আগে যা ঘটেছিল…
১৮৮২-র কলকেতা শহরে একটা দুপুরে খুব কাছাকাছি নানান বিচিত্র ঘটনা ঘটে ঘটছিল। সেদিন কর্নোয়ালিশ স্ট্রিটের বেশ্যাপল্লী অথবা একটি অভিজাত বাসগৃহ একই সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছিল নতুন কিছুর। কোথাও জলে ডোবা একটি মেয়ের জীবন বাঁক নিচ্ছিল অন্য ভুবনে, কোথাও মহানায়িকা বিনোদিনীর সুপুরুষ পন্ডিত প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, আবার ওই একই দিনে গুর্মুখ রায় অভাবনীয় প্রস্তাব নিয়ে প্রবেশ করছিল তার জীবনে। আবার কোথাও বাঁধা পরছিল উনচল্লিশের বিপত্নীক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একুশের কাদম্বিনীর জীবন, আবার রামবাগানের বেশ্যা পল্লীতে সুরে সুরে দুলে উঠছিল আর একটি সম্ভাবনা। এসব কী ইতিহাস হবে নাকি হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে…
পর্ব – ৪
শোভাবাজার গঙ্গার ঘাটে তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। অথচ ভোরের মৃদু উত্তাপটুকু গঙ্গার জলে পড়তে শুরু করেছে। সকালের এই মুহূর্তটুকু চর্ম চক্ষে বোঝা যায়না। বুঝতে হয় অনুভবে। পাখীরা বোঝে সে ভোরকে। মহাসাধকরাও বোঝেন। তাই অন্ধকার থাকতেই ভোরের অনুভবটুকু নিয়ে সেদিন গঙ্গা বক্ষে কোনও মহাসাধক উদাত্ত কন্ঠে সূর্যস্তব পাঠ করছিলেন।
“ওঁ সূং সূর্যায় নমঃ ।
আদিত্যঃ প্রথমং নাম দ্বিতীয়ং তু দিবাকরঃ ।
তৃতীয়ং ভাস্করঃ প্রোক্তং চতুর্থং তু প্রভাকরঃ ॥
পঞ্চমং তু সহস্রাংশুঃ ষষ্ঠং ত্রৈলোক্যলোচনঃ ।
সপ্তমং হরিদশ্বশ্চ অষ্টমং চ বিভাবসুঃ ॥”
ওই কাক ভোরে বিনোদিনী সেদিন বাগবাজারের ঘাটে বসে পাখির ডাক, আর মহা মন্ত্রের উচ্চারণ শুনছিল। প্রতিটা শব্দ অদ্ভুত শীতল অনুভূতি নিয়ে বিনোদিনীর মরমে প্রবেশ করছিল। ঘোর অমানিশার পরের ভোরে কোন সাধকের কন্ঠ থেকে ঝরে পড়ছে এমন আওয়াজ! তাকে দেখার জন্য ছটফট করে বিনোদ। মন বলছিল বিনোদিনীর, এ সাধক সমস্ত অন্ধকারকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিতে পারে। আলোর বড় প্রয়োজন এ জীবনে তার। বিনোদিনী আতিপাতি করে খোঁজে সেই সাধককে, অন্ধকারে ঠাহর হয়না কিছুই।
রোজকার ভোরের সঙ্গে অমাবস্যার পরের ভোরের তফাত কেবল আলোর জন্য প্রচন্ড আকুতিটুকু। অথচ আলো ফুটলে কেউ কেউ বোঝে দিনগুলো আসলে আসে আসন্ন অন্ধকারের ইঙ্গিত নিয়ে। তবু তারা ভোরের আলোটুকুর অপেক্ষা করে, বিনোদিনীও করে। তাই অন্ধকার থাকতে থাকতে বিনোদিনী শোভাবাজারের গঙ্গার ঘাটে এসে বসে প্রতিদিন, সূর্য ওঠা দেখবে বলে। সেদিনও একখানি কালো আলোয়ানে আপাদমস্তক মুড়ে বসে ছিল বিনি। বিখ্যাত হবার এই জ্বালা। নিজের মতো বাঁচার অধিকারটুকু চলে যায়।
