সম্রাট আকবরের প্রাসাদে তানসেন সঙ্গীত মূর্ছনায় বৃষ্টি নামাতেন। বাংলা থিয়েটারের প্রাসাদে প্রাসাদে আলোর মূর্ছনায় বৃষ্টি নামাতেন তিনসেন – সতু সেন, তাপস সেন এবং কণিষ্ক সেন। প্রথম দুই সেন আগেই চলে গিয়েছেন ; ২২ ডিসেম্বর ২০২১ চলে গেলেন তৃতীয় সেন, কনিষ্ক! জয় সেনও নেই! বিলুপ্ত হয়ে গেল আলোর সেনবংশ! সম্ভবত শেষ হয়ে গেল আলোর মূর্ছনায় ধ্রুপদী সঙ্গীতের রাগরাগিনীর অবিশ্বাস্য আলাপ- বিস্তার।
বিষ্ণুরাত সেনের পুত্র কণিষ্ক জন্মেছিলেন ৩১ ডিসেম্বর ১৯৩৮ ; কী অপূর্ব নাম – বিষ্ণুরাত! এর আগে এমন শব্দবন্ধ শুনিনি আমরা।কণিষ্কের আলোর যাত্রা ‘সিঁড়ি’ নাটকে – সুন্দরমের জন্যে করা এবং আলোর জন্যেই পুরস্কার প্রাপ্তি। তারপরই ‘দায়ে পড়ে দারগ্রহ’ – দায়ে পড়ে আলো গ্রহণ! তিনি নিজেই বলতেন — ‘লোকে শিখে পুরস্কার পায়, আমি পুরস্কার পেয়ে শিখতে গেছি!’
সুন্দরম, নান্দীকার, সায়ক, PLT – অনেক বড় বড় নাট্যদলের আলোকশিল্পী কণিষ্ক সেন ছিলেন অন্তর্মুখী, সজ্জন এবং লাজুক প্রকৃতির মানুষ। তাঁর আচরণে কখনোই সৃষ্টি নিয়ে অহংকার কিংবা পরনিন্দা চর্চা প্রকাশ পায়নি।
তাঁর শিল্পকর্ম ছিল নিভৃত কবির সাধনা; তিনিও ছিলেন আলোর তাপস, আলোর যাদুকর। খুব কথা বলতেন না নীরবে কাজ করতেন। তাঁকে দেখেছি অনেকবার – ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য এবং দীপ্তিময় চেহারা। যথার্য ভালো মানুষ – থিয়েটারের প্রকৃত বান্ধব।
আমরা দীর্ঘকাল কয়েকজন প্রতিভাবান শিল্পীর আলোকবিন্যাস প্রত্যক্ষ করেছি। বহু নাটকেই আলো দিয়ে কবিতা লিখেছেন তাপস সেন; বাদল দাস এখনো আলো দিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারেন; কণিষ্ক সেন পারতেন আলো দিয়ে গান গাইতে… একে একে কবিতা, বৃষ্টি গান সব শেষ হয়ে, সব একাকার হয়ে বেঁচে রইলেন তানসেন। তিন সেন!
নির্বাচিত আলো । কণিষ্ক সেন
সিঁড়ি (সুন্দরম ১৯৫৮), মৃত্যুর চোখে জল (সুন্দরম ১৯৫৯), ডাকঘর (সুন্দরম ১৯৬১), ভিসুভিয়াসের মৃত্যু (সুন্দরম ১৯৬২), চার দেয়ালের গল্প (সুন্দরম ১৯৬৩), দর্পণের চোখ (সুন্দরম ১৯৬৩), পথের ডাক (সুন্দরম ১৯৬৩), হঠাৎ নবাব (সুন্দরম ১৯৬৩), অবসন্ন প্রজাপতি (ঋতায়ন ১৯৬৪), নীলকন্ঠের বিষ (সুন্দরম ১৯৬৫), হ য ব র ল (সুন্দরম ১৯৬৫), পোনুর চিঠি (সুন্দরম ১৯৬৫), সমুদ্র অতল (কথাকলি ১৯৬৭), দেশদ্রোহী (নক্ষত্র ১৯৭২), স্বদেশী নকসা (থিয়েটার কমিউন ১৯৭৪), এরিনা (ক্যালকাটা আর্ট থিয়েটার ১৯৭৪), বিবর (নেতাজি সুভাষ মঞ্চ ১৯৭৫), রক্তনদীর ধারা (রামমোহন মঞ্চ ১৯৭৬), রজনী (প্রতীক ১৯৭৬), ফুটবল (নান্দীকার ১৯৭৭), খড়ির গন্ডি (নান্দীকার ১৯৭৮), ছদ্মবেশী (রংমহল ১৯৭৮), যোগাযোগ (আর্ট থিয়েটার ক্যালকাটা ১৯৭৯), মুদ্রারাক্ষস (নান্দীকার ১৯৭৯), চা-কর দর্পণ (ভরত ১৯৭৯), দুই হুজুরের গপ্পো (সায়ক ১৯৭৯), হে সিন্ধু সারস (নান্দীকার ১৯৮০), ছদ্মবেশী (চলাচল ১৯৮০), গোরা (রঙ্গরূপা ১৯৮০), ব্যতিক্রম (নান্দীকার ১৯৮১), সাধুসঙ্গ (সায়ক ১৯৮১), ভয় (সৃজন ১৯৮১), জয়ন্তী (মহাজাতি সদন ১৯৮২), ধর্মযুদ্ধ (শপথ ১৯৮২), সোনার মাথাওয়ালা মানুষ (সায়ক ১৯৮৩),শাখা প্রশাখা (মঞ্চায়ন ১৯৮৩), হনন মেরু (নান্দীকার ১৯৮৩), মুচিরাম গুড় ( পেটেন্ট থিয়েটার ১৯৮৪), ভূশণ্ডীর মাঠে (নান্দীপট ১৯৮৫), বেওকুফ (সায়ক ১৯৯০), লাল দূর্গ (PLT ১৯৯০), জনতার আফিম (PLT ১৯৯১), ফুলবাবু (PTL ১৯৯৩), দুঃসময় (তথ্য, সংস্কৃতি বিভাগ ১৯৯৩), চিরকুমার সভা (নাট্য আকাদেমি – রবীন্দ্রভারতী ১৯৯৫), গৃহপ্রবেশ (কলাপী ১৯৯৭)…
অন্ধযুগ (পরিচালনা রতন থিয়াম), প্রিয়দর্শী (পরিচালনা রতন থিয়াম), বাহাদুর কালারিন (পরিচালনা হাবিব তনবীর), তাসের দেশ এবং শ্যামা (পরিচালনা সুচিত্রা মিত্র – বিদেশ ভ্রমণ)…
গালিলেওর জীবনও (কলকাতা নাট্যকেন্দ্র ১৯৮০ যুগ্ম আলোক বিন্যাস: কণিষ্ক সেন – তাপস সেন)