লোককরির পালা ‘লেটো’ || পর্ব – ১৪

দীপা ব্রহ্ম 

‘বাউলের দেশ বীরভূম রামী চণ্ডিদাসের দেশ বীরভূম, তারাশংকরের দেশ বীরভূম, জয়দেবের দেশ বীরভূম, লালমাটির দেশ বীরভূম। লৌহমিশ্রিত মৃত্তিকার প্রতিটি কাঁকড়ে সংস্কৃতির ছোঁয়া। গড়িয়ে গড়িয়ে কখন জানি পৌঁছে যায় গোটা বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। হেঁকে বলে যায় ‘আমরা ছিলাম গো, আছি গো, থাকবো গো’, ‘যতদিন এ পৃথিবীতে গান থাকবে, গানের মানুষ থাকবে।’ বৃষ্টির ফোঁটা এ মাটি নিজের মধ্যে নিয়ে নেয় অনায়াসেই। তেমনি সংস্কৃতির সোনার ফসলের জন্ম দিয়েছে এ মাটির চড়াই-উৎরাই-এর খাঁজ-ভাঁজ। ছাতিফাটা রোদ্দুর, বাঁশবাদির সাপের ঝোপ, সারি সারি তালগাছ। এই জেলার সম্ভ্রান্ত একটি লোকদলিল লেটো।

বর্ধমানের চুরুলিয়ার দুখু মিঞা লেটোর দলে যোগ দিয়েছিলেন। সেই আপাদমস্তক ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষটির স্পর্শ লেটোকে তুলে ধরেছে এই অঞ্চলের মানুষের গ্রাম্য জীবনযাত্রার অন্তঃকরণে। হ্যাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম-এঁর সঙ্গে সেই থেকে জড়িয়ে থাকা এই লোকমালিকার একটা আলাদা ঘ্রাণ তাই আজও বাংলার লোকভাণ্ডারকে সম্মানিত করে চলেছে। বেশ কিছুকাল আগে থেকে লেটো বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া জেলাকে ছুঁয়ে থাকলেও এখন লোক কবির পালা ‘লেটো’ মুর্শিদাবাদ বা বীরভূমের মধ্যেই বেশি চোখে পড়ে। লেটো এসেছে ‘নেটো’ মানে ‘নাটুয়া’ থেকে ‘নাটুয়া’ হলেন তাঁরাই, যাঁরা নাট্যকর্ম করেন। ‘নেটো’র নামান্তর-ই ‘লেটো’। যেভাবে ‘নেবে’ শব্দটি গ্রাম্য ভাষায় ‘লেবে’ বলা হয়, ঠিক তেমনই। ‘লেটো’ একটি আনুষ্ঠানিক লোকনাট্য।

হুগলি জেলার মুক্তারামপুরের লেটো শিল্পী জহর সরকার। বাবার যাত্রাপালা দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছেন। পরে লেটোর দল গড়েন। অভাব তাঁকে লেটো পালাকে নেশা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এই জেলায় প্রবীণ শিল্পীরা হলেন—লালু চৌধুরী, তারকেশ্বরের নিমাই বসু। বীরভূমের লেটো শিল্পী হরকুমার গুপ্ত। অভাব তাঁকে একসময় পথে নামতেও বাধ্য করে। পাড়ায় পাড়ায় লেটো গানের আসরে দর্শক হিসেবে তিনি প্রথম এই লোকমাধ্যমটির সঙ্গে যুক্ত হন। পরে লেটো গানের দলে যোগ দেন। বর্তমানে লেটো শিল্পী হিসেবে যাঁরা এগিয়ে আসছেন, তাঁদের অভিনীত পালা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যায় উঠে এলো শ্লেষ। সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন আমাদের পুরানো দিনে ছ্যাঁচড়া প্রায়শই প্রত্যেক নেমস্তন্নের খাদ্য তালিকায় থাকতো, এখন সেই ছ্যাঁচড়ার নামান্তর হয়েছে নবরত্ন।… এখন লেটোও সেই অবস্থায়। হরকুমারবাবু বীরভূমের মহম্মদ বাজার অঞ্চলের বাসিন্দা। তিনি জানালেন, লেটো গ্রাম্য জীবনের খুবই জনপ্রিয় একটি লোক নাটক। এই নাটকে নাচ, গান সংলাপ, হাস্যকৌতুক, ছড়া সবটাই আছে। লেটোর নির্দিষ্ট কোনো স্ক্রিপ্ট হয় না। অভিনয়ের আগে ঠিক হয়, কে কিসের অভিনয় করবে। তাঁর দলের নাম শ্রীদুর্গা লেটো আসর। তাঁর দলে আছেন বারোজন শিল্পী। বর্তমানে লেটোর গান সম্পর্কে তিনি বলেন—’এখন তো গান নয়, সবই মেশিন গান।’ তাই তিনি লেটোর নিজস্বতা বজায় রেখে গান রচনা করেন। বললেন, ‘এ আমার কথা নয়, আমার বুকের বেদনা থেকে বেড়িয়ে আসছে। লেটো পালায় হারমোনিয়াম, ঢোল, ডুগি-তবলা, কর্নেট বাঁশি—এসব যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। মাকে বন্দনা করে পালা শুরু হয়। মাস্টার যিনি এ পালার, তিনি গুরুপ্রণাম জানান। গুরুকে বন্দনা করেন।