আজকাল বিনোদিনী যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে পারেনা। লোকে চিনে ফেলে। কেউ ভালোবেসে হামলে পড়ে, কেউ কটুকথা বলে। এসব সয়ে গেছে ওর। দিব্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রপ্ত করেছে সে। গিরিশ বাবু, অমৃতবাবু অভিনয় শিক্ষার সঙ্গে এসবও শিখিয়েছেন বিনোদিনীকে। তবু এই সময়টুকু মানুষকে অসহ্য লাগে বিনোদিনীর। ভোরটুকু কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হয়না তার।
বিনোদিনী রোজ দেখে ভোরের প্রথম আভাটুকুর গঙ্গা স্পর্শের দৃশ্য। আজও দেখছে, সে আভায় তখনও রঙ ধরেনি কেবল সূর্যের নরম, স্নিগ্ধ উত্তাপটুকু এসেছে। এ সময় অসূর্যম্পশ্যা নারীরা গঙ্গা স্নানে আসে। পালকি করে তারা আসে, আর পালকি বাহকরাই পালকি শুদ্ধু তাদের জলে ডুবিয়ে নিয়ে চলে যায়। অন্ধকারে বোঝার উপায় থাকে না কোন বাড়ির মেয়ে বৌরা এলো স্নানে। যাঁরা আসেন তাঁদের অনেকেরই পতি পরমেশ্বর বাঈজী বাড়ি থেকে রাতে বাড়ি ফেরেনা, অর্থ, কাম, মদ, মাৎসর্য সব নিয়ে ডুবে থাকে পাপ বোধ ছাড়াই। আর তাদের স্ত্রীরা গঙ্গায় ডুবে নিজেদের শুদ্ধ করতে আসে আলো ফোটার আগেই। এই রীতি দুনিয়ার।
আর এই কাক ভোরে গঙ্গায় ডুবতে আসে সাধক আর বাঈ- বেশ্যারাও। বেশ্যাদের সূর্য কেন পৃথিবীর কারও স্পর্শের বাধা নেই। বেশ্যা ঘরের মেয়ে-ঝি রা বহু স্পর্শের ভবিতব্য নিয়েই জন্মায়। তবু যে কেন মনের মধ্যে পাপ বোধ বাসা বাঁধে কে জানে। বারানসী থেকে কলকাতা গঙ্গা যেখানে প্রবাহমান সেখানকার বাঈ বেশ্যাদের রেওয়াজ গঙ্গা জলে নিজেকে ডুবিয়ে শুদ্ধ করার। তাদের কারও কারও সঙ্গে বিনোদিনীর দেখা হয় রোজ এই গঙ্গার ঘাটেই। কেউ কেউ হাসি বিনিময় করে, কেউ স্পষ্ট বিনোদকে এড়িয়ে চলে। ভাবে এত্ত নাম ডাক, দেমাকে না জানি বা কি করবে। বিনোদেরও আজকাল আর এদের সঙ্গ ভালো লাগেনা। ওর চোখের সামনে, কাব্য, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাসের বৃহৎ জগৎ খুলে দিয়েছে থিয়েটার। এদের সঙ্গে আর কি কথা কইবে বিনোদ ভেবে পায়না।
আজ বুঝি বড় আগে এসেছে বিনোদ ঘাটে। অসূর্যম্পশ্যাদেরও দেখা নেই তখনও, বাঈ বেশ্যাদেরও না। নিস্তব্ধ ঘাটে বিনোদিনীর কানে আসে কেবল সেই সাধকেরই কন্ঠস্বর। অপ্রকাশিত সূর্যটুকু নিয়ে এখনও তিনি সূর্যস্তব পাঠ করে চলেছেন —
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম । ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্ ।।
‘সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম ‘ শব্দগুলো মনে মনে বারেবারে আউড়ে চলে বিনোদ। কে জানে সূর্যের সমস্ত পাপ হরণ করার ক্ষমতা থাকে কিনা। আচ্ছা বিনোদিনী কি পাপী? এই গঙ্গার ধারের প্রায়ান্ধকারে কত কী ছাইপাঁশ যে মনে আসে বিনোদিনীর। পাপবোধ কুরেকুরে খায় কেন আজকাল। কোন পাপের কথা ভাবে বিনোদ! নিজের প্রিয়কে ভুলে পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে গুর্মুখের কেনা রক্ষিতা হয়েছে সেই পাপ! এমন পাপ তো এ জীবনে বহুবার করেছে বিনোদ!
