কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | পর্ব – ৯

আগে যা ঘটেছিল 

সেদিন সন্ধেবেলায় শ্রীরামপুর শহরটা প্রায় ঝিমিয়ে এসেছিলো, ভরা পূর্ণিমায় গঙ্গায় জোয়ার ভাঁটার খেলা চলে। দিনেমাররা শহর ছেড়ে চলে গেছে বছর চল্লিশ তো বটেই। একলা কিছু কিছু কুটি দাঁড়িয়ে আছে, কিছু ইংরেজদের দখলে। মাহেশের দিকে নৌকো যাবার খুব ধুম, সামনে রথের মেলা।

রোজই এমন সাতপাঁচ দৃশ্য দেখে তরুলতা, বিধবা তরুর সন্ধের পর তেমন কাজ আর কী। হঠাৎ সেদিন তরুর সামনে অন্ধকার ফুঁড়ে এসে দাঁড়ায় কৃষ্ণ যাত্রার নায়ক ননীমাধব, যে গোলাপসুন্দরীর মস্ত বড় ভক্ত। গোলাপ এই শ্রীরামপুরেরই মেয়ে, ননী তরুলতাকে লোভ দেখায় গোলাপ সুন্দরীর মতো বিলাসবহুল জীবনের। সে জন্য ননীর সঙ্গে শ্রীরামপুর ছেড়ে কলকাতা যেতে হবে গোলাপকে। আসলে ননী তার মালিক চন্দ্রবদনকে একজন নায়িকা খুঁজে দিতে চায়। চন্দ্রবদন কথা দিয়েছে নায়িকা খুঁজে দিলেই ননীমাধব থিয়েটারের নায়ক। ননীর অভিনয় ক্ষমতা আছে, খাসা চেহারা, যাত্রায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আছে, নেই কেবল সঠিক সুযোগ। তরুকে দিয়ে সেই সুযোগ নিতে চায় ননী। কিন্তু তরুলতা কী শুধুই তাই ননীর কাছে! শ্রেরামপুরের গঙ্গা থেকে বৈদ্যবাটীর দিকে নৌকো ভাসায় ননীমাধব। সেখানে চন্দ্রবদনের বাগানবাড়িতে মজলিস আছে রাতে। যাবার সময় শেওড়াফুলির বেবুশ্যে পল্লীতে ঢুঁ মারে এককালের কৃষ্ণ যাত্রার এক নম্বর নায়ক ননীগোপাল।

নীলা বন্দ্যোপাধ্যায় 

ননীমাধব আগেও এ পাড়ায় এসেছে। সোনাগাছি, হাড়কাটা গলির চেয়ে প্রাচীন বেশ্যাপল্লী শেওড়াফুলির এই বেশ্যাপল্লীটি, তবু পাড়াটা বড় মলিন। খুপরি, খুপরি ঘর, একখানা করে কুপী জ্বলছে। দরজায় দরজায় যেসব মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের সাজে তেমন বাহার নেই। ঘরের মেয়েছেলেদের মতো আদুর গায়ে তিন ফেত্তার শাড়ি জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ কলকেতার বেবুশ্যে পাড়ার ছেনালগুলো গায়ে জ্যাকেট, মুখে পমেটম, ঠোঁটে আলতা। জ্যাকেট খুলে আদর করার মজাই আলাদা। আর এদের দেখে মনে হয় পুকুরপাড়ে বাসুন মাজতে মাজতে উঠে এলো। অথচ দেকো শ্রেরামপুর কলকেতার চেয়ে কত প্রাচীন শহর, আদব কেতা এখেনেই বেশি হবার কথা।

