একাঙ্ক নাটিকা / শ্রুতিনাটক
রচনা- বীরবিক্রম রায়
চরিত্র – সীতা , রাম , লক্ষণ , রাবণ
(মঞ্চে দণ্ডকারণ্যের একটি পর্ণকুটিরের অংশবিশেষ দেখা যেতে পারে)
সীতা- উর্মিলা বার বার করে না করলো তখন ! বলল – “যাসনে যাসনে।” ওর কথা না শুনেই আমার আজ এই অবস্থা ! কি না বর যাচ্ছে চোদ্দ বছর বনবাসে ! সঙ্গে আমাকেও আসতে হবে, এমন মাথার দিব্যি তো কেউ দেয় নি! স্পষ্ট মনে আছে উর্মিলা বলেছিলো – “যাসনে সীতা , ওখানে বনে জঙ্গলে না আছে ভালো ওয়াশরুম, না আছে ভালো খাওয়া – দাওয়া , না ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ। বিয়ের সময় যে এতো শাড়ি গয়না পেলি সে সব পরার আর কোনো চান্সই নেই। ‘ ভাসুর তেরি গঙ্গা ময়লা হুই’ সিনেমায় মন্দাকিনী যেরকম শর্ট ড্রেস পরেছিল সেই রকম বল্কল পরে থাকতে হবে। পার্লার তো দূরের কথা মুখে মাখার সাবান, মাথায় দেবার শ্যাম্পুও পাবিনে ওখানে। যাসনে।”
শ্রুতকীর্তিটা তো মহা ফাজিল! সে বলে কি – “কলিযুগে ক্ষুদিরাম বাড় খেয়ে ফাঁসি গেছিলো আর ত্রেতা যুগে তোমার নিধিরাম তার দেখা দেখি বাড় খেয়ে বনে যাচ্ছে। তোমার নিধিরাম এই করে যদি অমর হতে চায় হোক। তাতে তোমার কি? তোমাকে বিয়ে করে এনেছে। তোমার সব দায় দায়িত্ব তার। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে সে একটা পাগলামি করলে তাতে তোমাকেও সাথ দিতে হবে!” শুধু মাণ্ডবী এমন ইমোশনাল অত্যাচার করলো সে সময় ! শুধু কানের কাছে নাগাড়ে বলে যাচ্ছে “সঙ্গে যাও সীতাদি, সঙ্গে যাও । নইলে বর কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।” আমি বলি “ঐ জঙ্গলে কে আবার আমার বরকে ধরে টানাটানি করবে” ? তখন বলে – “সে কি? জানো না ? জঙ্গলেই তো যত রাক্ষসী খোক্কসি ঘুরে বেড়ায়। সুন্দর পুরুষ দেখলেই তারা সুন্দরী মেয়ের রূপ ধরে বিভাজিকা আর নিতম্ব বার করে তাদের সামনে গিয়ে হাজির হয়। ওদের দেখলে তাবড় তাবড় দেবতারই মাথা ঘুরে যায় আর ভাশুরঠাকুর তো নেহাত ভালোমানুষ।” তখন তো বুঝিনি মাণ্ডবীর স্কিম ! ওর বর ভরত রাজা হচ্ছে। আমি যদি থেকে যাই তাহলে পাটরাণী হিসেবে ওতো আর গুরুত্ব পাবে না। তাই যেভাবেই হোক দাও সীতাকে বনে পাঠিয়ে। আমিও এমন গরু, কিছু না বুঝেই চলে এলাম এখানে।
রাম – (নেপথ্যে, একটু সুর করে ডাকে ) সীতা, সীতা , সীতা গো, সীতা গো…
সীতা – ধ্যাৎ , এই ভাবে “সীতা গো সীতা গো” বলে চেঁচালে ঠিক মনে হয় বর্ধমান লোকালে সীতাভোগ বেচছো। এ ভাবে ডাকবে না তো !
রাম – তাহলে কিভাবে ডাকবো?
সীতা- কেন? মিঃ সাগর তোমায় শিখিয়েছিলেন না ‘সিইতে ” “সিইতে” বলতে?
রাম – অযোধ্যায় থাকতে তো তাই বলতাম গো। হঠাৎ একদিন এক চ্যাংড়া অযোধ্যাবাসী আমায় সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বসলো – ” প্রভু ,আপনি আপনার ওয়াইফকে শুধু শীতেই ডাকেন? গরমে ডাকেন না ? বোঝো অবস্থা !
সীতা- আমি চিরকালই দেখেছি অযোধ্যাবাসী কে কি বললো তা নিয়ে তোমার বড্ডো মাথাব্যথা। শুধু তোমার নয়, তোমার হোল ফ্যামিলির। আমায় তুমি যখন হরধনু ভেঙে বিয়ে করে আনলে অযোধ্যাবাসী বললো ঐ মেয়ে তো নামগোত্রহীনা। কেউ কুকম্মো করে জমিতে ফেলে দিয়ে গেছিলো , জনক রাজা কুড়িয়ে পেয়ে লোকসমাজে মুখ দেখাতে একটা গল্প খাড়া করে দিয়েছে – লাঙ্গলের ফলায়।… অমুক তমুক…
রাম – আমরা তো তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনি সীতে !
