অসীম দাস
সবুজ দলের নাম। পুরো নাম কয়াডাঙ্গা সবুজ সাংস্কৃতিক সংস্থা। যার ঠিকানা অশোকনগর কল্যাণগড়। প্রাণপুরুষ রাজেশ দেবনাথ। দলের প্রত্যেকেই তরতাজা তরুণ। ভাবনায় আধুনিক। দল প্রতিষ্ঠা ৮ অগাস্ট ২০০৪, শুরুতে দলের কর্মকান্ড ছিল পাঠ অভিনয়, তাই শ্রুতিনাটকের উপর পত্রিকা প্রকাশ ‘শব্দচিত্র’। যদিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এরপর মঞ্চ নাটকে নিমগ্ন হয় সবুজ। একে একে লেডি ম্যাকবেথ, আন্তিগোনে( হিন্দিতে), ওয়েটিং ফর ইউ, বৃষ্টি, গালি দিবেন নি কাকা, গল্পটা এইটুকু ছিল ইত্যাদি নিয়ে ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বিচরণ চলে। ভালো পারফরম্যান্স দলকে শো, সম্মান অর্থ এনে দিয়েছে। সাম্প্রতিক মিরর নাট্যটি দেখলাম গত ১৪ মার্চ শিশির মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত একবিংশ নাট্যমেলায়। ওইদিন ১৪ তম অভিনয় সম্পন্ন হলো। প্রথম অভিনয় ১২ ডিসেম্বর ২০২০, আগে যা এই দলের ছোট নাটক দেখেছি তবে মিরর দেখে আমার ধারণা বদলে গেছে। অনেক পরিণত অভিনয় সকলের। আসলে একটি নাট্যদলের মূল উপজীব্য হলো ভালো নাটক, অভিনেতা, অভিনয়। মানুষ বা দর্শক যার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুগ্ধ হয়। বাহবা দেয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যখন নিচে বসে থাকা মানুষটার মনের কথা বলে। ইসারা করে, হাসে, দুঃখ পায়। কাঁদে, ভালোবাসে। মিরর তেমনই, অতীতের সমস্ত স্বপ্নময়তাকে স্বপ্নভঙ্গ করে তোলে।
মিরর অর্থাৎ প্রতিবিম্ব। কোনো আয়না নয়। এখানে মানুষের ভেতরের মানবিক স্বত্ত্বার মুখোমুখি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এক মনোবিশারদ বা মনের ডাক্তারের মুখোমুখি মানসিক ভাবে অসুস্থ তথাগত। তার নিজের সৃষ্টি, নিজের সমস্ত স্বত্ত্বাকে কেউ অস্বীকার করছে। নিজের অসহায়তার কাছে হেরে যাওয়াতে সে হয়ে উঠছে অমানবিক । কতগুলি জীবনযাপনের অনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বীকার তথাগত একসময় গতিহীন হয়ে পড়ে নিজেরই বৃত্তে। সময়ের মূল্য না দেওয়া একটা চাকার সামনে নিজেই বিপন্ন হয়ে হত্যা করে নিজের বাবাকে, প্রেমিকাকে, নিজেকেও। চিকিৎসকও ওই বিপন্নতার পাকে জড়িয়ে পড়ে। যে অস্থিরতা তথাগতর সে অস্থিরতা জেনারেশনের পর জেনারেশনের। কমে আসা ধৈর্য সময়ের সাথে যুদ্ধ করে পাশবিক হয়ে ওঠে তথাগত, একসময় হেরেও যায়।