তাছাড়া এই সিদ্ধান্ত তো সে একা নেয়নি। তার গুরুকে জিজ্ঞেস করে তবে নিয়েছে। গুর্মুখকে গ্রহণ করার আগে গিরিশবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিল বিনোদ। গিরিশবাবু বিনোদিনীর চেয়ে বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন, যখন শোনেন এই সম্পর্কের বদলে থিয়েটার বাড়ি গড়ে দেবে লোকটা। বিনোদিনীকে বলেন
“অমুক বাবুর কাছে কমিটমেন্টের ন্যাকামি করে এমন সুযোগ হারাসনে বিনি। মনে রাখিস, তুই আগে অভিনেত্রী পরে প্রেমিকা। তোর থিয়েটার না থাকলে কোন বড় বড় বাবু আসতো তোর কাছে? পাতি তিন পয়সার বেবুশ্যে হয়ে দিন কাটাতি। থিয়েটারে এমন সুযোগ কজন পায়। আমাদের তো কেউ ভালোবেসে এমন প্রস্তাব দেয়নি কো।”
বিনোদ জানতো এ লোকটার কাছে প্রেম, ভালোবাসা, সমাজ সংসার সবটাই থিয়েটার। এ ভিন্ন কোনও উত্তর বিনোদ আশা করেনা। কতবার বিনোদিনী ভালোবাসতে গেছে লোকটাকে প্রতিবার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে থ্যাটারের ডায়লগ বলে উঠেছে।
“বিনি অমুক জায়গাটা আরেকবার বল দেখিনি।”
চরম ঘনিষ্ঠ মুহূর্তকে থামিয়ে বলেছে “আক্ট পাঁচের সাত নম্বর সিনের চার নম্বর ডায়লগ এখনো মুখস্থ হয়নি মনে রাখিস।”
বিনোদ আর এ লোকটাকে মন, শরীর কিছুই নিবেদন করেনা। কেবল একরাশ ভক্তি আর শ্রদ্ধা নিয়ে সমস্ত কথা শোনে। বেদবাক্যের মতো মানে সব কথা। থিয়েটার বাদে বিনোদিনীকে কে ভালোবাসলে তাতে কিছু এসে যায়না গিরিশের। কেবল সে ভালোবাসা যদি থিয়েটারে বাধ সাধে, পাগল হয়ে ওঠে গিরিশ। আর সে ভালোবাসা যদি থিয়েটারের এতোটুকু উন্নতি সাধন করে তার দিকে ঠেলে দেয় বিনোদিনীকে। এই যেমন গুর্মুখ রায়ের দিকে ঠেলেছে তাকে। বিনোদিনীও বুঝেছে এ জগৎ সংসারে তার মতো বেবুশ্যের সাক্ষী রেখে যাওয়ার একমাত্র উপায় থিয়েটার। বিনোদ নিজেই প্রস্তাব করেছে গুর্মুখকে থিয়েটার বাড়ির নাম তার নামে রাখতে হবে। বিনোদিনী থিয়েটার হল।
সেকথা গিরিশবাবুকে বলাতে গিরিশ ঘোষের মুখ কালো হয়ে ওঠে। বিনোদিনী বুদ্ধিমতী, সে ঈর্ষার রঙ চেনে। তবু গুরুকে সে ঈশ্বর বলে মানে। এই সমস্তকে উপেক্ষা করে অনুমতি চায়। উত্তরে গিরিশ জানান
“পুরো বিনোদিনী রাখিসনে। ভদ্দরলোকেরাও তো থিয়েটার দ্যাকে নাকী? আসবে কেন তোর নামে হল হলে? গিরিশ নাট্যমঞ্চ হলে তবু এক কতা।”
কথাগুলো বলেই হাহা করে হেসে ওঠেন গিরিশ ঘোষ। বোঝাতে চান এসব মনের কথা নয়, নিছকই মজা। বিনোদিনী গিরিশের পায়ের কাছে বসে স্থির কন্ঠে বলে
“আমার শরীরের বদলে আস্ত একখানা থ্যাটার হল পাচ্ছে সকলে, তাও আমার নামে এতো ঘেন্না ভদ্দরনোকেদের!”