ননীমাধবের সিল্কের চোগা চাপকান দেখেই বেবুশ্যে মেয়েগুলো বুঝেছিলো কলকেতা থেকে এয়েছে। রথের আগে কলকেতা থেকে বাবুরা খুব আসেন। কেউ কেউ সাত আটদিনের জন্য ভাড়া করে নিয়ে যায় ওদের। তবে এ সময়ে কলকেতার বেবুশ্যেও গিজ গিজ করে, বাবুরা সঙে করে নিয়েই আসেন। রোজগার করার জন্য কসরত বেশি করতে হয় শ্রেরামপুরের বেশ্যাদের। ননীকে দেখেই খুপরি ঘরগুলো থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত ধরে টানাটানি শুরু হয়, সেই সঙ্গে নানান নামে ডাক দেয় ননীমাধবকে। রসের কানাই, রসের কেষ্ট, কলির কেষ্ট। ননী অনেক দেখেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা কার ঘরে যাবে। তারপর ভাবে অতো না ভেবে যে ঘর পাবে ঝপ্ করে ঢুকে পড়বে। তাই করে ও।
কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্যবতী , শ্যামলা, বছর ছাব্বিশ, সাতাশের এক যুবতীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই যুবতী হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঢুকিয়ে নেয় ঘরে। অস্বাস্থ্যকর ঘরখানায় ঢুকে আজ দম বন্ধ লাগে ননীমাধবের। অথচ বেশ্যাবাড়ি যেতে ও দিব্য অভ্যস্থ। ননীর গরম লাগে খুব।
” ঘরে জানলা নেই? খুলে দাও। কী নাম তোমার?”
মেয়েমানুষটি কাঁসার গ্লাসে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেয়।

” আজ্ঞে আমার নাম তুলা বেবুশ্যে, জানলা তো নেই বাবু, ঘুলঘুলি আচে তো”
ননীমাধব দেখে ও যেই চৌকিতে বসেছে তার পেছনের দেওয়ালে ঘুলঘুলি একটা, সাধারণত ঘুলঘুলির যা মাপ হয় তারচেয়ে একটু বড়ই। ননী দেখে তুলা তাকে একটা তেল চিটচিটে বিছানায় বসিয়েছে টেনে তাকে। ননী বিরক্ত হয়।
” চাদর বদলাওনি কেন! খদ্দের এলে এই চাদরে শুতে দাও”
তুলা চট করে খদ্দের পায়না। বয়স হয়েছে, রূপও তেমন নেই, তাই হয়তো। আজ এতো রাতে পাবে আশাও করেনি। তুলা দ্রুত ঘরের কোণে বাঁশের গায়ে ঝুলতে থাকা চাদর নিয়ে আসে পাতবে বলে। ননীমাধব উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়াবেই বা কোথায় চৌকি থেকে নেমেই দরজা। আরেক পাশে রান্নার উনুন থেকে ঠাকুরের সিংহাসন, সংসারের খুঁটিনাটি সব রাখা। তবু ননী ওখানেই দাঁড়ায়, তুলা বেশ্যা ধবধবে সাদা চাদর পাতে, কুপীর আলোতেও বেশ বোঝা যায়। ননী ফিরে এসে খাটে বসলে তুলা খাটের তলা থেকে মাটির হাঁড়ি টেনে বের করে। ননী গাঁয়ে গঞ্জে যাত্রা করার সময় বহু বেশ্যা বাড়িতে রাত কাটিয়েছে। ননী জানে এ পচুইয়ের গন্ধ। ভাত থেকে তৈরি মদ। খেলে জব্বর নেশা হয়, কিন্তু শরীর খারাপ করে খুব। কলকেতার থ্যাটার পাড়ায় চন্দ্রবদনের সঙে ঘুরে ঘুরে হুইস্কি, শ্যাম্পেনের নেশা হয়েছে। এ গন্ধ নিতে পারেনা ননীমাধব।
“আঃ সরাও। বিলিতি মদ নেই?”

অন্য বেশ্যাদের কাছে এতো বায়না করলে গালাগাল খেতো ননীমাধব। তুলার স্বভাবখানা নরম তরম, দুঃখি দুঃখি মুখ। তুলা কেবল দুদিকে ঘাড় নাড়ে। ননী তুলাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলে তুলা গা ঘেঁষে বসে ননীর।
তারপর সে তার শেখা ছলা প্রয়োগ করতে গেলে ননীমাধব বোঝে এ মেয়ে গেরস্ত থেকে বেবুশ্যে হয়েছে। মা ঠাকুমার থেকে বংশানুক্রমে বেবুশ্যে হলে এতো কাঁচা খেলেনা। ননীমাধব তুলাকে জিজ্ঞেস করে গান জানে নাকি। তুলা সম্মত হয়ে একখানা গান ধরে। চটুল গান। গলাটা মিঠে। ননী তবুও থামিয়ে বলে

