২২ শে আগস্ট: একটি সাহসী প্রযোজনা – বিজয়কুমার দাস

পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক নারকীয় ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে। সেইসব ইতিহাস কলঙ্কের ইতিহাস। শাসকের রক্তচক্ষু, বিচারের নামে প্রহসন, প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধের নির্লজ্জ আয়োজন আসলে ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। ইতিহাসে উল্লেখিত সেইসব ঘটনা চিহ্ণিত করে রেখেছে শাসকের বিভৎস মুখগুলি। সব কালে সব দেশে মানুষ কিন্তু অত্যাচারী শাসকের জন্য জমিয়ে রেখেছে ঘৃণা আর ক্রোধ। আর প্রতিবাদী মুখগুলি সব কালেই প্রতিবাদের মন্ত্র হয়ে উঠেছে।

বেলিঘরিয়া অভিমুখের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ২২ শে আগস্ট দেখতে দেখতে এসব কথাগুলো মনে হচ্ছিল। এ নাটক তুলে এনেছে প্রায় ১০০ বছর আগের এক নির্লজ্জ ইতিহাসকে। কিন্তু এ যেন সব কালেই অতি বাস্তব এক প্রতিবাদী থিয়েটার। একটা কালো দিন। ২২ শে আগস্ট। সালটা ১৯২৭, ইতালীয় আমেরিকান অধিবাসী দুই শ্রমিককে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করেছিল আমেরিকান সরকার। নিকোলা সাক্কো আর বার্তোলোমিও ভানজেত্তি নামের সেই দুই শ্রমিক দাবি করেছিল বেঁচে থাকার জন্য এবং পেট ভরানোর জন্য ন্যূনতম রসদ কিন্তু অত্যাচারী শাসকের তা পছন্দ হয়নি।তাই সেই দুই প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে শাসকদল এক কলঙ্কিত ইতিহাসের সৃষ্টি করেছিল।

এ নাটকের চরিত্ররা উঠে এসেছে সেই ইতিহাসের পাতা থেকে। সাক্কো আর ভানজেত্তির গল্প নিয়ে এই নাটক। গল্প হলেও সত্যি। ১৯৫৩ সালে লেখা হাওয়ার্ড ফাস্ট এর উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ করেছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। নির্দেশকও তিনি। সাদা চাদরে ঢাকা দুটি চেয়ারে বসে থাকা দুটি প্রতিবাদী মানুষের গল্প শুনতে শুনতে দর্শকাসনে বসে থাকা মুগ্ধ দর্শকদের মনে হয়েছে এ গল্প তো সব দেশের অত্যাচারী শাসকদের গল্প।এখানেই এ নাটকের চূড়ান্ত সার্থকতা।

দূরন্ত টিমওয়ার্ক। পরিচালকের পরিণত ভাবনায় কিছু অনবদ্য মুহূর্ত এ নাটকের সম্পদ। পরিচালকের পরিণত ভাবনার গুণে আশ্চর্য যাদুকাঠির ছোঁয়ায় এগিয়েছে নাটকের গল্প। মঞ্চসজ্জায় অনবদ্য মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। আলোর কারুকাজ,আবহের প্রয়োগ দক্ষতা এ নাটককে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। বিরতির ঠিক আগে সমবেত প্রতিরোধের দৃশ্যে আলো – আবহের রসায়ন এক স্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে। একটি নাটককে মঞ্চে সর্বাঙ্গসুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার জন্য যেসব আনুষঙ্গিক বিষয়ে নজর দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন,এ নাটকে পরিচালক তার সব ক্ষেত্রেই উত্তীর্ণ।

মঞ্চসজ্জা, আলো, আবহ ছাড়াও মঞ্চের উপকরণ, পোশাক পরিকল্পনা সব কিছুই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন চরিত্রে প্রত্যেকটি শিল্পী কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। দলগত অভিনয় এ নাটকের সম্পদ। নাটকের শুরুতে আছে চমক। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে থেকেই শুরু হয়েছে এ নাটক। দুই জোকার চরিত্র নাটক শুরুর আগেই নাটক জমিয়েছে।আর তারপর প্রেক্ষাগৃহে একটির পর একটি দৃশ্যে সফল অভিনয়ে উন্মোচিত হয়েছে নাটকের গল্প।

সাক্কো এবং ভানজেত্তির ভূমিকায় অনুজয় চট্টোপাধ্যায় ও কল্যাণব্রত ঘোষ মজুমদার সযত্নে চরিত্র চিত্রণের দায়িত্ব পালন করেছেন।অন্যান্য চরিত্রের শিল্পীরা প্রত্যেকেই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। বলা যায়, প্রায় সবাই স্মার্ট অ্যাক্টিং করেছেন। দুই জোকার চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা গুহ,সায়ন্ত সরকার সহ অন্যান্য চরিত্রে অশোক মজুমদার,কৌশিক ঘোষ,বারীশ ভট্টাচার্য, সমিত চক্রবর্তী ,জুঁই বাগচি,সুস্মিতা বিশ্বাস,রোণিয়া রায় প্রমুখ যথোচিত দায়িত্ব পালন করেছেন। হিরণ মিত্রর মঞ্চ,উজান চট্টোপাধ্যায়ের আবহ, দীপঙ্কর দে’র আলো একশোতে একশো। নাটকের শেষেও ছিল চমক। এক সশস্ত্র মানুষ জানিয়ে দিয়েছে, নাটক শেষ। হল ফাঁকা করে দিন।
সব মিলিয়ে ২২ শে আগস্ট এক সাহসী প্রযোজনা।

One thought on “২২ শে আগস্ট: একটি সাহসী প্রযোজনা – বিজয়কুমার দাস

  1. সদ্য দেখলাম। একটি জটিল ও কঠিন উপন্যাসকে নাট্যে এনে ফেলা বড় সহজ কথা নয় তা বেশ সুচারুরূপে করেছেন এই নাট্যের নির্দেশক এবং অবশ্যই মুখ্য অভিনেতা অশোক মজুমদার। শুধুমাত্র কন্ঠের জাদুতেই তিনি সমগ্র নাট্যের চলনকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন প্রায়। আজকে নাট্যের গঠন যখন প্রায় সার্কাসকে ছুঁয়ে ফেলছে তখন এ ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রনিধাণযোগ্য।

Comments are closed.