বাজুক সেতার ঝালায় – শম্পা ভট্টাচার্য

আমি এমন একটি বই সম্পর্কে আলোচনা করছি যা বাঙালির নাট্যচর্চায় নবতম ও অভিনব সংযোজন। বইটির নাম ‘চৌতাল’। বইটির ভূমিকা, প্রস্তাবনা, অনুবাদ ও টিকা রচনা করেছেন ব্রাত্য বসু। নাট্যচর্চায় অপরিহার্য চারটি সত্তা নাটককার, অভিনেতা, সমালোচক, নির্দেশক সম্পর্কে চারটি স্বতন্ত্র আলোচনা এর অন্তর্গত।

দূরদর্শনের সিরিয়ালের আসর জমজমাট হয়ে উঠল , ডিজিটাল ইণ্ডিয়া হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর হল ভারতবর্ষ ,শ্যাম পিত্রোদার বদান্যতায় গ্রাম – গ্রামান্তরে মোবাইলের নেটওয়ার্ক এর জাল বিছিয়ে গেল – তারপরে আজ পর্যন্ত স্মার্টফোনের দৌলতে সারা পৃথিবীর বিনোদন সাম্রাজ্য এল হাতের মুঠোয়। কলকব্জার কলা-কৌশলের এই সব চমক পার হয়ে টিঁকে রইল থিয়েটার যা কিনা একটা প্রাচীন শিল্প এবং সেই পুরাতন গ্রিসের আমল বা তার আদিকাল থেকে মানুষের মনে নির্মল আনন্দ দিয়ে জাঁকিয়ে বসে ছিল।দিন বদল হলো কিন্তু থিয়েটারের খোলনলচে তেমন কিছু বদলে গেল না – যা কিছু পরিবর্তন হলো সে কেবল তার ঠমকে গমকে, আসলটি সেই এক ও অবিকৃত রইল। আলোর সেতু বাধা রইল অতীতের অন্ধকারের শৃঙ্খলে। মানুষের চিরন্তন আবেগের সঙ্গে থিয়েটারের গহন গভীর সম্পর্ক। দিন পাল্টায় সুখ-দুঃখ রাগ অনুরাগের রং পাল্টায় না। তাই নাট্যাভিনয়ের মত শিল্প কখনো ফসিলে পরিণত হলো না।

মানুষের মন, মনের জটিলতা, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, সম্পর্কের বিচিত্র রং নাটকে থিয়েটারের চিরকালীন উপাদান হয়ে রইল।

পৃথিবী জুড়ে সাম্প্রতিক কালেও সেই একই হালচাল বজায় রইল।

গত শতকের মাঝামাঝি থেকে আমরা নিয়মিত বা অনিয়মিত ভাবে বিদেশি নাটকের অনুবাদ বা রূপান্তরের অভিনয় দেখেছি। ব্রেখ্ট, স্তানিস্লাভস্কি ,চেকভ এবং আরো নানা নাট্যকারদের মত ও পথ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে থিয়েটারের যে পালাবদল ঘটল তা বড় কম নয়। ব্রাত্য বসু আলোচ্য গ্রন্থে ইউরোপ ও আমেরিকার চারজন বিশিষ্ট নাট্যকর্মীর জীবনী ও নাট্য দর্শনকে বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

চৌতালের লেখায় নাট্যকার এডওয়ার্ড বন্ডের পরিচিতি, ঘটনাবহুল জীবনের পরিচিতি দিয়েছেন লেখক। আর আছে তাঁর নাট্য দর্শনের কথা। ফুকোর তত্ত্বকে বন্ডের লেখাগুলি প্রমাণ করে। বন্ডের রচনাতে আছে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল মানুষের কথা, ‘মূর্খ রুটি ও প্রেমের দৃশ্যাবলী’ নাটকের ভূমিকা। পুঁজিবাদ, প্রযুক্তি ও মানব প্রকৃতি এতে আলোচিত। প্রশ্ন উঠতে পারে — কেনই বা এসব আলোচনা, বাংলা থিয়েটারের নির্মাণ পদ্ধতির সঙ্গে কোথায় এর মিল বা অমিল। গত শতকে বহুদিন ধরে যে ছক বাঁধা তোতাপাখি সুলভ খাঁচায় বদ্ধ থিয়েটারের ভাবনা ছিল আঙুল চুষে মাথা নেড়ে যে ভাবনাকে ফেনিয়ে তুলেছিলেন কতিপয় বঙ্গজ নাট্য বুদ্ধিজীবী। তাঁরা এ কথা ভাবতে চাননি বা বুঝতে স্বীকৃত হননি যে কোন ইজমের যদি বছরের পর বছর চর্বিত চর্বণ ঘটতে থাকে, যদি সেই ইজমের সঙ্গে মানুষের কল্যাণ অকল্যাণের সম্পর্কটা শিথিল হয়ে যায় তখন সেই ইজমের কোনো দাম থাকে না। অচলায়তনে অভ্যাসের দাস কেউ হতে পারেন সেটা তাঁর অভিরুচ। আবার এমন মানুষ তো থাকতে পারে যে বা যাঁরা সেই সৃষ্টিছাড়া দাসত্বের বোঝা ঠেলে ফেলে মুক্ত মানবতা ও শিল্পের চর্চাকে গুরুত্ব দিতে চান। সেই চাবিকাঠি পাঠকের মনে ও মননে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘চৌতালের’ মত বইয়ের সভ্য সমাজে আনাগোনা। উক্ত বইটিতে চারটি আলোচনা বাংলা সাহিত্যে সুবিখ্যাত চারজন কবির বইয়ের নাম অনুসারী। তাঁরা যথাক্রমে সুবোধ সরকার, জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত এবং কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। কবিতার বইগুলি যথাক্রমে ‘একা নরকগামী’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ এবং ‘কিরকম আছো মানুষেরা’।