” লায়লা মজনু বইয়ের গান জানো? ”

তুলা এমনিতেই বুঝতে পারছিলো ননীকে খুশি করতে পারছেনা। এ প্রশ্নে আরও ঘাবড়ে যায়। দুদিকে ঘাড় নাড়লে ননী বলে

“থ্যাটার দেকেচো কখনো? ”

থ্যাটার শব্দটাই তুলা প্রথম শুনলো। আবারও ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনও উত্তর ছিলোনা ওর কাছে। ননী বিরক্ত হয়। বোঝে কলকেতায় যত রঙ্গ আছে শ্রেরামপুরে নেই। ওখানে বহু বেশ্যাই থ্যাটার পাড়ায় কাজ করে আজকাল। ছোট ছোট পাট পেলেও করে৷ এই থ্যাটার পাড়ায় ঘুরে ওদের মধ্যে একটা প্রলেপ এসেছে। একটু গান, একটু নাচ, একটু ইংরাজি, বাংলা অনেকেই জানে।

এদিকে ননীমাধবের চোখ মুখ দেখে প্রমাদ গোণে তুলা, এ বাবুর লক্ষ্মণ ভালো নয়। অনেকেই তুলাকে খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করে পছন্দ না হলে পয়সা না দিয়ে পালায়। তুলা বলে
” ওই গান জানি না জানি পুরো পয়সা দিতে হবে।”

ননী বোঝে এ মেয়েমানুষের কাছে সুখ হবেনা।
“দেবো, এখন একটু ঘুমুবো, খানিকপর ডেকে দিস ঘাটে নৌকো লাগানো আচে।”

ননী গা থেকে সিল্কের পাঞ্জাবিটা খুলে পাশ ফিরে শোয়। দেখে ঘুলঘুলি দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের মধ্যে আবারও তরুলতার মুখ দেখে ননীমাধব। চেয়েই থাকে। হঠাৎ একদলা মেঘ এসে আড়াল করে চাঁদ, বাইরে ঝুর ঝুর করে বৃষ্টি পড়ে। ননীমাধবের চোখ বুজে আসে।

বোজা চোখে ননী স্বপ্ন দেখে সে আর তরুলতা স্টেজের ওপর ডুয়েট গাইছে। কি বই হচ্ছে বুঝতে পারেনা। তবে তরু রাজকন্যার মতো সেজেছে। হঠাৎ দেখে স্টেজের ওপর অমৃতলাল, গিরিশ ঘোষ তরোয়াল হাতে খুব লড়াই করছে তরুলতাকে পাওয়ার জন্য। এরা লড়ে চলেছে এদিকে চন্দ্রবদন তরুকে কোলে তুলে নিয়ে পালাতে যায়। ননী দেখতে পেয়ে পায়ের গোছে এক লাথি মারে। চন্দ্রবদন “ও বাবা গো, মরে গেলুম গো” বলে চিৎকার করতে থাকে। গলাটা মেয়ে ছেলের মতো লাগছে, আবারও লাথি মারে ননীগোপাল। এবারে দ্বিগুণ জোরে চেঁচায় চন্দ্রবদন, তাইতেই ঘুম ভেঙে যায় ননীগোপালের। দেখে তুলা বেশ্যা মাজায় হাত দিয়ে বসে কাতরাচ্ছে। ননীকে দেখে হাঁউমাঁউ করে ওঠে।
“বিশ্বেস করুন বাবু পয়সা নিতুমনে, এমনি কোঁচড়খানা দেখতে ছিলেম, আপনি এতো জোরে নাতি মারলেন কেন!”
ননী বোঝে তার ঘুমের সুযোগে তুলা তার কোঁচড় হাটকাচ্ছিলো। ননী দ্রুত উঠে নিজের পোশাক পরে, খাটের ওপর কটা পয়সা ছড়িয়ে বেরোতে যায়। দ্যাখে বাইরে প্রবল বৃষ্টি। ননী খানিক দরজা ধরে অপেক্ষা করে। বাইরে আর একটাও বেবুশ্যে মাগী দাঁড়িয়ে নেই। বৃষ্টির জন্য সবাই ভেতরে।

