সালটা ছিল ২০১২, আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে মানে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের এই সময়টা ছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্লারা কাউন্টির EL THEATRO CAMPESINO আর্ট সেন্টার হলে। ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে Shakespeare এর RICHARD THE THIRD অভিনয় করানোর জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। টানা মাস দেড়েক রিহার্সালের পর অভিনীত হয়েছিল সে নাটক।অভিনয়ের শেষে যখন আমাকে সম্মানটম্মান জানানোর পর্ব শুরু হলো,তখন ঘোষক মঞ্চে ডাকলেন একজনকে। ঘোষণা বললেন — “আজ আমাদের মধ্যে আছেন ক্যালিফোর্নিয়ার সম্মানীয় প্রাক্তন গভর্নর।ভিনদেশী নির্দেশকের হাতে স্মারক তুলে দেবার জন্য আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”
দেখলাম সামনের রো-এর আসন থেকে উঠে আসছেন প্রবীণ, অসম্ভব রকমের সুঠাম এক দীর্ঘদেহী মানুষ। কেমন যেন অসম্ভব রকমের চেনা চেনা লাগছে। সিঁড়ি দিয়ে যত কাছে উঠে আসছেন, ততই আমার মনে হচ্ছে ভীষণ ভীষণ চেনা। মুখে ছাঁটা সাদা দাড়ি। স্মিত হেসে স্মারক তুলে দিলেন আমার হাতে। হাস্কি গলায় বললেন- “Exact height?” আমি থতমত খেয়ে বললাম- ” six two”. দীর্ঘদেহী হেসে বললেন- “Well,unfortunately… am also six two. ”
এদিকে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কি করে এত চেনা লাগছে এনাকে! আর ঘোষকও ইচ্ছে করে নামটা বলছেন না।প্রেক্ষাগৃহের সবাই ওনাকে চেনেন দেখছি। শুধু আমি ছাড়া। কে? কে ইনি? অবশেষে… নিজেই চীৎকার করে উঠলাম।আরেএএএএএএএএ… আর্নল্ড সোয়ার্জেনেগার!!! হ্যাঁ হ্যাঁ, কাগজে পড়েছিলাম বটে, উনি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হয়েছিলেন। তখন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন সেই পক্কদাড়ির প্রবীন মানুষটি।
আমার ছোটবেলার সেই সুপারহিরো। ব্ল্যাকে টিকিট কেটে দেখেছি ওঁনার সিনেমা। TERMINATOR এর শো-এর টিকিটের লাইনে মারপিট করতে গিয়ে টুটুনের পৈতের সোনার আংটিটাই খুলে পড়ে গিয়েছিল হাওড়ার পুষ্পশ্রী সিনেমার গেটে। বাড়ি ফিরে কি মার ওর বাবার। সব, সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে আমার চোখের সামনে দিয়ে ধীর গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছেন ১৯৬৭-র মিস্টার ইউনিভার্স, তারপর আরো চারবারের মিস্টার ইউনিভার্স, মোট সাতবারের মিস্টার অলিম্পিয়া- আমাদের ছোটবেলার সুপারম্যান- COMMANDO, THE TERMINATOR, TERMINATOR 2, TRUE LIES, PREDATOR, CONAN THE BARBARIAN – এর সেই দুনিয়াকাঁপানো সুপারহিরো। THE ARNOLD SCHWARZENEGGER- যেন লাজুক, মিষ্টি, বিনীত এক প্রবীন প্রেমিক!!
গতবছর, মানে ২০২১ এর এই জানুয়ারি মাসেই বিশ্ব চমকে উঠেছিল রাজনীতিবিদ সোয়ার্জেনেগারের একটি উক্তিতে। তাঁর নিজের দেশের, মানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- “WORST PRESIDENT EVER”, আরো বলেছিলেন- “HE IS A FAILED LEADER”.
লেখাটা লিখতে লিখতে মনে পড়ে যাচ্ছে আমার ছোটবেলায় পাড়ার বড়দের ওঁকে নিয়ে সেই ব্যঙ্গোক্তির কথা- “কি দেখিস ওই গাম্বাটটার সিনেমা? মুখে কোনো বুদ্ধির ছাপ নেই, কিস্যু না। মাথামোটার মত শুধু দুম্ব দুম্ব মাসল্ নিয়ে স্টেনগান চালিয়ে যাচ্ছে সারাক্ষণ। ধুসস। ওসব ফালতু সিনেমা দেখিস না। মাথামোটা হয়ে যাবি।”
আজ একটু আগেই জানলাম, গতকাল লস অ্যাঞ্জেলেস-এর রাস্তায় নিজে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে তাঁর। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে আঘাত সামান্যই। সুস্থ আছেন মিস্টার আয়রনম্যান-আর্নল্ড সোয়ার্জেনেগার। ছোটবেলায় হাঁপানি আর পেটের রোগে মরতে বসা একসময়ের এক কঙ্কালসার ল্যাকপ্যাকে সেপাইয়ের সাথে হাইট মেপেছেন কে? দুনিয়াকাঁপানো THE ARNOLD SCHWARZENEGGER. ওফ্!আমার রাণাপ্রতাপ চিরমারকুটে, বাবা বেঁচে থাকলে নির্ঘাত সুইসাইড করতেন। আগামীতে কোনোদিন আমার সঙ্গে সোয়ার্জেনেগারের হালকা দেখাসাক্ষাত হবে জানলে ছোটবেলার সেই যমপ্যাঁদান প্যাঁদাবার আগে রাণাপ্রতাপ ১৫৭ বার ভাবতেন।
অনবদ্য লেখা।