‘গুরু’ শব্দের ব্যাখ্যায় গুরুকে আলো, গুরুকে জগৎ হিসেবে প্রতিস্থাপিত করা হয়। লেটোতে ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করে। এঁদের বলা হয় বাই। আর ছোটো ছেলেরা যারা অভিনয় করে তাদের বলা হয় বেনাচি বা ব্যাঙাচি। নিজেদের বানানো সংলাপে পালা এগিয়ে যায়। জামাই যাবে শ্বশুর বাড়ি, বোন বড়ো না বউ বড়ো, জয়-বিজয়-এসব পালা নিয়ে লেটো পরিবেশিত হয়। হরকুমারবাবু জানালেন, লেটো মূলত গ্রাম্য ব্যাঙ্গ-রঙ্গ-রস সমৃদ্ধ। তাঁর লেখা প্রথম লেটো পালা ‘নতুন দিনের ডাক’। যদিও ছেলেরা মেয়ে সেজে এ পালায় অংশ নেন, তবু তাঁর দলে দুজন মহিলা শিল্পী রয়েছেন। খড়গপুর অঞ্চল থেকে যাঁরা লেটোর টানে তাঁর দলে এসেছেন, তাঁদের একজন মমতা বাগদি, অন্যজন জ্যোৎস্না বেগম। দুজনেই পেশায় খেত মজুর। লেটো শিল্পীদের অভিনয় আমি দেখেছি। মঞ্চসজ্জা মাইকের ব্যবস্থা ছাড়া তাঁরা যেভাবে সঠিক স্কেলে গান ধরেন বা সংলাপ বলেন, সত্যিই তার তারিফ করতেই হবে। বেঁচে থাকার খাটুনি ভুলে মনের আনন্দ তাই যেন উপচে পড়ে তাঁদের অভিনয়ে, নাচের তালে, তাঁদের নানা অঙ্গ-ভঙ্গীতে। মূলত গ্রামের মানুষকে আনন্দ দিতে এপালাগুলির রচনা করা হয়। তবে প্রতিটি পালায় থাকে মূল্যবোধ এর সঠিক চিত্রণ, কথার মারপ্যাঁচ। মজার মধ্যে দিয়ে লোকশিক্ষণ। হরকুমারবাবুর বয়স প্রায় ৭০-এর কোঠায়। তাঁর সুন্দর গানের গলা, শরীরী অভিনয় এখনও মানুষকে মাত করে।

বর্তমান সরকারের অর্থানুকুল্য এবং সহযোগিতায় তিনি এবং তাঁর দল যথেষ্ট উপকৃত। তিনি হয়তো এখনও কোনো সরকারি পুরস্কার পাননি, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বহু ক্লাব, সংগঠন তাঁকে সংবর্ধিত করেছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কর্মশালায় শিবির পরিচালক হিসেবে ডাকও পেয়েছেন। নতুন প্রজন্মকে লেটোর সঙ্গে যুক্ত করতে তিনি পুজোর সময় পাড়ায় পাড়ায় লেটো পালার অভিনয় করান, যেখানে নতুন নতুন ছেলেরা অভিনয় করেন। হরকুমারবাবুর দলের সবাই প্রায় দিনমজুর। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজন। নিঃসীম রাতে যখন চোখ দুটি ঘুমে বুজে আসে, তখন যে স্বপ্ন তাঁদের চোখে ভিড় করে সেটিই তাঁদের জীবনী শক্তি, তাঁদের জোশ; যার আর এক নাম লেটো পালা। প্রণাম জানাই আপনাদের, আপনাদের সংগ্রামকে কুর্নিশ। শিল্পের প্রতি এই অকৃত্রিম ভালোবাসা আপনাদের নিশ্চয় সফলতা দেবে। তবে শিল্পীর মূল্য সমাজ কখন দেয়, সেটা বলা খুবই কঠিন। আছি আমরা, আপনাদের পাশেই আছি।