চারজন নাট্যকর্মীর সাহিত্যগুণ সম্পন্ন লেখালেখির সাবলীল ভাবে অনুবাদ করেছেন ব্রাত্য। সমকালীন পৃথিবীর অসংস্কৃত সভ্যতা তাঁদের লেখায় ছায়া ফেলেছে। বন্ডের লেখাটি যেন নিঃস্ব, রিক্ত সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের ব্যথার উপশম। এই মুহূর্তে ‘মূল্যবোধ ও মানব স্বভাবের যে পুনরাবৃত্ত অবক্ষয়’ ভারতবর্ষের মধ‍্যে অনুবাদক ব্রাত্য লক্ষ্য করেছেন তাতে ভারতীয় বা বঙ্গজ মন্ডলে বন্ড এর লেখাটি পূর্ব প্রাসঙ্গিক বলে তাঁর মনে হয়েছে।

আন্তলিন আর্তো অর্থাৎ আন্তনিও মারী জোসেফ পল আর্তো ফরাসি কবি, নাট্যকার, অঙ্কনশিল্পী, থিয়েটার পরিচালক। সারা জীবন শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাঁর অনুভূতির তীব্রতা, একাকীত্ব, অসুস্থতা, মনের বিশেষ প্যাটার্ন তাঁকে ঐতিহ্যবাদী থিয়েটার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। আর্তো তৈরি করেছিলেন থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি বা নিষ্ঠুরতার নাট্যতথ। এর দীর্ঘ পরিচয় দিয়েছেন অনুবাদক, বহুবর্ণ বিচিত্র জীবন আর্তোর । সুররিয়ালিজমে দীক্ষিত তিনি।নেশাগ্রস্ত। আবার কখনও বা পাগলা গারদ সাময়িক আশ্রয় হয়েছে তাঁর । নিষ্ঠুরতার নাট্য কিন্তু দুঃখবাদ নয়, মিথ্যা বাস্তবকে পরাহত করার জন্য প্রচন্ড শারীরিক দৃঢ়তা প্রয়োজন । ‘মারী ও থিয়েটার’ আন্তলিন আর্তোর লেখা ‘থিয়েটার এন্ড প্লেগ’এর বঙ্গানুবাদ। মূল ইংরেজি বই ‘থিয়েটার এন্ড ইটস ডাবল’ এর প্রথম প্রবন্ধ। ‘থিয়েটার এবং মারী’ লেখাটি আর্তো সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা আকারে বলেছিলেন ১৯৩৩ এর ৬ই এপ্রিল। আর্তোর থিয়েটার নেতি থেকে ইতিতে অন্বেষণের চেষ্টা । আর্তোর নাট্য দর্শন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ব্রাত্য বসু লিখেছেন ‘সেই অতীন্দ্রিয় স্বপ্ন, পরাবাস্তব ও আধিদৈবিক এক ভুবনে আমাদের পাঠিয়ে দেয়, এই উন্মাদের অন্তরের শতজলঝরনার ধ্বনি এই শতাব্দন্তরে এসেও আমাদের নির্জ্ঞানে সেই ধূসর উত্তঙ্গ কোন চাঁদের পাহাড়ের লুক্কায়িত গুহাতে নির্ঝরিনী হয়ে তার শ্বেত শুভ্র অথচ গন্ধকের মত জ্বলন্ত নুড়ি পাথর ছড়াতে ছড়াতে যায়’ । অনুবাদক যে নিজেও আদ্যন্ত একজন কবি – আর্তোর কবিতার হিরণ্যগর্ভ অনুবাদ এবং এই অসাধারণ অর্থদ্যুতিময় শব্দকুঞ্জ তা প্রমাণ করে। আর্তো সাংস্কৃতিক উচ্চসৌধ হয়ে তাবত শিল্প তথা সংস্কৃতিতে বিদ্যমান বলে তাঁকে বাঙালির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেনঅনুবাদক।ব্রাত্য বসুর মতে তাঁর অনুবাদ মূল রচনা আভাস মাত্র। কিন্তু ঝিনুকের মধ্যে মুক্তার মত তার মধ্যে লুকিয়ে আছে সারাতসার ।