সীতা- হও নি কি সাধে ? সেই সময় আমার শ্বশুরমশাই খুব পজিটিভ রোল প্লে করেছিলেন। তোমাদের অযোধ্যাবাসী তখন আমার জাত তুলে আমায় নিয়ে লাখো লাখো ট্রোল করছে। এমন ভাবে করছে যে মনে হচ্ছে ওদের কেউ পয়সা দিয়েছে এসব করতে। জাত পাত ছাড়া তারা আর কিছু বোঝে বলে তো আমার মনে হয় না। আমায় পালিত কন্যা বলে যা নয় তাই বলছে। তখন আমার শ্বশুর কিন্তু আমায় সলিড সাপোর্ট দিয়েছিলেন। তিনি তখন কারোর কোন কথা কানে নেন নি। তোমার মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ি কৌশল্যা তখন খুব চেষ্টা করেছিলেন আমার জন্ম পরিচয়ের ঠিক নেই বলে এই বিয়ে ভেঙে দিতে। কিন্তু পারেন নি শুধু তোমার বাবার জন্য। দশরথ বলেছিলেন “তাহলে সীতার স্বয়ম্বর সভায় রামের যাওয়াই উচিত হয় নি। মেয়ের পালক পিতার কথা তো তোমরা সকলেই তখন জানতে। এখন এতটা এগিয়ে গিয়ে সীতাকে ফিরিয়ে দিলে সেটা তার অপমান হয়।” কোনো মহিলার এই অপমান তিনি করতে দেবেন না।
রাম- সেটা তুমি ঠিক বলেছো। বাবা না থাকলে তখন আমাদের বিয়ে হওয়াই মুশকিল ছিল। গোটা রাজ্যবাসী একদিকে আর বাবা আরেকদিকে। কিন্তু কৈকেয়ী মায়ের বেলায় বাবা যে কেন এই দৃঢ়তা দেখাতে পারলেন না কে জানে। তাহলে আজ আর আমাদের এই দিন দেখতে হতো না।
সীতা- ভুল করছো। উনি কথা দিয়েছেন, কথা রেখেছেন। এক কথার মানুষ। মন্থরার চালাকিতে তোমাকে বনে পাঠিয়ে ভরতকে রাজা করার কৌশলের বিরুদ্ধে অযোধ্যাবাসী কিন্তু মুখরিত হয়েছিল। ভালো করে ভেবে দেখো এ ক্ষেত্রেও তিনি কৈকেয়ীর সম্মানটাই বড়ো করে দেখেছেন। মন্থরার উস্কানিতে কৈকেয়ী খারাপ বর চেয়েছেন , সেটা তাঁর দায়। উনি কথা দিয়েছিলেন বর দেবেন, খারাপ বর চাইলে বর উইথড্র করে নেবেন তা তো বলেননি। কৈকেয়ীর কথা রেখে উনি কিন্তু নিজের স্ত্রীর মর্যাদাই রক্ষা করেছেন। যেটা সব স্বামীরই করা উচিত। এ ধরনের উভয়সংকটে পড়লে তুমি যে কি করবে ভাবতেই পারছি না। যাই হোক, অযোধ্যাবাসী তো আমার বিপক্ষে ছিল বুঝলাম। কিন্তু তোমার অবস্থা কি ছিল ? তুমি কোন দিকে ছিলে মশাই?
রাম- আরে আমি তো জনকরাজার , সরি, শ্বশুরমশাইয়ের রাজসভায় তোমাকে একবার দেখেই কাত। পুরো লাভ এট ফার্স্ট সাইট। শুধু ভাবছি কিভাবে তোমায় তোলা যায়। তখন লক্ষণ এসে কানে কানে বললো হরধনু তুললে তবেই তোমায় তোলা যাবে। কিন্তু হরধনু মানে তো শিবের ধনুক। সেটা তোলা কি যা তা ব্যাপার ! আমি তো ঐ বিশাল বস্তুটা দেখেই নার্ভাস। আমার কাহিল অবস্থা দেখে লক্ষনই বুদ্ধি করে কি একটা জড়িবুটি খাওয়ালো। পরে শুনেছি ওটাকে বলে স্টেরয়েড। এই যে ব্যাটা দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে আমাদের পাহারা দেয় সেও নাকি এই স্টেরয়েডের কামাল।
সীতা- তারপর , তারপর ?
রাম- তারপর আর কি ? হরধনু তোলার আগে নিলাম এক স্টেরয়েড। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি গায়ে যেন হাতির শক্তি। এক হ্যাঁচকায় তুলে ফেললাম হরধনু। কথায় বলে না এভরিথিং ইস ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। ডোপটেস্ট থাকলে হয়তো ধরা পরে যেতাম। কিন্তু বিশ্বাস কারো সীতে ,তোমাকে পাবার এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সীতা- ও বাবা , তোমার পেটে পেটে এত ! লাভ ইউ প্রিয়ে। কিন্তু তোমার এই কীর্তির কথা যদি অযোধ্যাবাসী জানতে পারে তাহলে কি হবে?
রাম- এই এই। … আমার এই সব্বোনাশ করো না সীতে। আমার ইমেজ পুরো পাংকচার হয়ে যাবে।
সীতা- এই তুমি আর তোমার ইমেজ। আমি বিয়ের পর থেকেই দেখছি তুমি তোমার ইমেজ বিল্ডিং এ যত মন দিয়েছো বডি বিল্ডিং এ ততো মন দাও নি। দিলে আজ ডোপ করতে হতো না। অনেক ভেবে দেখেছি তুমি আমায় বিয়ে করেছো পতিতোদ্ধারিনী ইমেজ তৈরী করবে বলে। বাপের এক কথায় রাজ্যপাট ছেড়ে চলে এলে পিতৃআজ্ঞাপালনকারী ইমেজ তৈরি করবে বলে। অযোধ্যাবাসী উঠতে বললে উঠছো বসতে বললে বসছো। কেন ? না, প্রজারঞ্জক ইমেজ তৈরি করবে বলে। তুমি তোমার ইমেজ তৈরি করতে ব্যস্ত আর এদিকে লোকজন তোমার আড়ালে চুটিয়ে পলিটিক্স করে গেল। কৈকেয়ী শাশুড়িমা কায়দা করে দিলো তোমায় বনে পাঠিয়ে আর টপ করে দিলো ভরতকে সিংহাসনে বসিয়ে। আচ্ছা, যখন বনে যাচ্ছ তখন তো লালুপ্রসাদের মত এটাও বলে যেতে পারতে যে আমি যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু রাবড়ি দেবীর মত আমার বৌ সিংহাসনে বসবে!
