নদীর নাম সাভা। বিখ্যাত দানুব নদীর এক অংশ সাভা – ৯৯০ কি:মি: (৬১৫ মাইল) লম্বা এ নদীর যাত্রাপথ ভারি বৈচিত্র্যময় — মধ্য-দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ পরিক্রমায় সাভা স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া এবং বোসনিয়া অতিক্রম করে। এই যাত্রাপথে নানা রকম চড়াই-উতরাই -এর সম্মুখীন হয় সাভা নদী-সমতল-পাহাড়। জল ভরা-জল ছাড়া, উনা ও দ্রিনা সংগম … কত নানাবিধ ভৌগলিক পরিবর্তনের যাত্রাপথ সাভা নদীর। দক্ষিণ আল্পস-এর কাছে সাভা নদীর ‘ফল্ট’ অথবা এক বিচ্ছেদ তৈরি হয় মূলত পাথরের ফ্র্যাকচার বা ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’-এর ফলে নদীর যাত্রাপথে বিচ্ছেদ পড়ে যায়। এই অদ্ভুত ওঠা-পড়া, ভাঙাগড়া দেখতে দেখতে মনে হয়, সাভা শুধু নদী নয়, জীবনের এক প্রতিচ্ছবি — সে প্রতিচ্ছবি কোনও মায়া নয়, ভীষণ জ্যান্ত, ধ্রুব সত্য।
ইফটা-র নতুন নাটক ‘ভাঙা সম্পর্কের যাদুঘর’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যে এতে আর আশ্চর্যের কি যে এই চমৎকারি সাভা নদীর ধারের শহর জাগ্রেব -এই গড়ে উঠেছে ‘Museum of Broken Relationships’. যাকে আধার করে শ্রী দেবাশিস দত্ত গড়েছেন এই নাট্য। ভালবাসা, সম্পর্ক সবসময় পরিণতি পায় না। যখন পরিণতি পায়, তার উদযাপন ঘটে ব্যক্তিগত জীবনে — বিবাহ ও তৎপরবর্ত্তী বার্ষিকীগুলিতে। বলা যায় জীবনভর চলে তার উদযাপন। সাহিত্যে, গানে, চলচ্চিত্রে, নাটকে — কত না প্রেমের উদযাপন। কিন্তু এর বিপরীতে, বা বলা যাক বিপ্রতীপে, বিচ্ছেদ, প্রত্যাখ্যানগত – এগুলি যেন অনেকটাই ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ, তার গোঙানী, জ্বালা যেন একান্তই ব্যক্তিগত যাপন। আমরা প্রেম উদযাপন করি, প্রত্যাখ্যান উদযাপন করি কি? অথচ ভাবতে বসলে, একই অনুভূতির পরিণতির দুই পিঠ — প্রেম ও প্রত্যাখ্যান। প্রথমটির সরব, উজ্জ্বল প্রকাশ আর দ্বিতীয়টির নিভৃত, নিরব গোপনীয়তায় বিলীন এ যেন এক সামাজিক প্রচলনে প্রতিষ্ঠিত ‘বায়নারি’। অবশ্য শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাস এবং অদ্যবধী তার জনপ্রিয়তা এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বই কি!
এইরকমই এক পরিস্থিতিতে ক্রোয়েশিয়ার দুই শিল্পী যখন তাদের সম্পর্কচ্ছেদকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে এই সাভা নদীর তীরে জাগ্রেব শহরে গড়ে তোলেন ‘Museum of Broken Relationships’, তখন প্রেমহীনতা বা বিচ্ছেদ উদযাপনের এই সুযোগ অনেক মানুষই দুহাতে জড়িয়ে ধরেন। যতদিন সম্পর্কে ছিলেন ততদিন ব্যবহৃত, অথবা উপহার দেওয়া নানা বস্তু দান করে দেন এই সংগ্রহালয়ে। বস্তুগুলি সংরক্ষিত হয়ে বাঁচিয়ে রাখে সেই ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কগুলিকে — এক কথায়, মৃত সম্পর্কের যেন পুনরুজ্জীবন ঘটে, মরে গিয়েও যেন অক্ষয় অমরত্ব পেয়ে যায় দুটি মানুষের অনুভূতি তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসগুলির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনকারী সংগ্রহালয়ের পুরস্কার প্রাপ্ত এই জাদুঘর তার অনলাইন প্রদর্শনীর মাধ্যমে গোটা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।
না, জাদুঘরের ইতিহাস লেখা এই প্রতিবেদকের উদ্দেশ্য নয়। চমকে উঠি যখন দেখি শ্রী দেবাশিস দত্ত এই জাদুঘরকে আশ্রয় করে নাট্য বুনছেন। প্রতিটি ‘আর্টেফ্যাক্ট’ বা প্রদর্শনীর ‘দ্রষ্টব্য’ (exhibit)-এর সাথে জুড়ে আছে এক একটি গল্প। এত গল্পের মধ্যে থেকে ৬টি গল্প বাছাই করা বড় সহজ নয়। সেকাজ করে পরিচালক এবং নাটককারকে ভাবতে হয় কিভাবে ৬টি গল্পকে মঞ্চে পরিবেশন করা যায়। লক্ষণীয়, যে মঞ্চে অভিনয় হল, তা মূলত: প্রসেনিয়াম কিন্তু একটু ছোট মাপের এবং দর্শকদের সাথে মঞ্চের নৈকট্য এতটাই যে অভিনয় চলাকালীন প্রায় একই মন এবং শারীরিক স্তরে মিশে যেতে দর্শকের কোনও অসুবিধে হয় না।