গিরিশ চন্দ্র কিয়দকাল চুপ থাকেন তারপর বলেন
“বি থিয়েটার রাখলে কেমন হয়?”
বিনোদিনী উত্তর করেনা। চুলের বাগান গুছিয়ে নেয়, গিরিশের পানের বাটা থেকে এক খিলি পান তুলে মুখে পোরে, পাশে রাখা পমারি শ্যাম্পেনের বোতল থেকে খানিকটা তরল ঢালে গিরিশের গেলাসে। তারপর বলে
“আজ চলি মাস্টারমশাই, মাতাখানা বড় ধরেছে”
বিনোদিনীর এই ঔদ্ধত্য আগে গিরিশ ঘোষ দেখেননি। জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিনোদ! গিরিশ মনে মনে ভাবে নতুন কাউকে তৈরী করার সময় হয়েছে। বেশিদিন কাউকে বাড়তে দিলেই মুস্কিল। ঠিক তখনই আবার ফিরে আসে বিনোদিনী। এসে বলে
“তবে ওই কতাই বলি গিয়ে, বি থিয়েটার নাম হবে। গোটা নাম না থাকুক বেবুশ্যের আদ্যক্ষরটুকু থাকুক, তাতে যদি ভদ্দরনোকেদের সমাগম বাড়ে। কি বলেন? নিশ্চিন্ত তো?”
গিরিশ ঠান্ডা গলায় উত্তর দেন।
” আমার নিশ্চিন্তির বা অশান্তির চিন্তা করিসনে বিনি। আমি স্টার মেকার বিনি। যে গড়তে জানে সে ভাঙতেও জানে। স্টার আমি তৈরী করি, নিয়ন্ত্রণও করি। সাবধানে যাস। আজ গায়ে অনেক গয়না পরিচিস।”
সেদিনের কথা সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সামান্য ভোরের আলো এসে পদ স্পর্শ করে বিনোদিনীর। বিনোদিনী ভাবে একেই বুঝি ব্রাহ্ম মুহুর্ত বলে। এমন শান্ত, গভীর পবিত্র সময়ে সময়ে ঈশ্বর চিন্তা না করে কি ভাবছে এসব সে! ভোরের নরম আলোয় চারপাশ স্পষ্ট হয় বিনোদিনীর। দেখে সেই সাধক জল থেকে উঠে আসছেন ভোরের সামান্য আলো মেখে। আলো আধাঁরীতে মনে হয় এ সাধক যেন কতকালের চেনা। কিন্তু পোশাকে তো সাধক বলে মনে হয় না। সরু পাড়ের ধুতি আর বাবু শার্ট পরা যুবক একজন। বিনোদিনীর বয়সীই হবে। একেবারে সামনে এলে মুখখানা স্পষ্ট হয়। সিমলের দত্ত বাড়ির ছোট ছেলে নরেন। মহা অহঙ্কারী ছোকরা।থ্যাটার পাড়ায় মাঝে মাঝেই ঘোরা ফেরা করে। সকলে বলে ডেঁপো নরেন। কে যেন সেদিন কইছিলে এ ছেলে ব্রেহ্ম সমাজে ঘোরা ফেরা করে। হিন্দু শাস্ত্র অস্বীকার করে। তবে সে এমন খাঁটি বামুনের মতো মন্ত্রোচ্চারণ শিখলে কোত্থেকে! মানুষ জাতটার আজব আচরণের তল পায়না বিনোদিনী। নিজেরই কি তল পায় সে!