রাম- তাই তো ! এটা তো মাথায় আসে নি। আসলে আমি চিরকালই একটু ভোলাভালা। পলিটিক্স এতো ভালো বুঝি না। তবে বাল্মীকিদাদু বলেছিল যে আমার নাম নিয়ে প্রচুর পলিটিক্স হবে এবং কলিকালে তা নাকি একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে। অযোধ্যাই নাকি হবে তার কেন্দ্রবিন্দু। সে যা হয় হবে কিন্তু সীতে , তুমি আমার ডোপ কেলেঙ্কারির কথা আবার ফাঁস করে দিও না প্রিয়ে।
সীতা- দেব না , তবে একটা শর্তে।
রাম- কি শর্ত ? বলো বলো। এখুনি তোমার জন্য সুপুষ্ট কলা, সুমিষ্ট আপেল, টসটসে আঙ্গুর, কচি মোচা – থোড়- শাক-পাতা —
সীতা- ধুর ছাতা , তোমার হবিষ্যির পথ্য কে চেয়েছে? এসব তো লক্ষণ রোজই আনছে থলে ভরে ভরে !
রাম- তাহলে তোমার কি শর্ত বলো প্রিয়ে ?
সীতা- আমার সোনার হরিণ চাই…
রাম- ঠিক আছে, গাইছি। খুব একটা সুরে লাগবে না , তাও , এই যদি তোমার শর্ত হয় তবে গাইছি। তোরা যে যা বলিস ভাই…তোরা যে যা বলিস ভাই …(ভাই শব্দটা একটু খেলিয়ে গাইবে )
সীতা- দুচ্ছাই। এরকম ভাই ভাই বলে চেঁচালে এখুনি লক্ষণ আবার উড়ে এসে পড়বে। চুপ করো। এমনিতেই তো তোমার ভাইয়ের প্রহরার চোটে স্বামী স্ত্রীতে দুদণ্ড কথা কওয়ার ও যো নেই। বাকি সব তো ছেড়েই দাও। আমি কি তোমায় গান গাইতে বলেছি? বেসুরো কোথাকার!
রাম- গান গাইতে বলোনি? এই যে বললে আমার সোনার হরিণ চাই গাইতে?
সীতা- এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি অযোধ্যা শাসন করতে? ভালোই হয়েছে তোমায় খেদিয়ে দিয়েছে।
রাম- রাগ করো না প্রিয়ে। বলো তোমার কি চাই?
সীতা- কদিন ধরেই দেখছি আমাদের কুটিরের আশে পাশে একটা সোনার হরিণ ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। ওটা ধরে এনে দাও।
রাম- হরিণ আবার সোনার হয় না কি ? তুমি ভুল দেখেছো। কিছু মনে করো না প্রিয়ে, এ বছর ধনতরাসে তোমায় সোনার গয়না কিনে দিতে পারিনি তো তাই তুমি সোনার হরিণ দেখেছো।
সীতা- আমি তো তোমার মত গাড়োল নই যে এই দণ্ডাকারণ্যে পি সি চন্দ্র খুঁজবো ? যাও , ধরে নিয়ে এস। এখনো বেশি দূর যায় নি ওটা। যদি সোনার হয় ভেঙে গয়না পাতি গড়িয়ে নেবো। আর যদি সোনার নাই হয় তাহলেও তো তোমার এই কচু ঘেঁচু খাবার হাত থেকে মুক্তি মিলবে দুএকদিন। যাও।
রাম- যাচ্ছি গো যাচ্ছি। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। এই খাটো ধুতি পরে ছুটতে গেলেই বারে বারে খুলে যায়। আর চারপাশে যা রাক্ষস খোক্কসের উপদ্রব। লক্ষণকে ডেকে দিয়ে যাই, একটু নজর রাখুক। লক্ষণ , ভাই লক্ষণ। …
(লক্ষণের প্রবেশ)
লক্ষণ- বলো দাদা, হুকুম করো।
রাম- আমি কি হুকুম করার মালিক? তোর বৌদি বলছেন সোনার হরিণ ধরে আনতে। তাই আমি যাচ্ছি। তুই এদিকটায় একটু নজর রাখিস ভাই।
লক্ষণ- তুমি কোন টেনশন নিও না দাদা, আমি আছি। (রামের প্রস্থান)
সীতা- কেন আছো? আছো কেন?
লক্ষণ- মানে?
সীতা- মানে হলো বনবাস তো হয়েছিল তোমার দাদার। তোমার তো হয় নি। তাহলে তুমি অযোধ্যার লাক্সারি ছেড়ে এই বনে বাদাড়ে কেন পড়ে আছো ?
