যুগ যুগ ধরে বাংলার বুকে প্রবাহিত ধর্মের স্রোত মানবের কলুষিত আত্মাকে ধৌত করে স্বর্গীয়ভাবের বন্যায় নিয়ে আসে এই মনসা মঙ্গল সংকীর্তন। কথকথা, পুরাণাদি, সমালোচনা, বেদ অধ্যয়ন বাংলার নরনারীর সামনে তুলে ধরে পিতৃভক্তি, মাতৃভক্তি ভ্রাতৃপ্রেম জনপ্রীতি সতীত্বের উজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। মাতৃ সমাজকে পরিজীবদয় বরিবার (বরণ করবার) মানসে লখিন্দর, বেহুলা, চাঁদ সদাগরের মনসা লীলা। সাগর কর্মকার স্পষ্ট উচ্চারণ সুন্দর বর্ণনায় একান্তে নিজের শিল্প আঙ্গিকে অনায়াস মানুষটি সাগর কর্মকার। মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা অঞ্চলে তাঁর বাস। ৭৩টা বছর পার করে দিলেন বাংলার অন্যতম লোক সম্পদ বিষহরী পালা পরিবেশন করে। বিষহরা বা বিষহরী উত্তরবঙ্গের অন্যতম একটি লোক নাটক। এই অঞ্চলের অপর লোকনাট্য ‘কুশান পালা’র সঙ্গে বেশ কিছু সাদৃশ্য আছে। তবু এটি একটি আলাদা লোক ব্যাপ্তি। কোচবিহার ব্যতীত জলপাইগুড়ি এমনকি মুর্শিদাবাদেও এ পালা ছড়িয়ে রয়েছে।
বিষহরা সাধারণত মুক্ত অঙ্গনে পরিবেশিত হয়। জলপাইগুড়ি জেলার প্রখ্যাত বিষহরা শিল্পী রাজকুমার বর্মন মনের একান্ত ভালোবাসা ও শখ থেকে এই পালায় নিজেকে জড়িয়েছেন। মূল গায়েনের হাতে থাকে চামড়, পায়ে থাকে ঘুঙুর। প্রথা অনুযায়ী ছোটো ছোটো মেয়েরা হাতের মুদ্রায় সাপের ভঙ্গি করে। শরীরের সর্পিল গতি প্রকাশ করে নাচের মাধ্যমে এ পালা করে থাকে। বহু আগে প্রায় সারারাত ধরে এ পালা অনুষ্ঠিত হতো। দর্শকের মন-মানসিকতার ইচ্ছা মিটিয়ে লখিন্দরের নতুন জীবন ফিরে পাওয়া পর্যন্ত এ গল্প শোনার একটা রীতি রয়েই গেছে। এ পালা আবর্তিত হয় মা মনসাকে কেন্দ্র করে। খোল, বাঁশি (কুপা বাঁশি) এ পালার অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র। বাঁশির শিহরণকারী সুর সর্পদেবী মনসার উপস্থিতিকে প্রতিঘাত করে এ পালায় এক অন্য মাত্রা যোগ করে। কথা হলো বিষহরা শিল্পী সাগর কর্মকারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আট থেকে দশ জনের দল তাঁর। উত্তরবঙ্গের ঔরঙ্গাবাদের তপেশ সাধুর কাছ থেকে তিনি এ পালা শিখেছেন। মানুষের মঙ্গলের হেতু এ পালার মাধ্যমে তিনি পরিবেশন করেন এই লোক আকরটি— মাকে পুজিবো গো… নমো নমো মাগো দেবী বিষহরি।
কীর্তনের সুরে দাসপাহারী তালে এ গান হয়। কখনো বিলম্বিত, কখনো জলদে। তিনি জানালেন প্রায় ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬০ দিনই এ পালা তিনি করেন। তবে শ্রাবণ-ভাদ্রতেই এই পালা বেশি হয়। কথা হলো এই সময়ের অপর বিষহরি শিল্পী বিশ্বনাথ হাজরার সঙ্গে। বয়স খুবই অল্প। তিনি চান বিষহরী পালা গোটা দেশে আরও আরও বেশি করে হোক। কিন্তু পাশাপাশি তিনি বললেন, এ পালায় তাঁর বয়সী অন্যরা সেভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। তবে সাগরবাবুর দলের কাণ্ডারি হিসেবে তিনি নিজেকে গড়ে তুলছেন। অপর শিল্পী দিলীপ দাস। সাগরবাবু তাঁকেই তাঁর দলের পরবর্তী দলপতি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাঁদের দল জয়গুরু মনসামঙ্গল সংস্থা, ব্যস্ত একটি দল। এই দলের প্রায় জন্য পাঁচেক সদস্য প্রতি মাসে সরকারি ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু সরকারি প্রোগ্রাম তাঁরা এখনও করে উঠতে পারেননি, জানালেন সাগরবাবু।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডালখোলা-শিলিগুড়ি থেকে শুরু করে রানাঘাট হয়ে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রাচীন লোকজ আঙ্গিকটিকে তাঁরা প্রদর্শন করে চলেছেন। তাই বছরের বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে কাটে এঁদের। বিষহরী পালায় সংগীত বা নাচের পরিবর্তন সেভাবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুব একটা আসেনি। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে কাহিনি সূত্রের মূলে যে পুরাণ রয়েছে, সেইটির বর্ণনায়ই এই লোকজ আঙ্গিকটিকে এভাবে বজায় রেখেছে। তবে সাগরবাবুর স্বপ্ন দল বিষহরীকে মানুষের মধ্যে বেশি করে তুলে ধরা। তাই তিনি বলেন তাঁর অবর্তমানেও তাঁর দল বন্ধ হবে না। শিল্পীর এই উক্তি তাঁর জীবন পথের মতোই সরল।
তাই জয়গুরু মনসামঙ্গল সংস্থা ভবিষ্যতেও শত বাধা জয় করে এগিয়ে যাবে। মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে তাঁদের এই লোকজ কৃৎকৌশল। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেল। এই প্রতিবেদনটি আমি যখন লিখছি, তথ্য সংগ্রহের জন্য বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছি, তখন আমার বাড়ির চারপাশ থেকে শঙ্খ-উলুধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে। আজ যে মনসা পূজা, জানিনা কেন আজই এই প্রতিবেদন সমাপ্ত করলাম। একেই কী বলে দেবী মাহাত্ম্য!