থিয়েটারের পথে পথে – পর্ব ৫ – অভীক ভট্টাচার্য

আট

যেহেতু আমার পরিবার সরাসরি এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক সংগঠন ও সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিল সেহেতু বলা যায় জন্মের পর থেকে অথবা বোধজন্মের কাল থেকেই সমাজ, সংস্কৃতি, বহু মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। যার ফলস্বরূপ আমি কোনদিন সুখী গৃহকোণের মানুষ হয়ে থাকতে পারিনি। নানা কারণে বা অকারণে আমি সমাজ সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছি প্রতি মুহূর্তে। যার প্রভাব আজ‌ও সমানভাবে আমার মধ্যে বজায় রয়েছে। আর সেই সংযোগের কারণেই মাথায় খেলেছে নানা ধরনের কাজের পরিকল্পনা।

গত শতকের একেবারে শেষ দিকে আমাদের গ্রামের নাট্য প্রতিযোগিতার পরিচালন কমিটির সদস্য হিসেবে পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। এমন দায়িত্ব আজকের সময়ে এতটা পথ অতিক্রম করার পর সহজ মনে হলেও সেই সময়ের নিরিখে ছিল বেশ চাপের ও উৎসাহ উদ্দীপনার। ফলে গুছিয়ে কাজটা করার একটা উত্তেজনা কাজ করেছিল। তখন একটা বিষয় বারবার মাথায় ঘুরতে থাকে। এই যে আমরা নানা ধরনের শিল্পচর্চার সাথে যুক্ত। অতীত থেকে যুগ যুগ ধরে কত কত মানুষ নিজের জীবনের প্রায় অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেয় শিল্পচর্চা ও সৃষ্টির নেশায়, তার জন্য তো তাঁর বা তাঁদের পরিবার, পরিজন, আত্মীয়দের সমর্থন, ভালবাসা জড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে সেই শিল্পীর একান্ত নিজস্ব পরিবারের মানুষরা তাঁদের sacrifice নিয়ে কি কখনো কোনদিন আলোচনা, লেখালেখি বা গবেষণা হয়েছে বা হয়! সেইসব কাছের মানুষদের অবদানের বিষয়টি মাথায় ঘুরতে থাকে এবং সেবছরের হিসেবে বেছে নেই তাঁদের কথা। প্রকাশিত হ‌ওয়ার পর অনেকের মনে এমন ধারণা সামান্য হলেও প্রভাব ফেলে। এই বিষয়টি আমার মাথা থেকে আজ‌ও সরে যায়নি।

এই তো সেদিন আমার এক তথ্যচিত্র নির্মাতা বন্ধুর সাথে কথায় কথায় বিষয়টি আবার তুললাম। সেই সব মানুষেরা যারা নেপথ্যে থেকে শিল্পের সাধনক্ষেত্রের পরিসর বাঝতে সাহায্য করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে তাদের খবর কে রাখে? এ প্রশ্ন আমার শিল্পচর্চার ক্ষুদ্র জীবনে হয়তো আবার‌ও ঘুরে ফিরে আসবে। আসতে চাইবে।

নয়

গোবরডাঙ্গা অঞ্চলটি বা বৃহৎ গোবরডাঙ্গা জনপদটির নাট্যচর্চার ইতিহাস কমদিনের নয়। তবে অবশ্য‌ই বাংলার অন্যান্য জনপদের মত এই অঞ্চলেও যাত্রা সহ বিভিন্ন লোকজ শিল্পচর্চার অতীত ও গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। তথাপি সময়ের সাথে সাথে উপযোগী শিক্ষা, আধুনিক সময়ের আবহ ইত্যাদি গ্রহণে এই জনপদটি অনেকটাই এগিয়ে ছিল। সাহিত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞান, শিক্ষা, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি চর্চায় অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় গোবরডাঙ্গা জনপদে। স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক নাট্যচর্চার পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে অচিরেই। তার‌ই সমসাময়িক প্রকাশ আমরা দেখতে পাই নাট্যচর্চায়। যদিও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই চর্চার গুণাগুণ বিশ্লেষণ তর্ক সাপেক্ষ। যাই হোক, এ হেন গোবরডাঙ্গা তার নিজস্ব চর্চা ও সাধনায় ডুবে থাকলেও বৈচিত্র্যের কোন কমতি ছিল না। নানা ধরনের উপকরণ ও উপায় সংযুক্ত ছিল শিল্পচর্চায়। গোবরডাঙ্গার নাট্যচর্চার তেমন একটি উদাহরণ হল উৎসবের আবহে থিয়েটার।