লক্ষণ- মাতৃসত্য পালনের জন্য।
সীতা- ঠিক বুঝলাম না।
লক্ষণ- দেখো বৌদি, দাদা বাবার কথা অর্থাৎ পিতৃসত্য পালনের জন্য যখন বনে যাচ্ছে তখন আমায় সুমিত্রা মাতা ডেকে বললেন যাও লক্ষণ, তুমিও সঙ্গে যাও। আমি মাকে বললাম ” আমি বনে গেলে তোমার দেখাশোনা কে করবে ? তোমার বয়স হচ্ছে।” তো মা বললেন ” কেন, শত্রুঘ্ন আছে না ? সেই দেখবে।” তাই আমি মাতৃসত্য পালনের জন্য বনে চলে এলাম।
সীতা – সে ভালো করেছো। তোমার সাথে গল্প গুজবে আমার তো বেশ সময়টা কেটে যায় , নইলে যে কি বোর হতাম। আসলে আমার খারাপ লাগে ঊর্মিলাটার জন্য। সদ্য সদ্য বিয়ে হয়ে এলো আর বর হাওয়া ! তাও এক আধ বছরের জন্য নয়, চোদ্দ বছর! বর যখন ফিরে আসবে তখন দেখা যাবে সে বুড়ো হয়ে গ্যাছে। আর আমাদের দেশে বৃদ্ধ বর তো একটা লায়াবিলিটি ছাড়া কিছুই নয়।
লক্ষণ- উর্মিলাকে আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম বৌদি যখন যাচ্ছে তখন তুমিও আমার সাথে চলো। বেশ পিকনিক পিকনিক লাগবে। শুনে সে বললো ” চোদ্দ বছর ধরে পিকনিক? রোজ অমৃত খাওয়ালে তাতেও অরুচি আসে, তখন চানাচুর খেতে মন চায়। তোমার পেয়ারের দাদা বৌদির সঙ্গে তুমি পিকনিক করো চোদ্দ বছর ধরে, আমায় ওসবে টেনো না।” কিন্তু আজ এখানে উর্মিলা থাকলে এই অঘটন ঘটতোনা বৌদি।
সীতা- কি অঘটন ঘটায়েছো দেবর লক্ষণ ?
লক্ষণ- ইয়ার্কি মেরো না তো বৌদি। ঘটনাটা শুনলে তোমার পিলে চমকে যাবে। দাদা ছিল বলে এতক্ষণ বলতেও পারছিলাম না।
সীতা- সে কি গো ! ইন্টারেষ্টিং স্টোরি। সাসপেন্স থ্রিলার মনে হচ্ছে।
লক্ষণ- আরে শোনো না। কাল দুপুর নাগাদ তোমরা তো খেয়ে দিয়ে ভাত ঘুম দিচ্ছো। তখন আমি ভোজালিটা নিয়ে একটু বেরোলাম কলা- থোড় -মোচা কেটে আনবো বলে। দক্ষিণ দিকটায় একটু গহীন বনে ঢুকেছি , হঠাৎ করে যেন মাটি ফুঁড়ে সামনে হাজির হলো এক অপরূপ সুন্দরী নারী। আমার বিহ্বল ভাব কেটে যাবার আগেই সে বলে উঠলো – ” অনেকদিন ধরেই তোমায় ফলো করছি ডার্লিং। কিন্তু তোমার সাথে আরেকটা “… না থাক, বলবো না।
সীতা- ফুটেজ খেও না তো , শিগগির বলে ফেলো।
লক্ষণ- আরে, ফুটেজ খাচ্ছি না… দাদার সম্বন্ধে একটা বাজে কথা বললো, কি করে তোমায় বলি সেটা?
সীতা- বলবে না কানমলা খাবে?
লক্ষণ- বললো ” তোমার সাথে একটা ক্যাবলা মতো লোক থাকে সে আজ নেই বলে তোমার কাছে আসতে পেরেছি আমার প্রেম নিবেদন করতে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি ওই ক্যাবলাটার বৌ আছে। তোমার নেই। উইল ইউ ম্যারি মি ?”
সীতা- এতো অ্যাডভান্সড? প্রথম দেখাতেই প্রেম নিবেদন ও বিয়ের প্রস্তাব ? মেয়েটিকে তো দেখতে হচ্ছে ভাই লক্ষণ।
লক্ষণ- ওদের জাতে নাকি এরকমই হয়। ধর তক্তা মার পেরেক।
সীতা- আমার তো মনে হয় মেয়েদের দুটোই জাত হয় – সুন্দর আর কুৎসিৎ। তুমি তো বললে মেয়েটা সুন্দরী, তাহলে বুঝলে কি করে অন্য জাতের ?
লক্ষণ- আরে সেটাই তো বলছি। ঐ সুন্দরী মেয়েটা যখন আমায় ছুঁয়ে ফেলবো ফেলবো করছে তখন আমি বললাম -” তুমি ভুল করছো। আমি বিবাহিত। ” শুনে সে মেয়ে বলে কি ” তাতে কি? তোমার বাবারও তো তিনটে বিয়ে। ওতে কোনো দোষ নেই “- বলেই দেখি আমায় জড়িয়ে ধরে …
সীতা- ঠিক আছে ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। তা, তুমি কি করলে?
লক্ষণ- মেয়েটার মুখে পুরো বিড়ির গন্ধ গো বৌদি। আমি যেই ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে দিলাম, হঠাৎ করে দেখি প্রচন্ড চিৎকার করে ঐ সুন্দরী মহিলার দেহের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এক বিকটদর্শণা রাক্ষসী। এতোক্ষণ আমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করবে বলে ক্যামোফ্লাজ করছিলো আর কি। তুমি তো জানোই রাক্ষস জাত বিভিন্ন রূপ ধরতে পারে। বিরাট সব দাঁত নখ বার করে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে এমন বিকট চিৎকার করতে লাগলো ওদের ভাষায় যে কিস্যু বুঝতে পারলাম না শুধু এই তিনটে শব্দ ছাড়া – মানিকে মাগে হিতে। ওর চিৎকারে গাছ থেকে পাখিরা পটাপট মাটিতে পড়ে যেতে লাগলো , হরিণগুলো সব তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে পগার পার। …
সীতা- সে কি? তাহলে যে আমি দেখলাম আমাদের কুটিরের আশেপাশে একটা সোনার হরিণ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।
লক্ষণ- পাগল না কি ? এই অঞ্চলের ত্রিসীমানায় আর কোনও হরিণ পক্ষকালের মধ্যে দেখা যাবে না এমন চেঁচান চেঁচালো। আর শুধু কি চিৎকার? হাতের কুলোর মতো নখ দিয়ে গাছের ছাল আঁচড়ে , মাটি উপড়ে এমন একটা ম্যাডাগাস্কার কান্ড করলো সে আর কহতব্য নয়। যত আমি বলি ” এমন করিস নি পাগলি , হাতের নখগুলো উপড়ে যাবে রে , ততই চেঁচায় আর বলে ” সূর্পনখা , সূর্পনখা। ”
সীতা- হয় প্রেমে বাধা পেয়ে খেপে গেছে নইলে ওই মেয়েটার, মানে, রাক্ষসীটার নাম সূর্পনখা।
লক্ষণ- গোরিলাদের মতো নিজের বুকে কিল মেরে মেরে যখন সূর্পনখা , সূর্পনখা বলে চেঁচাচ্ছিলো তখন ওটাই ওর নাম হবে।
সীতা- তারপর, তারপর কি হলো?