একটু বৃষ্টি ধরে এলে ননী ভিজে ভিজে তার মধ্যেই তিনপয়সার ঘাটে আসে। দেখে মাঝি একটা খড়ের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে। ননী ওর পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করে। আজ চন্দ্রবদনের বৈদ্যবাটীর বাগান বাড়িতে মজলিস বসবে। বৃষ্টি না থামলে পৌঁছবে কী করে ভাবে ননীমাধব। কাল সকালে আবার কলকেতায় যেতে হবে একবার। শ্যামনগর, বরাহনগর, বৈদ্যবাটী যে বাগানবাড়িতেই থাকুক চন্দ্রবদন ননীমাধবকে ছুট কাটাবে কলকেতার থ্যাটার পাড়ার খবর আনার জন্য। এই দুদিন আগেই গেসলো। কাল আর নতুন খবর কী থাকতে পারে!

সেই এসে বলতে হবে বিনোদিনীর নতুন থ্যাটার বাড়ি প্রায় শেষের মুখে। অমুক জায়গায় অমুক বই নামছে। দুদিনে কোন খবর আর পাল্টাবে। অবশ্য আগের দিন চন্দ্রবদন সোনার নস্যির কৌট ফেলে এসেছিলো বলে আনতে বিনোদিনীর পাড়ার বেশ্যা কালীমতির কাছে গেছিলো। ওখানে গিয়ে নতুন খবর নিয়ে এসেছে। বিনোদিনীর নাগর গুর্মুখ রায় মুসুদ্দি নাকি বিনোদিনীর কাছে একেবারে আসা বন্ধ করেছে। বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে এমন কথাও বলছে লোকে। ও লোকটা না এলে থ্যাটারবাড়ি আর হবে কি! নাকি সব টাকা আগাম দিয়ে রেখেছে বিনোদিনীর কাছে! অবিশ্যি আগের দিন দেখেছে থিয়েটার বাড়ির গায়ে চুন সুড়কি দিয়ে বি থিয়েটার লেখা হচ্ছে। ননীমাধব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখলে গিরিশ বাবু, অমৃত বাবু আরও কয়েকজন মিস্ত্রিকে এসে বললে বানান ভুল হচ্ছে, লেখা তুলে দাও। যবে আমরা বলবো লিখো। ননী অনেক চেষ্টা করেও বানানের ভুল পায়নি। ওঁরা বিরাট শিক্ষিত লোক। হয়তো কিছু পেয়েছে। নাকি ভেতরে অন্য খবর আছে কে জানে! এসব খবর সে পায়না, কেউই পায়না। বিনোদিনীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে একদিন নিশ্চয়ই এক সঙ্গে স্টেজে নামবে ওরা। ও, বিনোদিনী, গিরিশবাবু। তরুলতাও কি!

তরুলতার কথা আবার মনে পড়ে যায় আজ তার চন্দ্রমাধবের আসরে যেতে ইচ্ছে হয়না। মনে হয় ফিরে যায় তরুলতার কাছে।মাঝে মাঝে ননীমাধবের ইচ্ছে হয় তরুকে নিয়ে সংসার পাতে। বিদ্যেসাগর তো বেধবা বিয়ের জন্য কবে থেকে লড়ে চলেছে। কেউ কিছু বললে ননী নাহয় নিজেকে বিদ্যাসাগরের চেলা বলে পরিচয় দেবে। সমাজে একঘরে হবার ভয় সে পায়না। সে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে ঘুরে ঘুরে কুলি বাগদিদের সঙ্গে যাত্রা করে বলে এমনিতেই সে সংসারে ব্রাত্য। দু দুবার বিয়ে করলো। একটা বউ বসন্তে, আরেকটা মরা ছেলে বিইয়ে সূতিকায় মরলো। মা, বাপ আগেই গেছে। বাপের সম্পত্তি যা ভাগে পেয়েছিলো সব থিয়েটার থিয়েটার করে উড়িয়েছে। তার আর পিছুটান কী আছে। একঘরে হলে হবে ন্যাঙটার নেই বাটপারের ভয়।