নাট্যকার নির্দেশক রাজেশ দেবনাথের এই নাট্য নির্মাণ আসলে এক সাইকো থ্রিলার। নাটকের মঞ্চে ট্রিটমেন্ট। এ নাটকে প্রসথেটিক কস্টিউমস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। আমরা যারা মঞ্চের সামনে বসে জীবনের আলো খুঁজি, বাঁচার রসদ খুঁজি নাটকের মধ্যে তারা চমকে উঠি। একে ওপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। ভুল খুঁজি। ভুল সংশোধন করিনা। তখন চোখে মিরর ঠিকরে আলো এসে পড়ে। নিজের কদাকার মুখোশের মুখোমুখি হই। আমাদের রাগ, অভিমান, ভালোবাসা না পাওয়ার হিংস্রতা রূপ তাহলে এমনই? চমকে উঠি। প্রতিশোধের রাস্তায় পা বাড়াই।
বহমান সময় বড়ই চঞ্চল। সেই সময়ের কান্ডারী নবযৌবন। যাদের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে লড়াই আছে। মিরর নাটকে অদ্ভুত এক অস্থিরতা আমাদের গ্রাস করে রাখে পুরো একটি ঘন্টা। এত অন্ধকারে অসাধ্য আলোর ছটা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন আলোক পরিকল্পক রাজেশ। থিয়েটারের প্রতিটি স্তর পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি। মঞ্চের দুটি ভাগে নিয়নের আলোর দ্যুতির সাথে আবহের মূর্ছনায় এ নাটক সবুজের ভাষা বদলে দিয়েছে। প্রিতম চক্রবর্তীর তথাগত দেখতে শান্ত অথচ কতটা যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে একে একে সকলকে হত্যা করে নিজেরই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নিজেকে আঘাত করেছে। দারুণ অসাধারণ অভিনয়। নির্দেশক রাজেশ তার ভাবনা দিয়ে বাকি অভিনেতাদের সাজিয়েছেন। নবমিতা ঘোষের আকাঙ্ক্ষা রুপী মনোবিদ আসলে তথাগতর মনোবিকার যে রূপ প্রতিফলিত হয় সুইসাইডের পর। যার ছায়া এসে পড়ে আকাঙ্ক্ষার উপর। তারও একই প্রশ্ন, একই হতাশা। অসুস্থ তাহলে কি আমি আপনি তথাগত সবাই!
টানটান নাটক থেকে চোখ সরানো যায়নি।বরং আৎকে উঠতে হয়েছে যখন হিংস্রতা গ্রাস করে প্রেমিকা তনিষ্ঠার গলায় ধারালো চাকু চালিয়ে শান্তি পায় তথাগত। ভায়োলিনের শব্দে আচ্ছন্ন তথাগতর ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে বাইরে থেকে সে ক্ষত সারানোর সব রাস্তা বন্ধ। দর্শক পরিপূর্ণ হল তখন স্তব্ধ। অসহায়। আমাদের ভাবায়, মোহিত করে আসলে আমরা প্রত্যেকেই এক একটা তথাগতর প্রতিবিম্ব, মিরর।
পুরো নাট্য জুড়ে অনেক চমক। দেবাশিস দত্তর মঞ্চ ভাবনা ভালো লাগে। আলো প্রক্ষেপণে শৌভিকের অসাধারণ খেলা দেখার মতো। শূন্যস্থানে অভিনেতা পৌঁছবার মুহূর্তে আলোর বলয় এসে ধরা দেয় অভিনেতার মুখে এ এক অসামান্য প্রাপ্তি। কোরাস টিমে সকলের সংগত চোখে পড়েছে। পারমিতা ঘোষের তনিষ্ঠা বড় মায়াময়, সংলাপহীন তবু মায়াবী চোখে অনেক স্বপ্নমাখা কষ্ট, জমিয়ে রাখা বহুদিনের কান্না আমাদের ভাবিয়ে তোলে, আচ্ছন্ন করে রাখে।শুধু পারমিতাকে বলবো ভায়োলিন বাজানোটা প্যাকটিস করতে হবে। সত্যি হয়ে উঠতে হবে যে। মিররের অভিনয় আরো হোক, প্রশ্ন চিহ্ন থেকে মুক্তি পাক মনের প্রতিবিম্ব।
দারুণ আলোচনা।