লক্ষণ- তারপরই তো ঘটলো অঘটন। সেই দামড়া চেহারার রাক্ষসীটা হঠাৎ করে উড়ে উড়ে আমার দিকে ধেয়ে এলো। আমি তো আত্মরক্ষার জন্য কোমর থেকে ভোজালিটা বার করে হাতে নিয়ে নিয়েছি। প্রবল ধস্তাধস্তির মধ্যে ভোজালিটা লেগে রাক্ষসীটার নাকটা কেটে গেল। এতে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়ে রাক্ষসীটা ‘রা ওয়ান রা ওয়ান’ বলে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে গেলো।
সীতা- শাহরুখ খান ! আমি দেখবো।
লক্ষণ- এখানে আর কোথায় কিভাবে দেখবে বৌদি ? একেবারে অযোধ্যায় ফিরেই দেখো। অবশ্য ততদিনে যদি থাকে। এই ভদ্রলোকের একটা ছবিও তো এখন তিনদিনের বেশি চলে না।
সীতা- চোদ্দ বছরের মধ্যে সবে তো একটা বছর কাটলো। এ জন্মে কি আর কিছু দেখতে পাবো ভাই ?
লক্ষণ- না গো বৌদি, জেলে থাকাকালীন ভালো ব্যবহার করলে যেমন সাজা কমে যায় তেমনি আমাদের বনবাসের মেয়াদও কমতে পারে বলে শুনছি। আমার যে গুপ্তচর অযোধ্যার সব খবরাখবর আমায় এনে এনে দেয় সেই খবর দিলো, পিতাশ্রী নাকি খুব অসুস্থ। অযোধ্যাবাসী কৈকেয়ী মায়ের এই অন্যায় ব্যবহারের বিরুদ্ধে নাকি তলে তলে বিদ্রোহের ফন্দি আঁটছে। খুব সম্ভব পাবলিক প্রেসারে আমাদের বনবাসের মেয়াদ কমে যাবে আর আমরাও অযোধ্যায় ফিরতে পারবো।
সীতা- তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। কিন্তু তুমি যে বললে এ তল্লাটে আর কোনো হরিণ নেই , তাহলে যে আমি তোমার দাদাকে সোনার হরিণ ধরতে পাঠালাম!
লক্ষণ- তাই তো, দাদা এমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো যে আমার মাথাতেও আসে নি। তুমি ঠিক দেখেছিলে ওটা সোনার হরিণ- ই ছিল ?
সীতা- আরে বাবা, হ্যাঁ। ঠিক দেখেছি। কিন্তু তুমি বলার পর এখন মনে হচ্ছে হরিণটা আবার কোনো ছদ্মবেশী রাক্ষস খোক্ষস নয় তো !
লক্ষণ- এই মরেছে। আমি এখুনি যাচ্ছি দাদার খোঁজে। কিন্তু তুমি পর্ণকুটির ছেড়ে কোথাও বেরিও না। অবশ্য কুটিরের দরজার যা অবস্থা এক লাথি মারলেই ভেঙে যাবে। এক কাজ করি, একটা লক্ষণরেখা টেনে দিয়ে যাই। তাহলে কেউ আর ভিতরে ঢুকতে পারবে না। রাক্ষসদের যা উপদ্রব।
সীতা- আরে লক্ষণরেখায় আজকাল আরশোলাও মরে না। ওতে কি হবে ?
লক্ষণ- তোমায় বলা হয় নি বৌদি আমি মাতৃসত্য পালনের রিওয়ার্ড হিসেবে অলংঘ্যরেখা বর পেয়েছি। আমার টানা রেখা দেবদৈত্য দানব কেউ লংঘন করতে পারবে না।
সীতা- তাহলে সুর্পনখা যখন তোমার দিকে ধেয়ে এলো তখন ওর নাকটা না কেটে একটা লক্ষণরেখা কাটলেই তো পারতে ।
লক্ষণ- মহিলা রাক্ষসদের প্রতি এটা প্রযোজ্য নয়। আর সত্যি কথা বলতে কি রেখা টেনে মহিলাদের কে কবে আটকাতে পেরেছে? তালিবানরাই পারছে না !
সীতা- তোমার জেন্ডার স্টেটমেন্ট ছেড়ে রেখা- জয়া কি টানবে টেনে এক্ষুণি বেরোও। তোমার দাদা যা আতাকেলানে। কোথায় কোন গোল পাকাবে কে জানে? আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে।
লক্ষণ- এই। … (রেখা টেনে দিলো) রেখা টেনে দিলাম। তুমি এর বাইরে বেরিও না কিন্তু।
(লক্ষণের প্রস্থান)
(সন্ন্যাসী বেশে রাবণের প্রবেশ)
সীতা- যাই, সেদ্ধভাত চাপিয়ে দিই। … (চলে যেতে যেতে)
রাবন- ও ননদি , আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে। …
সীতা- কে বললো? কে ? কে তুমি ?
রাবন- ভিক্ষান দেহি।
সীতা- এখুনি পাতি বাংলায় কথা বলে আবার খটোমটো সংস্কৃত বলছো কেন ?