আবার ভাবে বিয়ে মানেই তো সেই বন্ধন, সংসারের চাল, ডাল, তেল, নুন, ছেলেপুলে। কিন্তু ননীর স্বপ্ন বাংলা থিয়েটারের মঞ্চ মাতানো, এক নম্বর হিরো হবে সে। আর তরুলতা হবে নায়িকা। দুজনে দিনান্তে থিয়েটার করে বাড়ি ফিরবে। নিজেদের মধ্যে পাট বলবে। তার ডায়লগের খেই হারিয়ে গেলে কিউ দেবে তরু। সে একদিন গিরিশ ঘোষের মতো নাচে, গানে, পরিচালনায় অভিনয়ে বাংলার সেরা নট হবে।
ননীমাধব হঠাৎ মাঝিকে জিজ্ঞেস করে
” মাঝি বিয়ে করেছো?
” বিবিকা দেহান্ত হোগিয়া সাব”
“আর বিয়ে করবে না?”
” নেহি, শাদি মে ক্যা হ্যায়, এইসেহি ঠিক হু, নাও ছোড়ো অউর চলতে রহো”
সংসার কার কাছে যে সমুদ্র, কার কাছে পাঁক আর কার কাছে চোরাবালি বোঝা দায়। যে যেমন সংসারে সমাদর পেয়েছে তার কাছে সংসারের রূপ তেমন।

বৃষ্টি থামলে নৌকো ভাসায় মাঝি। নৌকে এসে লাগে চন্দ্রবদনের গঙ্গার ধার ঘেঁষা বাগান বাড়ির পেছনের ঘাটে। তড়ি ঘড়ি করে নেমে বড় হল ঘরের দিকে যায় ননীমাধব। দেখে মজলিস বসে গেছে। কলকাতা থেকে আসা বাঈজী গান ধরেছে, মল্লার। ইয়ারবকশি নিয়ে সে গান শুনছে চন্দ্রবদন। ফাঁকে তাল মারা, আর বেমক্কা জায়গায় কেয়াবাত শুনেই ননীমাধব বোঝে চন্দ্রবদন কিস্যু বোঝেনি সে গানের। ননীমাধব মুখ দেখিয়ে নিজের ঘরে আসে। কানে বাঈজীর গলা আসে, ঈষৎ পুরুষালি ওস্তাদি কণ্ঠ। চোখ বন্ধ করে একের পর এক গান শোনে ননী। মাঝে মাঝে চন্দ্রবদনের ইয়ারবকশিদের হল্লা আমেজ কাটিয়ে দিচ্ছিলো বটে। কিন্তু গান শুনতে শুনতে দেখে কখন সকাল হয়ে এসেছে। পূব আকাশে হালকা কমলা রঙ ধরেছে। মনে মনে ভাবে তরু কোন সাত ভোরে ওঠে এতোক্ষণে নিশ্চয়ই জপের থলি নিয়ে বসে গেছে। তরুর সাত ভোরে ওঠার স্বভাবটা ভালো। পরে থিয়েটার করলে ডায়লগ মুখস্থ রাখতে কাজে আসবে। ভোরে মুখস্থ হয় ভালো। ননীকেও তরুর সঙ্গে থাকতে থাকতে ভোরে ওঠার অভ্যেস করে নিতে হবে। কিন্তু আজ আর চেয়ে থাকতে পারেনা। চোখ বুজে আসে।

তরুলতাও সেদিন ভোরে রোয়াকের এক প্রান্তে বসে ভাবছিলো। এতো ত্যাগে কী পেলাম সারাজীবন। তবে তো ভোগে বাঁচাই ভালো।ত্যাগে মুক্তি না ভোগে নিশ্চিন্তি তা কি কারও জানা আছে! ভোগীর মন বুঝতেই পারেনা সে ভোগে আছে। আর ত্যাগী ভাবে এতো ত্যাগে কী পেলাম সারাজীবন।