মঞ্চের বা স্পেসের বিভিন্ন সরলরৈখিক এবং কৌণিক বিন্যাস আছে। একটি সামগ্রিক স্পেসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ছোট ছোট স্পেসে। নির্দেশকের কাজ হল অভিনয় চলাকালীন স্ক্রিপ্টের অন্তর্গত বিভিন্ন চেতনার উন্মেষগুলিকে এই স্পেসগুলিতে শৈল্পিক ভাবে ধরা, যাকে আমরা নাটকের ভাষায় ব্লকিং বা কম্পোজিশন বলে থাকি। এ নাটকে প্রতিটি গল্পের লোকেশন, মুড আলাদা, বয়স, কালক্রম আলাদা — সুন্দর ভাবে জোন ভাগ করে নির্দেশক প্রতিটি গল্পকে বিশিষ্ট করে তোলেন, এবং চিনিয়ে দেন। প্রথম কাহিনি যেন সূত্রপাত — অন্য মানুষের প্রতি নতুন ভালবাসা ভুলিয়ে দেয় পুরাতন প্রেমকে, কম বয়সের অস্থিরতা, কুড়ুল দিয়ে ছারখার করে দেওয়ার অভিঘাত, পরিণত দর্শককে তাদের কৈশোরে নিয়ে যায়। আবার, বার্লিন প্রাচীর পতনের পর পুণর্মিলিত দুই প্রেমিকের অক্ষয়, অবিনস্বর অনুভূতি এক স্বর্গীয় পরিবেশের রচনা করে — এই মুহুর্তটিই নাটকের সবচাইতে মরমীয়া অংশ বলে মনে হয়। কিন্তু এখানে নাটকের ক্লাইম্যাক্স বলে যেই না দর্শক এই সুন্দর অনুভূতিতে গা ভাসাবেন, ওমনি কিন্তু ঝলসে উঠবে তাদের রূঢ় বাস্তবের মাটিতে টেনে নামানোর এক চাবুক — হ্যাঁ, নাটকের এই শেষ গল্পটিতে দেবাশিস চমকে দিয়েছেন। প্রেম, ভালবাসা, প্রত্যাখ্যান — এসবের নরম, ভেজা অনুভূতির বিপ্রতীপে এই কাহিনি একদম অন্যরকম। বিভিন্ন ‘tangible’ দ্রষ্টব্যের প্রতীকে গড়ে ওঠা গল্পগুলির তুলনার এ নাটকের দ্রষ্টব্য বা ‘exhibit’ টি শারীরিক বা ‘intangible’ — এক চাবুকের দাগ – বহু বছর পরে গণিকার ঘরে সেই চাবুকের দাগ চিনিয়ে দেয় ছোট্টবেলার বন্ধুকে … লজ্জায়, ঘৃণায় পুরুষের বমন আর দর্শকের গা গুলিয়ে ওঠা স্বার্থকতায় নিয়ে যায় এ প্রযোজনাকে।
ভিস্যুয়াল বা ‘imagery’ বিষয়ে শ্রী দেবাশিস দত্তের সুনাম আছে। তিনি কে. এন. পানিক্কর-এর মত দিকপাল নাট্যস্রষ্টার দীক্ষায় দীক্ষিত। পেইন্টিং বা ম্যাশ আর্ট তাঁর অনুভূতির স্বাক্ষর হয়ে প্রেক্ষাপটে সাইক্লোরামায় ফুটে ওঠে কাহিনি থেকে কাহিনি-ন্তরে। বহুকাল আগে ‘ঋতুসুখে বিবর্ণ কবিতা’ নামক কলকাতা শহরে বিতর্কিত এক নাট্যের স্রষ্টাকে যখন তাঁরই এক দর্শক দেখেন ‘ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘর’ গড়তে, তখন মনে হয় যেন এক বৃত্ত পূর্ণ হল।
বাংলা মঞ্চে ভালবাসা ফেরানোর কৃতজ্ঞতা ইফটাকে জানিয়ে এ প্রতিবেদন উৎসর্গ করলাম সেই একঝাঁক তরুণ-তরুণীকে যাঁরা এ নাটকের ভাবনাকে রূপদর্শন করেছেন মঞ্চে। তাঁদের অভিনয় হয়ত প্রচলিত অর্থে কাঁচা কিন্তু ভীষণ ফ্রেশ, নবীন …কখনও পাকা অভিনয়ের প্রয়োজন হয় না। বাংলা গানগুলি মনে করিয়ে দিতে থাকে যে অনুভূতি, প্রেম, প্রত্যাখ্যান আন্তর্জাতিক হলেও খুবই স্থানিক, চিরন্তণ, শাশ্বত — সে হেলসিংকি হোক, বেলগ্রেড হোক, বার্লিন হোক কি অমরপল্লী হোক। আলো নিয়ে নিরুচর্চার প্রসেনজিৎ কে ধন্যবাদ। বিশেষত মোমবাতির দৃশ্যটি ভোলা যায় না।
এ খোঁজ চিরন্তন — শেক্সপিয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ, হ্যামলেট থেকে বিনোদিনীতে খুঁজেছেন এ প্রশ্নের উত্তর, মানিক লিখেছেন — ‘শরীর, শরীর, তোমার মন নাই, কুসুম?’ আর, গরীবের মেয়েতে হেমন্ত গেয়েছেন —
ও গো প্রেম, তুমি স্বপনেরও মায়াযুগ আজও বনপথে, মায়া হরিণীর ঠিকানা পেলে না কি গো?
ঠিকানা পাওয়া যায় না, বেঁচে থাকে স্বপন, সৃষ্টি হয় মায়ামুগ, বনপথে চলতে থাকে মায়া হরিণীর খোঁজ …।
কোভিড দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরেই এক অন্যরকম নাট্য।