রাবন- সাধু সন্ন্যাসীদের সংস্কৃত বলাই দস্তুর। ওতে গ্ল্যামার বাড়ে। ভিক্ষান দেহি।
সীতা- গ্ল্যামার যে বাড়ে নি তা তো বোঝাই যাচ্ছে। এতো ছাইভস্ম মেখেছো তাও ঐ তোমার ঐ ভুষোকালির মতো গায়ের রং ঢাকতে পারো নি। আর কি মোষের মতো চেহারা রে বাবা !
রাবন- ভস্ম করে দেব। বডি শেমিং চলবে না এই বলে দিলাম।
সীতা- সরি বাবা। দেখো বাবা, বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই, তুমি আগে দেখো।
রাবন- আগে পিছে দেখেই তো এসেছি।
সীতা- তার মানে?
রাবন- ওরে বাবা, এই ফেমিনিজম-র যুগে কেউ কি পুরুষ মানুষের পরোয়া করে? তাও সামান্য ভিক্ষা দেবার জন্য?
সীতা- দেখো বাবা, ফেমিনিজম- র এটাই তো সুবিধা। যখন নিজে কিছু পারবো না তখন পুরুষদের নামে চালিয়ে দাও। যাই হোক, আমার বারণ আছে বাবা। তুমি আগে দেখো।
রাবন- এতদঞ্চলে ভিক্ষা দেবার আর কেউ নেই রে। আর একজন সতীসাধ্বী গৃহলক্ষী হয়ে তুই কি চাস একজন সন্ন্যাসী অনাহারে প্রাণত্যাগ করুক?
সীতা- ইমোশনাল অত্যাচার করো না বাবা। ঠিক আছে, ঘরে যা আছে আমি নিয়ে আসছি। তুমি ওখানটায় একটু দাঁড়াও ।
রাবন- শিগগির নিয়ে আয়। পেটে খিদের চোটে এমন আগুন জ্বলছে যে নিজেই ভস্ম হয়ে যাবো বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা মুখ তো নয়, দশটা মুখ যেন একযোগে খাবার চাইছে, এমন… এমন ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে ! কিন্তু তুই আমাকে কি দিবি ?
সীতা- কি আর দিতে পারি বাবা? চাল ডাল আলু আর ফলমূল ছাড়া তো আর আমাদের ঘরে দেবার মতো কিছু থাকে না বাবা।
রাবন- আমার নিজেরই কোনো চালচুলো নেই তো তোর দেওয়া এই চাল ডাল আলু আমি সেদ্ধ করবো কোথায় ?
সীতা- তাও তো বটে ! তাহলে এক কাজ করি। চট করে আমি ভাতটা চাপিয়ে দিয়ে আসি। তুমি ততক্ষণ এই আসনে বসে একটু ধ্যান ট্যান করো। আমি যাবো আর আসবো। গরম গরম ভাত খেয়ে নাও বরং।
রাবন- খাসা ! গরম ভাত ? গরু পাওয়া যাবে?
সীতা- গরু? কি বলছো গো সন্ন্যাসী ঠাকুর ?
রাবন- খিদের চোটে কি ভাবছি আর মুখ দিয়ে কি বেরোচ্ছে? গরুর দুধের ঘি পাওয়া যাবে কি না জানতে চাইছিলাম আর কি ?
সীতা- দেখতে হবে ভাঁড়ার খুঁজে। দেখো ঠাকুর, আমাদের কি এখন এই অবস্থা আছে যে দুধ দিয়ে নাইব আর ঘিয়ে নাও বাইব?
রাবন- ঠিক ধরেছি। তোকে দেখেই আমি আন্দাজ করেছি যে তোরা বনেদি বনবাসী নোস্। যেমন গায়ের রং তেমনি ফিগার ! এ জিনিস কি আর গাছে ফলে? যাই বলিস না কেন, তোর কিন্তু বনে থাকা মানায় না।
সীতা- আমার মানানো না মানানোতে কার কি এসে গেলো ? আমার এমন কপাল যে রাজার ঘরে বিয়ে হয়েও বনে এসে থাকতে হচ্ছে।
রাবন- আমারও এমন কপাল যে রাজা হয়েও ভিখারি হয়ে ঘুরতে হচ্ছে।
সীতা- ঠিক ধরেছি। তোমায় দেখেই আমি বুঝে গেছি তুমিও বনেদি সাধু নও।
রাবন- সে কি রে ! যতবড় মুখ নয় ততোবড়ো কথা ? তোকে এমন অভিশাপ দেব …
সীতা- দাও না, দাও অভিশাপ। তোমারি খাওয়া জুটবে না। আর আমায় নতুন করে কি অভিশাপ দেবে গো. আমি তো জন্ম থেকেই অভিশপ্ত।
রাবন- আহা হা, এখন আর পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসিস না যেন। এমনিতেই খিদেয় আমার নাড়ি ভুড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুই কি করে বুঝলি আমি বনেদি সন্ন্যাসী নই ?
সীতা- সিম্পল, বনেদি সাধুরা এরকম খাই খাই করে না।
রাবন- আহা , খিদে পেয়েছে তো, কতোটা দূর থেকে জার্নি করে এলাম সেটা বল। আর আমার তো সকলের মতো একটা মুখ না। …
সীতা- তার মানে?
রাবন- আমরা বহুমুখী প্রতিভা । আমরা সাধু সন্ন্যাসীরা এরকম অনেক গভীর গভীর কথা বলি। আমরা অনেক লেখা পড়া করেছি তো। আমাদের সব কথা তোরা অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরা বুঝবি না। এবার বল আমার আর কোন জিনিসটা দেখে তোর মনে হলো আমি বনেদি সাধু নই ? (দাড়ি টেনে টুনে দেখে ) দাড়ি টারি তো ঠিকই আছে !