হরি হরি গুণতে হয় জপমালা হাতে নিয়ে। তরুলতার হাতে রাত দিন জপমালা থাক বটে তবে গোণা হয়ে ওঠেনা। হাতে জপমালা নিলেই যেন চোখের মধ্যে আঠার মতো সংসারের নানা দৃশ্য চেপে বসে। আজ যেমন তরু দেখতে পায় অষ্টি দাসী উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে একখিলি পান পোরে মুখে। তরুলতা অবাক হয়ে যায় বিধবা মেয়েমানুষের কাণ্ড দেখে। ঝাঁটা চালাতে চালাতে অষ্টি তরুর সামনে এলে তরু বলে
“অষ্টি তুই না বেধবা, পান খেলি যে বড়ো।”
অষ্টি আঁচলের খুঁট থেকে জর্দা বের করে এক চিমটে মুখে ফেলে থুতু ভর্তি মুখে জবাব দেয়
“পান খেলে কী ক্ষেটি, আমি টো টোমাদের মটো বাউনের বেঢবা নয় আমাদের টলে, আমি টো নস্যিও নিই ”
মুখে পানের পিক ভরা থাকায় অষ্টির অনেক শব্দই ত,স থেকে ট হয়ে যায়।তরুলতা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই পিক উঠোনের এক কোণে ফেলে দিয়ে এসে দাঁড়ায়। তরুলতা মৃদু গলায় বলে
” বেধবার নেশা করতে নেই, জানিস নে?”
অষ্টি হেসে ওঠে তারপর আঁচলের খুঁট থেকে খানিক জর্দা এনে তরুর নাকের কাছে ধরে
“বেনারস থেকে আইনেছেলো দে বাড়ির মেজোবাবু, দেছেন আমায়, শুঁকে দেকো”
তরুলতা মুখ ফিরিয়ে নেয় ঘেন্নায়।
” ছিঃ পাপী মেয়েছেলে, এখেন থেকে যা আমি হরির নাম করচি”
অষ্টি খিল খিল করে হেসে আবার ঝাঁটা ধরে
“হরি হরি, তুমি তো এ জেবনে কোনও পাপ করোনিকো, সতী বেধবা”
কথা কখানা বলেই অষ্টি দাঁত চেয়ে গুণ গুণ করতে থাকে
“মাখন চোরা ননীগোপাল তোমারে দিয়েছি সবরে, হরি হে শ্রী মাধবও”
অষ্টি খিল খিল করে হাসে আর তরুলতা ভয়ে, লজ্জায়, ঘেন্নায় গুটিয়ে যায়। একদিন এ জীবনে তার স্খলন হয়েছিল যার সাক্ষী এই অষ্টি। সেই তরুলতাকে রাজী করায় রাতে দরজা খুলে রাখতে।

তখন গঙ্গার বুক ধরে ঠায় আসতো ননীমাধব। এসে এ জীবন থেকে মুক্তির গল্প শোনাতো তাকে। নতুন সংসার পাতার গল্প বলতো। তরুলতারও ভারি ইচ্ছে হতো নতুন সংসার পাতার। একদিন এক দুর্বল দিনে ননীর ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলেছিলো তরুলতা। ননী কি করে যেন অষ্টি দাসীর সঙ্গে ভাব করে ফেলেছিলো। সে,রাতে ননী আসবে অষ্টিই খবর দেয়। রাতে দরজা খুলে ফাঁকা বিধবা মহল্লায় অপেক্ষা করে তরু। ননী এসে লাল শাল জড়িয়ে দেয়। সেই প্রথম জ্ঞানত লাল রঙ গায়ে ওঠে তরুলতার। সারা রাত আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে ননী তরুকে।
ভোর রাত্তিরে নৌকো ভাসিয়ে চলে যায় বরাহনগর।

