সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি
“১৯৩৮-৩৯ সাল কালিকা থিয়েটারের পিছনে যে বাড়িতে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার থাকতেন সেখানেই জমে উঠেছিল আমাদের আড্ডা। অরুণবাবু – কবি অরুণ মিত্র ছিলেন সত্যেন্দ্রবাবুর পুত্রবৎ [ পুনশ্চ ।। অরুণ মিত্র সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার বলতেন : আমার চিত্ত হইতে, বিত্ত হইতে, পুত্র হইতে প্রিয় অরুণ] আর শান্তি মিত্র ছিলেন ভাগ্নী – তা ওঁড়াও বেশ সক্রিয় অংশীদার ছিলেন এই আড্ডায়। তাছাড়া রমাকৃষ্ণ মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ আরও থাকতো কয়েকজন। নিছক আড্ডার সঙ্গে মাঝে মাঝে কবিতা পড়তেন অরুণবাবু, হেমন্ত গান শোনাত। তখন আমারও কবিতা বেরিয়েছে আনন্দবাজারে, সেই সূত্রে এর-ওর সঙ্গে আলাপ পরিচিয়। সেই সময় চারিপাশে শুধু যুদ্ধের খবর। আমাদের মধ্যে অরুণবাবু যুদ্ধের ব্যাপারটা খুব ভাল বুঝতেন। ওঁর যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা আমরা বেশ হা দিয়ে শুনতাম। বিশেষত আমদের সকলেরই খুব মন খারাপ তখন, কারণ সভিয়েট হারছে।…
১৯৪৩-এর বম্বেতে আমাদের প্রগরেসিড রাইটার্স কনফারেন্সে আগুন অথবা জবানবন্দীর মধ্যে যে একটি নাটকে গোপালদার (হালদার) সঙ্গে আমিও অভিনয় করেছিলাম। … সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে আসবার পর অরণির প্রকাশ। সেই দলে ছিলেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণবাবু, বিজন ভট্টাচার্য — এঁদের বলা হত প্রগরেসিভ মার্কসিস্ট। আরো যারা সঙ্গে যুক্ত হলেন : সরোজ দত্ত, বিনয় ঘোষ, গঙ্গাদা। … বিজনবাবুকে সাহিত্যের মানুষ হিসেবেই দেখা হত। কিন্তু তখনো পর্যন্ত নাটকের বিষয়েই যুক্ত হয়েছিলেন বলে মনে পড়ে না।”
ফ্যাসি বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘে অরুণ মিত্র যেতেন। সেখানেই শম্ভু মিত্রের সঙ্গে তৃপ্তি মিত্রের প্রথম পরিচয়। এছাড়া ওখানে আসতেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তৃপ্তি ভাদুড়ীর মেট্রিক এর রেজাল্ট বেরুবে- বেরুবে… ‘ধরতি কে লাল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য বড়মামার তীব্র আপত্তি, অরুণবাবু রাজী করান।
পেশাদারী মঞ্চে অভিনয় – ১
১৪.৮.১৯৪০
রংমহলে ‘মালা রায়’ নাটকের উদ্বোধন। রচনা : বিধায়ক ভট্টাচার্য। নির্দেশনা : নরেশ মিত্র। গত বছর রংমহলে যোগদান করেছেন শম্ভু মিত্র। পুরনো নাটকে কয়েকটি ভূমিকায় অভিনয় করার পর নতুন নাটকে এই প্রথম সুযোগ পেলেন। ২৫ বছরের যুবক শম্ভু মিত্র পেশাদারি মঞ্চে মাসিক বেতনে কাজ করছেন। শ্রেষ্ঠাংশে নরেশ মিত্র, ঊষাবতী, রবীন্দ্রমোহন রায় (রবি রায়) ও শান্তি গুপ্তা। সমীর চরিত্রে শম্ভু মিত্র।
১৪.১২.১৯৪০
রংমহলে ‘ঘূর্ণি’ নাটকের উদ্বোধন। রচনা : গৌর শী। নির্দেশনা : অহীন্দ্র চৌধুরী। এই মঞ্চে তখন নিয়মিত অভিনয় করছেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। অল্প দিনেই শম্ভু মিত্র তাঁর ভক্ত হয়ে উঠলেন। ঘূর্ণিতে পেলেন নতুন ভূমিকা। পরে লিখবেন ‘ঘূর্ণি’ নাটক। এই পর্বে রংমহলে অভিনয় করতেন অহীন্দ্র চৌধুরী, আশু বোস, নরেশ মিত্র, ভূমেন রায়, রবি রায়, সিধু গঙ্গোপাধ্যায়। মেঘা : শম্ভু মিত্র।
২৪.১২.১৯৪০
রংমহলে ‘রত্নদীপ’ নাটকের উদ্বোধন। কাহিনী : প্রভাত মুখোপাধ্যায় ; নাট্যরূপ : বিধায়ক ভট্টাচার্য ; নির্দেশনা : নরেশ মিত্র। এই মঞ্চে এ নাটক ছাড়াও অভিনয় করলেন ‘মাটির ঘর’ নাটকে। রত্নদীপে অভিনীত চরিত্র : মুখুজ্জে । শ্রেষ্ঠাংশে : অহীন্দ্র চৌধুরী, ঊষা দেবী।
৭.৬.১৯৪১
রংমহলের পর মিনার্ভায় যোগ দিলেন শম্ভু মিত্র। অভিনয় করলো মাত্র একটি নাটকে ‘জয়ন্তী’। রচনা : ধীরেন মুখোপাধ্যায় ; নির্দেশনা : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