সীতা- বনেদি সাধু মুনিরা সব সংস্কৃতে কথা বলে। আমার শ্বশুরবাড়িতে দেখেছি। কিছু মনে করো না বাবা তুমি ওই একটি ছাড়া আর কোনো সংস্কৃত বলো নি।
রাবন- কি ? আমি সংস্কৃত জানি না ? তবে শোন্- বিশেষ্যস্য হি জল্লিঙ্গ বিভক্তি বচনে চ যে তানি সর্বানী যোয্যানী বিশেষণ পদেষয়পি মা কুরু জনধনযৌবনগর্বম স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে সর্প ক্রুর খল ত্রুর সর্পাৎ ক্রুরতর খল অতিদর্পে হতা লঙ্কা (একনিঃশ্বাসে বলে হাঁফিয়ে ওঠে ) এই যা :
সীতা- কি হলো ঠাকুর?
রাবন- লংকা আমি বড় ভালোবাসি। লংকাই আমার সব। তাই লংকার কথায় জিভে জল এসে গেলো।
সীতা- এ মা, দেখো আমি কেমন বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার সাথে গল্পে মজে গেছি। আমি ভাতটা চাপিয়ে দিয়ে এক্ষুণি আসছি।
( সীতার প্রস্থান)
রাবণ- (অট্টহাস্য) আমি রাবণ। স্বর্ণলংকা থেকে উড়ে এসেছি সীতাকে অপহরণ করবো বলে। আর এই ঠ্যাটা মেয়েটা শুধু একথা সেকথা বলে টাইম পাস্ করছে যদি এই ফাঁকে রাম লক্ষণ এসে হাজির হয়। আরে মূর্খ মানবী, আমার স্কিম বোঝার মতো ক্ষমতা কি তোদের মতো ক্ষুদ্র মানবের আছে? আমার দেশে পি সি সরকার মারিচকে পাঠিয়েছি সোনার হরিণের রূপ ধরে রামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অনেকদূর নিয়ে যাবে। আর তার পিছু পিছু লক্ষণ গিয়ে দুজনেই গভীর বনে হারিয়ে যাবে। এই ফাঁকে আমি সীতাকে নিয়ে পগার পার। হা হা হা ( অট্টহাস্য)
(সীতা প্রবেশ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে )
সীতা- ও ঠাকুর, তুমি এমন পাগলের মতো হাসছো কেন?
রাবণ- খিদে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। তোর হাতে ওগুলো কি ? দে… দে…
সীতা- সামান্য ফলমূল বাবা। ভাত বসিয়ে এসেছি। এক্ষুণি হয়ে যাবে। ততক্ষণ তুমি এগুলো খাও..
রাবণ- উজ্জ্বল যোজনায় গ্যাস পেয়েছিস নাকি ?
সীতা- নানা, ওসব ঢপ । আমি শুকনো কাঠ কুটো দিয়েই রান্না করি। আমার দেবর লক্ষণ ওসব কাটায় খুব ওস্তাদ।
রাবণ- সে তো দেখতেই পেলাম। সে তো সব কাটাতেই ওস্তাদ ! কি বিশ্রী ভাবে কেটেছে ! চোখে দেখা যায় না।
সীতা- ও ঠাকুর, খিদের চোটে তুমি আবার প্রলাপ বকছো । এই নাও আপেল, ক্যাচ।
রাবণ- কেন? একটু এগিয়ে এসে আমার হাতে দিলে কি তুই অস্পৃশ্য হয়ে যাবি? আমি কি দলিত ?
সীতা- কিছু মনে করো না ঠাকুর, এই রেখার বাইরে আমি যেতে পারবো না। আমার দেবর বলে গেছে এর নাম লক্ষণরেখা। আর বাইরে আমিও বেরোতে পারবো না তুমিও ঢুকতে পারবে না।
রাবণ- বাহ্, বেশ তো। ইলেকশন- র আগে এটা চালু করলে ভালো হতো। তাহলে কেউ আর দলবদলু হতে পারতো না। কিন্তু দূর থেকে ভিক্ষা ছুড়ে দিয়ে তুই কি আমাকে অপমান করতে চাস ?
সীতা- রাগ করো না ঠাকুর , ছোটবেলায় বল নিয়ে লোফালুফি খেলো নি ? জন্ম থেকেই তো তুমি সন্ন্যাসী নও। নাও ধর, ক্যাচ কট কট।
রাবণ – আরে ক্যাচ করবো বলেই তো এসেছি। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে বলা আছে ছুড়ে দেওয়া ভিক্ষা নিতে নেই। কাছে এসে ভক্তিভরে দিলে তবেই নিতে হয়। তবেই সন্ন্যাসী তৃপ্ত হয় আর গৃহীর মঙ্গল হয়। স্বামী পুত্রের মঙ্গল হয়।
সীতা- ভারতীয় নারীকে ঐ একটি কথা বলেই কাত করে দেওয়া যায়। স্বামী পুত্রের মঙ্গল হবে। তবে তুমি যা ঝড়ের গতিতে সংস্কৃত বললে তাতে মনে হচ্ছে তুমি জেনুইন সন্ন্যাসী । রাজনীতি করা সন্ন্যাসীদের মতো ফেকু নও।
রাবন- ফেবু শুনেছি ,শুনছি এতে লোকে শৌচকর্মের ছবিও দিচ্ছে। কিন্তু ফেকু তো কোনোদিন শুনিনি !
সীতা- আরে ফেকু মানে হচ্ছে লোককে বড়ো বড়ো কথা বলে বোকা বানানো। সোজা বাংলায় যাকে জুমলা বলে গো। সে যাই হোক, শোন ঠাকুর, আমি কিন্তু এক পা বাইরে আর এক পা ভিতরে রাখবো।
রাবন- এ কি কুমিরডাঙ্গা খেলা হচ্ছে নাকি ? এক পা ভিতরে রাখলে পুণ্যও হাফ হয়ে যাবে বলে দিলাম । মনে রাখিস তোর বর আর দেবর দুজনেই বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের একজনের যদি কোনো অমঙ্গল হয়ে যায়…
সীতা- ওরকম বোলো না ঠাকুর। এই নাও, আমি বাইরে বেরিয়েই এলাম। আমার প্রিয়জনদের কারোর যেন কোনো অমঙ্গল না হয় ঠাকুর।
(রাবন সীতার হাত ধরে )
এ কি ! তুমি আমার হাত ধরলে কেন ? কে তুমি? আমার হাত ছাড়ো !