হাওয়ার্ড কিসেল সম্পাদিত ‘অভিনয়ের শিল্প’ স্টেলা অ্যাডলারের বাইশটি বক্তৃতার সংকলন । প্রথম দুটি বক্তৃতার অনুবাদ করেছেন আলোচক। ‘মঞ্চে প্রথম পা রাখা’ এবং ‘মঞ্চের পৃথিবী তোমার পৃথিবী নয়’ । ১৯২২ – ২৩ সালে রাশিয়ার প্রখ্যাত অভিনেতা পরিচালক স্তানিস্লাভস্কি মস্কো আর্ট থিয়েটার নিয়ে আমেরিকা সফর করলে স্টেলা তাঁর নাটক দেখেন এবং প্রভাবিত হন। ১৯২৬ সালে আমেরিকা ল্যাবরেটরি থিয়েটারে কিংবাহণ১৯৩৪ সালে নিউইয়র্ক গ্রুপ থিয়েটারে স্টেলা যুক্ত হন । ১৯৩৪ সালে প্যারিসে গিয়ে স্তানিস্লাভস্কির কাছে নাটক শেখেন, আমেরিকার অন্যতম অভিনয় শিক্ষক নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে নাটক বিভাগের প্রধান এই নারী নিউইয়র্ক গ্রুপ থিয়েটারেও যুক্ত হন। তিনি বলতেন – “in your choices lies you talent, don’t be boring”. আমেরিকায় অভিনয় শিক্ষার স্কুল খুলে ছিলেন তিনি । এই বইটিতে আছে স্তানিস্লাভস্কির জীবনী, স্টুডিও থিয়েটারের সম্প্রসারণ, স্ট্যালিনের আমলে তাঁর ক্ষমতার সংকোচন এবং প্রায় বন্দী জীবনে করুণ মৃত্যুর কথা । স্টেলার বক্তৃতার এই অনুবাদ থিয়েটার কর্মী এবং থিয়েটার না কর্মী উভয় পাঠকেই উৎসাহ জোগাবে। এখানে আছে সমসাময়িক জীবনবোধে নিগূঢ় অনুভবে জারিত স্টেলার থিয়েটার দর্শন। স্টেলা শিল্পীর অন্তর্গত সত্যের উপর ভরসা করেছেন । তাতেই আলোকপাত করেছেন চৌতালের স্রষ্টা। তাছাড়া তাঁর মনে হয়েছে ‘ আধুনিক মনস্তত্ত্ব ইউরোপিয়ান নাট্যধারা ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন রূপ, অর্থোডক্স চার্চের ধর্মীয় অনুশীলন, অপেরা মাস্টার সুরসংগতি, প্রাচীন ভারতীয় যোগাভ্যাস , সমকালীন তলস্তয়ের দর্শন এবং আরও অনেক কিছু তার তথ্য ও পদ্ধতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে ‘।

শেষ কথা মার্টিন এসলার প্রসঙ্গে — প্রখ্যাত নাট্যসমালোচক এসলার অ্যাবসার্ড থিয়েটার শব্দটির স্রষ্টা এবং ‘ দ্য থিয়েটার অফ দ্য অ্যাবসার্ড ‘ বইটির লেখক সুচিন্তিত অথচ সংক্ষিপ্ত ভাষা ভঙ্গির চলনে ব্রাত্য এসলার যে কিভাবে ব্রেখটের এপিক থিয়েটার তত্ত্ব এবং অ্যাবসার্ড থিয়েটারের মধ্যে কিভাবে সম্মানিত হয়েছে তা ব্যর্থ করে আধুনিক ভারতীয় সমাজ, ধর্ম , রাজনৈতিক অবস্থার, পরিপ্রেক্ষিতে তার উপযোগিতা ব্যক্ত করেছেন।

বইয়ের শেষ আলোচনাটি এসলিনের বিখ্যাত বইটির সপ্তম অধ্যায় ‘দ্য সিগনিফিকেন্স অফ দ্য অ্যাবসার্ড’ এর সংযোজিত বঙ্গানুবাদ। আজ যখন বঙ্গীয় নাট্যচর্চায় অ্যাবসার্ড থিয়েটারের চর্চার গ্রাফ খানিকটা নব মুখী তখন এই লেখালিখি নাট্যকর্মী ও গবেষক উভয়কে প্রাণিত করবে ।

‘চৌতাল’ কে আরও সমৃদ্ধ করেছে অজস্র টিকা-টিপ্পনি। দ্রুত পরিবর্তিত জীবন আমাদের । রোজনামচায় আজকাল নিত্য নৈমিত্তিকতার গল্প থাকে না। জীবনের সঙ্গে থিয়েটারের মত শিল্প জড়িয়ে মিশিয়ে আছে বরাবর সেই থিয়েটারের চর্চায় ‘ নীল একটা হাওয়া বইয়ে দিতে চায় ‘ যে নতুন প্রজন্ম বই তাঁদেরকে উৎসর্গ করেছেন অনুবাদক। বইয়ের শোভন সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন পৃথ্বীশ রানা । এটি একটি প্রতিভাস প্রকাশনা ।