দীপক : শম্ভু মিত্র / জয়ন্তী : অপর্ণা দাস।
পেশাদারী মঞ্চে অভিনয় – ২
মিনার্ভায় রইলেন মাত্র মাস দুয়েক। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রায়ই মিনার্ভায় আসতেন শম্ভুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। একদিন উইংসের ফাঁক দিয়ে মহর্ষি অভিনয় দেখছিলেন। মঞ্চের সত্ত্বাধিকারী দিলোয়ার হোসেন বিরক্ত হয়ে বললেন : ” আর্টিস্টের কাছে বাইরের লোক কেন আসে? ” মহর্ষিকে অপমান করার প্রতিবাদে পরদিনই মিনার্ভা ছাড়লেন তিনি।
১২.৭.১৯৪১
যোগ দিলেন নাট্য নিকেতনে (বর্তমান বিশ্বরূপা)। ভূমেন রায় নিয়ে গেলেন। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালিন্দী নাটকে ‘মিস্টার মুখার্জীর’ চরিত্রে অভিনয় করলেন শম্ভু মিত্র। পরিচালনা : নরেশ মিত্র। এ নাটকে ‘সারি’ সাজতেন সুনায়িকা অভিনেত্রী রাধারানী। আর ছিলেন নীহার বালা, ভূমেন রায়, মৈলেন চৌধুরী, রবি রায়।
১৯৪১
নাট্য নিকেতনে পরবর্তী নাটক ‘মাটির ঘর’-এও অভিনয় করলেন শম্ভু মিত্র। রংমহলের মতো এখানেও এই নাটকে সহ অভিনেতা ছিলেন দূর্গা দাস।
পেশাদারী মঞ্চে অভিনয় – ৩
‘মাটির ঘর’ নাটকে মহর্ষি অভিনয় করতেন সত্যপ্রসন্নের ভূমিকায়। তিনিই ঐ মাটির ঘরের কর্তা। তাঁর এক মেয়ে স্বামীর অত্যাচারে আত্মহত্যা করে। তখনো সত্যপ্রসন্ন অন্যকে বলেছেন, বোঝাতে চেয়েছেন যে, — বিশ্বাস হারাতে নেই। রাত্রি যতো অন্ধকারই হোক একদিন তারপরে সকাল হবেই। কিন্তু তাঁর জীবনে সে-সকালটা আর এলো না।
নাটকের শেষ দৃশ্যে তাঁর আর এক মেয়ে পাগল হয়ে গেল এবং পুত্রপ্রতিম যে-জামাই সে মারা গেল। তখন সেই বুড়ো সত্যপ্রসন্ন ওপরের দিকে চেয়ে বলে, তবু আমি কাঁদবো না। তুমি আমায় কাঁদাও দেখি – স্টুপিড, – তুমি আমাকে কাঁদাতে পারবে না।
‘সেই সময়ে মহর্ষির সেই বিশাল চোখদুটো যেন উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাতো। চোখের শিরাগুলো লাল হয়ে ফুটে উঠ। তাঁর ঠোঁট বেঁকে যেতো। আর অতো বড় শরীরটা যেন থরথর করে কাঁপতো। একটা অস্বাভাবিক কন্ঠে তিনি বলতেন, — তুমি স্টুপিড, তুমি আমাকে কাঁদাতে পারবে না।’
(কিছু স্মরণীয় অভিনয় ।।১৯৬৫)
‘রত্নদীপ’ নাটকে মনোরঞ্জনবাবু দেওয়ানের অভিনয় করতেন। যখন নায়ক তার কাছে স্বীকারোক্তি করে যে — সে একজন জোচ্চোর, সে ভবেশ সেজে এসেছিল, তখন মহর্ষির অভিনয় হোত অবিস্মরণীয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলতেন : ‘সেজে এসেছো? কী বলছো কী তুমি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। বুড়ো মানুষ যেমন কিছু একটা বুঝতে না পারলে রেগে ওঠেন সেই রকম রাগত ভাবেই বলতেন। তারপর কথাটা যখন বোধগম্য হোত তখন খপ করে রাখালের বুকের কাছের জামাটা মুঠো করে ধরে ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠতেন : ‘জোচ্চোর! তোমাকে আমি পুলিসে দেব।’ তারপর রাখালের মুখে বিনাবাক্য ব্যয়ে শাস্তি নেবার প্রস্তুতি দেখে, তার অকপট স্বীকারোক্তির কথা মনে করে, কেমন যেন নরম হয়ে আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বলতেন : বাহবা, বাহবা! জোচ্চোর!
“এঁদের অভিনয় দেখতে দেখতে আমি শিখেছি যে অভিনয় ব্যাপারটা মোটেই একমেটে নয়। … নিজের অভিনয় চরিত্রের ব্যক্তিগত গল্পটাকে প্রকাশ করাই হল অভিনেতার কাজ। … আমার ভাগ্য আমি কিছু ‘মানুষ’ দেখেছিলুম। তাঁদের অনেকে জীবনে অনেক কষ্ট পেয়ে গেছেন। খুব নীচ কষ্ট, খুব ভাল্গার কষ্ট। টাকা না থাকার কষ্ট। কী জানি, জীবনটাই বোধ হয় এমনি নিষ্ঠুর!’ (কিছু পুরনো কথা ।। ১৯৬৩)
ক্রমশ…
গবেষণামূলক এই লেখা বাংলা নাট্যের এই কিংবদন্তীকে বুঝতে সাহায্য করবে আমাদের। ধন্যবাদ।