ভোরবেলা অষ্টি এলে ভয়ে কেঁদে ফেলে। বলে
“অষ্টিরে, কি পাপ করলেম, তুই কেন আটকালি না। যদি কিছু হয়”
অষ্টি অবাক হয়ে দেখে তরুলতার দিকে।
” কি হবে!”
যদি কোনও পাপ পেটে আসে।
অষ্টি খিল খিল করে হেসে ওঠে।
” বিছানা তো সাফ সুতরো। এখনও সতীচ্ছদ হয়নে, তবু একটা শেকড় দেবো খেও, ভয় পেউনি। ননী বাবু পনেরো দিন বাদে আবার আসবেন কয়েচেন”

পনেরো দিন বাদে ননীমাধব আসে। ভিন্ন ননীমাধব। এসে বলে
“সংসার করে কি হবে, আমার সঙে কলকেতায় চল, দুজনে মিলে থ্যাটার করবো”
তরুলতা বোঝে মস্ত ঠকে গেছে সে। নিজের ওপর ঘেন্না হয়। সে ঘেন্না আজও যায়নি। তবু ননীমাধবের কটা কথা কানে বাজে
“ওরে নিজের টাকা, নিজের বাড়ি, নিজের নাম থাকার সুখই আলাদা। আশ্রয়ে থেকে সে সুখ পাবিনে, স্বামীর আশ্রয়ও তো আশ্রয়ই। নিজের সম্মান থাকে তাতে”

তরুলতার কথাগুলো মনে পড়লে অষ্টিকে বলে
” হ্যাঁরে অষ্টি বেতন পেতে কেমন লাগে?”
অষ্টি উত্তর দেয়
“বাড়ি বাড়ি খেটে মাসের শেষে যখন পয়সা কটা হাতে পাই নিজের জেবন সাত্থক মনে হয়। তোমরা যারা বিন মাইনেতে খাটো সে সুখ বুঝবেনে, আচ্ছা রেতে ননী বাবু এলে একবার দেকা করো।”
তরুলতা জবাব না দিয়ে জপমালার থলিতে হাত ঢুকিয়ে হরি হরি গুণতে থাকে।”
হরি নামের গুণগুণের সঙ্গে অষ্টির ঝ্যাঁটার কর্কশ স্বর মিশে যেন অপেরার কন্সার্ট তৈরি হয়।

ক্রমশ…

16 thoughts on “কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | পর্ব – ৯

      1. ‘ হরি নামের গুণগুণের সঙ্গে অষ্টির ঝ্যাঁটার কর্কশ স্বর মিশে যেন অপেরার কন্সার্ট তৈরি হয়।’ —- osadharon … ki je bhalo lagchhe… abar porer porber opakhyay roilam…

  1. অসাধারণ ! অতীত যেন কথা বলছে!

    1. বাহ। আমাদের আগ্রহ ও উৎসাহ বাড়ছে ধীরে ধীরে।

  2. খুব সুন্দর লেখা, যেনো ওই সময় তে চলে গেছিলাম পড়তে পড়তে

  3. দারুণ লাগছে কিন্তু আজ আর একটু কম লেখা পেলাম মনে হচ্ছে, আসলে পাল তোলা নৌকোর মতো গতি পাক এটাই ভাবি সব সময়, তাই মনে হচ্ছে আর একটু বেশি হলে ক্ষতি????
    অপেক্ষায় রইলাম পরের কিস্তি র 👍

  4. এই লেখার চলচিত্রায়ন হওয়া উচিত, প্রতিটা শব্দ সংলাপ এক রেখে। অসামান্য লেখা!

  5. যে যেমন সংসারে সমাদর পেয়েছে তার কাছে সংসারের রূপ তেমন।
    মোদ্দা কথা এই।
    চলতে থাকুক। সঙ্গে চলি। নেশা হয়ে গেছে।

  6. অসম্ভব ভালো একটা লেখা। বড় তাড়াতাড়ি যেন শেষ হয়ে যায়।

    1. পান মুখে দিয়ে কথা কেমন হতে পারে তোমার কলম ছাড়া পড়ার সুযোগ পেতাম না নীলা। স্বকর্ণে সংলাপ শুনলাম। চমৎকার এগোচ্ছে।

    2. অসাধারণ লেখা. চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি প্রতি টি দৃশ্য. এ লেখা নিয়ে যেন সিনেমা হয় কোনোদিন

Comments are closed.