বিনোদের পাশ দিয়ে তার দিকে একবারও না চেয়ে বেরিয়ে যায় সিমলে বাড়ির ডেঁপো ছোঁড়া। আলোয়ানে ঢাকা বিনোদিনীকে চিনতে পারেনি নির্ঘাত। নইলে বিনোদিনীকে দেখে থামবে না এমন পুরুষ এ বাংলায় নেই।
এই আত্মবিশ্বাস নিয়েই বিনোদ বাঁচে আজকাল। এই আত্মবিশ্বাস তাকে এ সময়ের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ করে তুলেছে। যার নিজের প্রতি এতো বিশ্বাস সে মেয়ে এখানেই থেমে থাকবে না সে তো জানা কথা। স্বাক্ষর রেখে যেতে হবে এ দুনিয়ায়। বি থিয়েটার বিনোদকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাস যে মহাকাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে সে পরিণত বুদ্ধি একুশের বিনোদিনীর ছিলোনা।
নরেন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার পথে বিনোদিনী খানিক চেয়ে থাকে। তারপর বিনোদ সদ্য প্রস্ফুটিত আলোতে ইতিউতি চেয়ে দ্যাখে। একটি দুটি করে লোক জমায়েত হবে এবারে।
স্পষ্ট আলো ফোটার আগে বিনোদিনীকেও রওনা হতে হবে। যেদিনই আসে তাই করে। নয়তো আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মাঝি, ধোবা, ব্যবসায়ী, ব্রাহ্মণ, গৃহবধূ, বেশ্যা সকলে জড় হয় এই ঘাটে। বিনোদ উঠে দাঁড়ালে দ্যাখে আরেক আলোয়ান জড়ানো মহিলা ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। যার প্রতিটা পদক্ষেপে দর্প আছে কিন্তু খুব লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে পা পিছলে পড়ার ভয় তার চূড়ান্ত। বিনোদিনী চিনতে পারে মহিলাকে, গোলাপ দিদি না!
বিনোদনী নাম ধরে ডাকলে মহিলা থামেন। অসামান্য সুন্দরী সেই নারী অস্ত যৌবনা বটে, তবু রূপ এতো তীব্র যে ভোরের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার উপস্থিতিতে। বিনোদিনীর সামনে এসে থামেন তিনি।
“বিনোদিনী! তুই বুঝি এমন কাগভোরে গঙা নাইতে আসিস।”
গলার মধ্যে অদ্ভুত মাদকতা সেই নারীর। সে কন্ঠস্বর এই পবিত্র ভোরেও ব্রহ্মচারীর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারে। বিনোদিনী এই গলাকে, চলাকে, বলাকে নকল করতো একদিন। কেবল বিনোদিনী কেন সমস্ত অভিনেত্রীই নকল করতো বাংলার প্রথম নায়িকা গোলাপ সুন্দরীকে। সকলেই বিনোদকে বলতো গোলাপের ছায়া। বিনোদিনী বুদ্ধিমতী, প্রতিভাময়ী, উচ্চাকাঙ্খী। কারও ছায়া হয়ে জীবন কাটাবে না সে একথা স্বাভাবিক। বিনোদিনী বলে
“রোজই আসি। রোজ চান করিনে, তোমাকে দেখিনে তো একদিনও”
গোলাপ উত্তর দেয় ” আমি নুকিয়ে আসি চিনলে লোকে বড় হামলে পড়ে”
মনে মনে হাসে বিনোদিনী। বুড়ি মাগীদের দেকলেও আজকাল লোক হামলে পড়ে। কি কাল এলো থ্যাটারের অভিনেত্রীদের। মুখে কিছু বলেনা। গোলাপ বলে
“এইখেনে ডাঁড়া। ডুব দে এসে এক সঙে ফিরবোখন। তা কিসে এয়েচিস বাড়ি থেকে?”