গত শতকের প্রায় শেষভাগে বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গা পূজা গোবরডাঙ্গার জনপদকে করে তুলতো বর্ণময়। নানা ধরনের আয়োজনে যেমন মানুষ অংশগ্রহণ করতেন ঠিক তেমন‌ই এইসব আয়োজনে সামিল হতো নাট্যদল। আমার বা আমাদের (বিশেষত নাট্যজনদের) পূজার কটাদিন আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু ছিল গোবরডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে গোবরডাঙ্গা শিল্পায়ন-এর নাটকের তাবু বা স্টল। শিল্পায়নের নাট্যজনেরা প্যান্ডেল করে সযত্নে সাজিয়ে তুলতো সেই স্টল। যেখানে থাকতো তাঁদের নাট্য প্রযোজনার নানা ধরনের স্থিরচিত্র, পোস্টার, লিফলেট, ফোল্ডার এমনকি প্রযোজনায় ব্যবহৃত বিশেষ বিশেষ সামগ্রী (প্রপার্টি)। আর সেই সাথে নাটক সংক্রান্ত নানা ব‌ই, পত্র পত্রিকার সাথে প্রিয় শিল্পায়ন নাট্যপত্র। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করতাম, নাট্যজনেদের পাশাপাশি বহু বহু সাধারণ মানুষ ঠাকুর দেখার সাথে সাথে শিল্পায়নের স্টলে ভিড় করে শিল্পচর্চার রসাস্বাদন করতেন। সে সময় আজ অতীতের স্মৃতির পাতায় স্থান পেয়েছে। গোবরডাঙ্গার সংস্কৃতি শিল্পচর্চায় নতুন মোড় এসেছে, হয়তো অনেক উজ্জ্বল পালক যুক্ত হয়েছে তার মুকুটে কিন্তু সেই স্বপ্নরাজ্যকে বাস্তবের মাটিতে মেলে ধরার অন্যতর প্রচেষ্টা আর দেখা যায় না শারদোৎসবের আবহে। তবে বেশ কয়েক বছর পরে সাম্প্রতিক সময়ে পূজার সময় গোবরডাঙ্গা নক্‌সা’র নিজস্ব ক্ষেত্র ‘গোবরডাঙ্গা সংস্কৃতি কেন্দ্রে’র বিচিত্রা’য় এক বছর নক্‌সা’র নিজস্ব আয়োজন ও স্থিরচিত্র নিয়ে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও উপস্থিত হয়েছি উৎসাহ নিয়ে। উপভোগ করেছি নিজের মত করে। আর হাতরেছি স্মৃতির পাতা। গোবরডাঙ্গা অঞ্চলের দূর্গা পূজা এখন আকার – প্রকারে অনেকটাই বেড়েছে। বেড়েছে অর্থ ও উদ্দীপনা। কিন্তু এই উৎসবে বৃহত্তর জনমানসে গোবরডাঙ্গার নিজস্ব সংস্কৃতি-কৃষ্টি-শিল্পের প্রকাশ ও প্রভাব কতটা অগ্রগামী হয়েছে তার সময়ের আয়নায় দেখে নেওয়া যায় !

One thought on “থিয়েটারের পথে পথে – পর্ব ৫ – অভীক ভট্টাচার্য

Comments are closed.