রাবণ- (অট্টহাস্য ) আমি রাবণ। রাক্ষসদেশ স্বর্ণলংকার রাজা আমি। তোকে অপহরণ করে লংকায় নিয়ে যাবার জন্য আমি এখানে সাধুর বেশ ধরে এসেছি।
সীতা- তখনি ঠিক আন্দাজ করেছিলাম দেশের অধিকাংশ সাধুর মতোই তুমিও ভন্ড। কিন্তু তুমি আমাকে ধরেছো কেন ? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি ?
রাবণ- তোর দেবর লক্ষণ আমার বোন সূর্পনখার নাক কেটে আমার গোটা রাক্ষস জাতির অপমান করেছে। আমি তার বদলা চাই।
সীতা- তাহলে লক্ষণকে ধরো, আমায় ধরেছো কেন ?
রাবণ- রাজনীতি। তোকে ধরার পিছনে অনেক গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে। পুরোটা আমিও জানি না। আর আমাদের মতো লোকেদের জানার কথাও নয়। তবু যেটুকু বুঝতে পারছি তা হলো এর পুরোটাই একটা স্ক্রিপ্ট। তাতে আমি, তুই, তোর বর , লক্ষণ, সুর্পনখা, মারিচ সবাই কুশীলব মাত্র। তোকে নিয়ে আমায় এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে যেখান থেকে তোর বর খুঁজে বার করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে অনেক সময় লাগে আর অনেক ঘটনা ঘটে । তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পর তোর বর হয়ে উঠবে একজন হিরো। তার নামে জয় জয়কার হবে। কিছু মানুষ তার নামে মন্দির বানাবে। তাকে সামনে রেখে বিধর্মীদের মারবে, কাটবে কিন্তু এখনো সে যেমন কিছু করতে পারছে না তখনও কিছুই করতে পারবে না সে। কিছু ধান্ধাবাজ মানুষের হাতের পুতুল হয়ে শুধু সোনার সিংহাসনে বিরাজ করবে। মহাভারতের যুদ্ধ, যাতে গোটা দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক শেষ হয়ে গেছিলো, সেই যুদ্ধেও সবথেকে বেশি ভুগতে হয়েছিল দ্রৌপদীকে। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো তুইও এই নাটকে শুধু একটা বোড়ে ছাড়া কিছুই নোস্। ভুগতে তোকেও হবে।
সীতা- আমি বিশ্বাস করি না।
রাবণ- তোর বিশ্বাস অবিশ্বাসে রাজনীতির পাশাখেলা পাল্টায় না।
সীতা- তোমাদের দিয়ে এই নোংরা কাজ কে করাচ্ছে ?
রাবণ- তার কোনো মুখ নেই। থাকলেও আমরা জানিনা। আমাদের জানতে দেওয়া হয় না। সে কখনো রাষ্ট্রের নেতা কখনো বিশ্বের ধনকুবের। সে তোর আমার সবার জীবন মরণ সব নিয়ন্ত্রণ করে। আমার মতো এরকম অনেক এজেন্সি তার কথায় ওঠে বসে। সে শুধু আড়াল থেকে আদেশ দেয় – বিষ ছড়াও , বিষ ছড়াও। যখন আমরা তাকে প্রকট হতে দেখি তখন সে আমার মতো সাধুপুরুষের ভেক ধারণ করে মনের কথা বলে, বন্ধু বলে ডাকে সকলকে।
সীতা- তুমি কেন তার কথা শোনো?
রাবণ – আমি রাক্ষস। আমি ক্লেদ, ঘৃণা, হিংসা, তমসা , আমি পুতিগন্ধময় নরক। যুগে- যুগে, কালে- কালে আমি- ই ভিন্ন ভিন্ন নামে নারকীয় রূপে অবতীর্ণ হই । আমি- ই জটাসুর , আমিই বকাসুর , আমিই মহিষাসুর। আমিই কবন্ধ, আমিই কালিয় , আমিই হিরণ্যকশিপু। আমিই শহরে- গঞ্জে- গ্রামে- গলিতে -বাজারে- ঠেকে হাতকাটা হাবু, কানকাটা কালু, বোম মারা বুক্কা, ছুরিমারা ছেনো । আমি রাজনীতির সাথে সাথে রং পাল্টাই । আমার বলের কোনো শেষ নেই, ছলের কোনো অভাব নেই, নলের কোনো দিশা নেই। আমার কোনো নীতি নেই, রীতি নেই, ইতি নেই। আমাকে সৃষ্টি করেই ব্রহ্মা আমার বীভৎস রূপ দেখে আঁতকে উঠে চিৎকার করে বলেছিলেন – রক্ষাম। সেই থেকে আমার নাম রাক্ষস। আমি ততদিন থাকবো যতদিন রাজনীতি থাকবে। যতদিন রাজনীতির পাশাখেলা থাকবে, যতদিন আড়াল থেকে রাজনীতির দুষ্টচক্রীরা দড়ি টেনে টেনে আমাদের দিয়ে নোংরা কাজ করাবে আমি ততদিন থাকবো। আমরা ততদিন থাকবো।
সমাপ্ত
দারুণ একটি প্যারোডি নাটক লিখেছেন নাট্যকার।হাসতে হাসতে পুরাণ কে সমসাময়িক করে তুলেছেন।