“বিনোদিনী বলে রোজ এ সময় হেঁটেই আসি। আমার ভালো লাগে”
গোলাপ উত্তরে বলে ” হেঁটে ফিরিসনে। আমার সঙে টমটম আচে, তাতে ফিরবি।”
বিনোদের গায়ে লাগে, মনে মনে ভাবে যতই গোলাপসুন্দরী হও তুমি, বিনোদকে গাড়ি দেকাচ্ছো। উত্তরে বলে
“হবেনা গোলাপদিদি। জানোতো, নিজের নামে থ্যাটার বাড়ি হচ্ছে। ফেরার পথে একবার তদারকিতে যাবো। তুমি বরং সেখানা দেকে আসতে পারো।”
গোলাপ মনেমনে হাসে। এসব ছেলেমানুষীর দর্প সে পেরিয়ে এসেছে। আজ সে জানে অভিনেত্রীর জীবন কী। বিনোদকে বলে
“বেশ তাই যাবো চল। দাঁড়া ডুব খানা দিয়ে আসি”
ক্রমশ…
অসাধারণ লেখা। ছবির মত। এইটে কখনও সিনেমা হতে পারে।
দারুণ!!
এই লেখাটির জন্য বসে থাকি। তারপর পড়তে পড়তে দেখি পুরনো কলকাতা, জীবন, ইতিহাস হয়ে ওঠা জীবন কাহিনী। মনে হয় হাঁটছি বিনোদিনীর পাশে, পাশে, শুনতে পেলাম তারাসুন্দরীর কান্না, স্বপ্ন, সংলাপ… মুগ্ধ হই প্রতি পর্বেই।
সত্যিই.. এমন লেখা.. যেন সব দৃশ্য এঁকে দেয়া.. অপার মুগ্ধতা…
অপূর্ব! খুব ভাল লাগল। অতীতের ঘটনা গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পরের
লিঙ্ক পাঠিয়ে দিও।
ইতিহাসের জ্বলন্ত দলিল, তাও, সমাজে অপাঙতেয় মানবীর কথা…বিষয় আর উপস্থাপন ভঙ্গি বেশ মনোজ্ঞ আর আকর্ষণীয় হয়েছে…আগ্রহ রইলো পরবর্তী পর্বের জন্য…শুভেচ্ছা রইল ❤️👌🙏খুবই ভালো লাগলো… পরবর্তী কিস্তিতে আগ্রহ রইলো… শুভেচ্ছা জানাই…
পড়ছিলাম না, দেখছিলাম মনে হল
এ-ই লেখাটি পড়ব বলে অপেক্ষা থাকে।
আলোর জন্য প্রচন্ড আকুতিটুকু। অথচ আলো ফুটলে কেউ কেউ বোঝে দিনগুলো আসলে আসে আসন্ন অন্ধকারের ইঙ্গিত নিয়ে। তবু তারা ভোরের আলোটুকুর অপেক্ষা করে—–
প্রথম আলোর মত চমৎকার লেখা। আর একবার মনখারাপ বিনোদিনীর কথা ভেবে।
অধীর অপেক্ষা পরের পর্বের জন্যে।
অসম্ভব ভালো লাগছে। লিঙ্ক টা দেবে প্রতিবার
মনে হচ্ছে চোখের সামনে ঘটনা ঘটছে….
দারুণ এগোচ্ছে, অতীত জ্যান্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে লেখায়। অনেক ধন্যবাদ লেখিকাকে।