সিউড়ির অনির্বাণ পৌঁছে গেছে মিনার্ভায় – বিজয়কুমার দাস

সিউড়ি শহর থেকে ‘ ইয়ং থিয়েটার ‘ দলে থিয়েটার করতে করতে অনির্বাণ ঘোষ স্বপ্ন দেখত থিয়েটারের বৃহত্তর অঙ্গণে কাজ করার। আর এই স্বপ্নটাকে বাস্তবায়িত করতে অনির্বাণ প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রস্তুত করেছে থিয়েটারের জন্য। সিউড়ি ইরিগেশন কলোনির ছেলে অনির্বাণের কিন্তু থিয়েটারে আসাটা আকস্মিক। ইরিগেশন কলোনিতে সিউড়ির ‘আনন’ গোষ্ঠী রিহার্সাল দিত। সেখানে শুভ নামে এক বন্ধু অভিনয় করত। সেইসব রিহার্সাল লুকিয়ে চুরিয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দেখত অনির্বাণ। এই কলোনিতেই সরস্বতী পুজোয় নানা অনুষ্ঠান হতো। একবার ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতা হবে শুনে বন্ধু তন্ময়ের সঙ্গে পরিকল্পনা করে ঘন্টা দুয়েকের প্রস্তুতিতে নেমে পড়ল প্রতিযোগিতায়।বিচারকের আসনে ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরিচালক বাবুন চক্রবর্তী। প্রতিযোগিতায় তন্ময় আর অনির্বাণ মাতালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে গেল।নিজেকে যেন অন্যরূপে আবিষ্কার করে ফেলল অনির্বাণ।

সেই কলোনিতেই সিউড়ির নির্মল হাজরা ইয়ং পার্লামেন্ট ( অধুনা ইয়ং থিয়েটার) নামে নাটকের দল চালায়। নির্মল অনির্বাণকে প্রস্তাব দিল থিয়েটার করার। প্রস্তাবটা প্রায় লুফে নিয়েছিল অনির্বাণ। তখন থেকেই তার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল থিয়েটারের সঙ্গে। ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতে করতে নির্মল হাজরার দলে প্রধান চরিত্রের শিল্পী হয়ে ওঠে ক্রমশ। তখনও সে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোয়নি। সিউড়ির শরৎচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ, বীরভূম জেলা স্কুল ছুঁয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হলেও চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়া হয়নি থিয়েটারে মেতে যাওয়ার জন্যই। বাড়িতে না জানিয়েই দলের সঙ্গে এখানে ওখানে থিয়েটারের নেশায় ঘুরে বেড়ানো শুরু হয়েছিল। অবশ্য পরে থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনো করার জন্য সুযোগ মিলে যায় রবীন্দ্রভারতীর নাট্য বিভাগে। সেখান থেকে নাটক নিয়ে স্নাতক এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী জুটে যায়। মাঝে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কিছু সময় যুক্ত থাকা। থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনায় বাড়ির লোকের ইচ্ছা ছিল না।কিন্তু অনির্বাণ থিয়েটারকে ভালোবেসেই থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনো করেছে। ২০০৪ সালে বীরভূম জেলা স্কুলের অস্থায়ী মঞ্চে একটি সরকারী মেলার আয়োজনে নির্মল হাজরার পরিচালনাতেই প্রথম সচেতনভাবে মঞ্চে নামা। তার আগে ওই ইরিগেশন কলোনিতেই।

একটা ভাল লাগা থেকেই তার থিয়েটারে জড়িয়ে পড়া। একটা সময় মনে হয়েছিল, থিয়েটার এমন একটা মাধ্যম যেখানে নানা চরিত্রের হয়ে কথা বলা যায়। একটা সৃষ্টিশীলতার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া যায়। থিয়েটার করতে গিয়ে একটা আনন্দ হয় বলেই সে থিয়েটারের কাজে আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছে। থিয়েটার ছাড়াও দলের দব কাজেই যুক্ত থাকতে ভালবাসে সে। শুধু অভিনয় নয়, থিয়েটারে আবহ, থিয়েটার বিষয়ক প্রদর্শনী, মঞ্চের ডিজাইন সহ অন্যান্য নানা কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছে। একজন পরিপূর্ণ নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে চেয়েছিল প্রথম থেকেই। আশিস চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়,তীর্থঙ্কর চন্দ, মণীশ মিত্র প্রমুখের অধীনে কর্মশালা করেছে।

মণিপুরী, কালারিয়াপাত্তু, বাটিক, রায়বেঁশে নিয়েও দেবাশিস রায়চৌধুরী, বিম্বাবতী দেবী, কল্পনা বড়ুয়া, তরুণ প্রধান প্রমুখের তত্ত্বাবধানে কর্মশালা করার অভিজ্ঞতাও অনির্বাণের ঝুলিতে।

নিজের দল ইয়ং থিয়েটারে নির্মল হাজরার পরিচালনায় বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি সম্রাট মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ দাস সহ মণীশ মিত্র, সুরজিৎ সিনহা (মহিষাদল শিল্পকৃতি), ড: তরুণ প্রধান (রবীন্দ্রভারতী), অবন্তী চক্রবর্তী ও অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় ( বিশ্বভারতী), দেবাশিস রায় ( হাতিবাগান স্পর্শ) প্রমুখের নির্দেশনায় কাজ করেছে অনির্বাণ।

বিকল্প থিয়েটারের প্রতি তার একটা আগ্রহ রয়েছে। তার মনে হয়েছে, করোনার কারণে বিকল্প থিয়েটার গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা আনন্দের খবর। একসময় খানিকটা জেদ করেই থিয়েটারে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে থিয়েটারেই থেকে যেতে চায়।

মিনার্ভায় একজন শিক্ষার্থী অভিনেতা হিসাবে যোগ দিতে পারাটা তার কাছে সাফল্যের একটা মাইলস্টোন। সিউড়ি থেকে মিনার্ভা পর্যন্ত পৌঁছনোর পথে সেই প্রথমদিকের অভিনয়ের ঘুড়ি এবং দুখীরামের অরূপকথা নাটকের চরিত্রদুটির প্রতি তার একটা ভালবাসা থেকে গেছে। এছাড়া ইয়ং থিয়েটারে সফদর হাসমী কেন্দ্রিক একটি নাটকে কথক চরিত্রটি তার প্রিয় চরিত্রের তালিকায়।পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির কর্মশালায় মণীশ মিত্রর তত্ত্বাবধানে এক পরাজিত সৈনিকের চরিত্র, নিজের দলের শুভদৃষ্টি ফুলশয্যা নাটকে ভোলা চরিত্র, অবন্তী চক্রবর্তীর পরিচালনায় রাজা নাটকে ঠাকুরদা চরিত্রগুলিও প্রিয়।
অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক লেখা, চিত্রনাট্য লেখা,অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় আগ্রহ আছে। থিয়েটার দেখা এবং থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনো তার অভ্যাস। মিনার্ভায় যোগ দিয়ে বাড়ির মানুষজনকে আশ্বস্ত করতে পেরেছে যে, থিয়েটার নিয়েও বাঁচা যায়। অনির্বাণের কথায়, এই তো সবে যাত্রা শুরু। সামনে দীর্ঘ পথ। পথে মাথা উঁচু করে বেঁচে অনির্বাণ বলতে চায়, দ্যাখো, আমি থিয়েটারের জন্য থিয়েটার নিয়ে বেঁচে আছি।