মনে মনে অত্যন্ত উত্তেজিত। শুধু আমি নই, আমাদের অঞ্চলের সকলেই। কেননা থিয়েটার মনোজ মিত্রকে যেভাবে চিনিয়েছে আমাদের অঞ্চলের মানুষদের কাছে তার থেকে অনেক বেশি চিনিয়ে ফেলেছে চলচ্চিত্র। এ অঞ্চলের মানুষ ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে ‘শত্রু’ নামের বক্স অফিস হিট ছবিটি। সেই চলচ্চিত্র খ্যাত মনোজ মিত্র আসবেন গ্রামে (এ প্রচার নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসবো) ফলে ধারে-ভারে নাটক প্রতিযোগিতা বেশ সবল সেবার। নির্ধারিত দিনে সন্ধ্যা নামার কিছু আগে বেলা থাকতে থাকতেই মনোজবাবু উপস্থিত হলেন গ্রামে। সকলে যথাযথ অভ্যর্থনা জানালো। যেহেতু অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশ কিছুটা সময় বাকি, সেহেতু তাঁর সামান্য যত্ন করবার জন্য স্কুলের পাশে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। বাড়ির উঠোনে তখন গ্রামের লোক ভিড় করেছে। আয়োজকরা বলছে মঞ্চের সামনে যেতে। ওখানেই আর একটু পরে অতিথি যাবেন। কে কার কথা শোনে, আবেগ এতটাই। যাই হোক, মনোজবাবুকে বসানো হলো আমাদের একটিমাত্র ঘরের বিছানায়। আপ্যায়ন করা হলো। সেদিন আপ্যায়নের মেনুতে আমাদের কঙ্কনা বাঁওড় থেকে ধরা রুই মাছ ভাজাও ছিল যা আমার আজও মনে আছে। আপ্যায়ন ও পরিচিতি পর্ব চলতে চলতে মনোজবাবু আমাকে কাছে ডাকলেন। কোলে বসালেন। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন ‛অনেক বড় হও’। আমার ছোটবেলার বদ অভ্যাস ছিল বড় মানুষদের (আমার কাছে) সই (স্বাক্ষর) সংগ্রহ করা। যথারীতি আমার সেই ডায়রিটি এগিয়ে দিই মনোজ মিত্রের হাতে। তিনি সেদিন তাঁর স্বাক্ষর দিয়েছিলেন ডায়রির পাতায় যা আজও রাখা আছে সযত্নে। আর মনে আছে তাঁর দেওয়া আশীর্বাদবাণী।
ছয়
যে কথা ঠিক আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম। মনোজ মিত্র’র আগমন সম্পর্কে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া ঘটনার কথা বলবো। সেবছর যথারীতি মনোজ মিত্র নাটক প্রতিযোগিতার উদ্বোধক।