প্রসাদ দাশগুপ্ত
এবার নতুন বছরটি শুরু হলো একটা বেশ উপভোগ্য নাটক দেখার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। গত ২ জানুয়ারি ২০২২ রবিবার অশোকনগর নাট্যমুখ-এর কর্ণধার অভি চক্রবর্তীর গৃহ-অভ্যন্তরে গড়ে তোলা ” অমল আলো ” অডিটোরিয়ামে চন্দননগরের নাট্যদল “স্বপ্ন নীড়” প্রযোজিত এবং শ্রীরূপ শেঠ রচিত ও নির্দেশিত “চোখ” নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। স্বল্প দর্শকাসনে উপস্থিত প্রকৃত নাট্য-প্রেমীরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকটি পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করেন। যে যে কারণে তা হলো, যে অতি পরিচিত একটি বিষয়কে সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে নাট্যকার এখানে উপস্থাপন করেছেন।
একটি অভিনব প্রায়োগিক কুশলতায় শুরু করে নাটকটির সাথে দর্শকদের অভিনিবিষ্ট করতে ছ’জন তরুণ-তরুণীকে ব্যবহার করা হয়, বলা যায় শুরুতেই বিশেষ চমক।
এরপরই নাটকের মূল পর্ব শুরু হয়। বিশিষ্ট চক্ষু-চিকিৎসক প্রিয়তোষের বাড়ির ড্রয়িং-রুমে তারই আমন্ত্রণে স্কুল শিক্ষক অনিকেতবাবু এসেছেন। এই চিকিৎসকের স্বাভাবিক জীবনের পাদ-প্রান্তে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো তার এত খ্যাতি-পসারের মধ্যেও একটা নৈর্ব্যক্তিক বিভ্রান্তির বাতাবরণ তাকে আলোড়িত করে রাখে তা আলোচনার জন্য তারই সহকারী গোবিন্দকেও তিনি ডেকেছেন। এই আলোচনার হয়তো একটাই উদ্দেশ্য, যদি নিজের মধ্যে প্রতিনিয়ত গ’ড়ে ওঠা মেকি সমাজের ইমারতটা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলে একটা পথ-নির্দেশ পাওয়া যায়।
চোখ হলো আমাদের দর্শণেন্দ্রিয়। আমরা দুটি চোখ দিয়ে দেখি। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে এই দেখার মধ্যেও আছে একটা সুচিন্তিত পরিকাঠামো। ডাক্তারের পরলোকগতা মায়ের চোখ দিয়েই প্রিয়তোষ এখনও চারপাশের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় দেখেন এবং বিচার করার চেষ্টা করেন। তাই সমাজের কদর্য রূপ যা সুস্থ জীবনের পরিপন্থী তা তিনি সহ্য করতে পারেননা। তার সাথে একমত পোষণ করলেও শিক্ষক অনিকেতবাবু বোঝেন, সমাজের শাসক-শ্রেণির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা যায়না। কারণ অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে না চাইলেও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা ক’রে তিনি ফেল করা ছাত্রকে একদিন পাশ করিয়ে দিতে বাধ্য হন।তিনি জানেন তার মুখে নীতির কথা বড্ড বেমানান, কিন্তু প্রিয়তোষবাবুর সঙ্গে সহমতপোষণ করা থেকেও পিছিয়ে আসতে যে মন সায় দেয়না! ভয়ই যে আমাদের হীণ-সর্বস্ব কাঠের পুতুলে পরিণত করে। এই সত্যকে ডাক্তারবাবু স্মরণ করালে গোবিন্দবাবু কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেন, তিনি ঐ গুন্ডাগুলোকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের ক’রে দিতে পেরেছিলেন। যারা অন্যায়ভাবে তার মুসলিম জামাইয়ের বাইকটা গায়ের জোরে পেতে চেয়েছিলো।
হঠাৎ প্রশাসনের পুলিশ মহিলা আধিকারিকের আগমনে ঘটনাটা অন্যদিকে মোড় নেয়, যদিও পরবর্তীকালে ওনার মুখে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী কথা শুনে তিনজনই একটা আশার আলো দেখতে পান। দৃষ্টিটা স্বচ্ছ থাকলে এই সমাজকে তলানি থেকেও টেনে তোলা যায়।
হঠাৎ অল্প আলোয় দেখা গেলো সেই তরুণ-তরুণীরা লাল-কালো রং-এ মুখ কদাকার ক’রে পাপের প্রতিভূ হয়ে মঞ্চে উদ্দাম নৃত্য শুরু করলো এবং সবার চোখে ফেট্টি বেঁধে নিজেদের কলুষিত সমাজের বিষ-বাক্যগুলিই ওদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম। কিছুক্ষণ আগেও যাদের মুখে ছিলো, সমাজ পরিবর্তনের জন্য আত্মত্যাগের উচ্চকিত ঘোষণা, তাঁরাই ঘৃণ্য আত্মসমর্পণে নিজেদের সত্তা হারিয়ে ফেললো,একমাত্র ব্যতিক্রম গোবিন্দবাবু, যিনি দু’হাতে চোখের আবরণ ছিন্ন ক’রে নতুন আলো দেখতে চাইলেন, তিনি সমাজের পাশব-প্রবৃত্তির কাছে মাথা নত করেননি বলেই শেষ পর্যন্ত ঐ শয়তানেরা পর্যুদস্ত হলো।
একটা সদর্থক চরিত্র হয়ে গোবিন্দবাবু বেঁচে রইলেন নাট্য-প্রেমীদের হৃদয়ে। অদ্ভুত চিন্তা-চেতনার কষ্ঠিপাথরে নির্ণীত একটি ঠাস-বুনোট নাটক উপহার পাওয়া গেলো এই সন্ধ্যায় তাও অশোকনগর অমল আলোয় বসে। সাবলীল অভিনয়-সমৃদ্ধ এই নাটকে বিশেষ নজর কেড়েছেন চক্ষু চিকিৎসকের ভূমিকায় প্রিয়তোষ-চরিত্রের অভিনেতা প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত। এছাড়া অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের শেষ দৃশ্যের কোরিওগ্রাফি যথেষ্ট প্রশংসার্হ। ছোট নাটকের শরীরে এত শক্তি ধরে অনেকদিন পর আবার আঁচ পেলাম।ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করতে দম লাগে। যে দমে ঘাটতি নেই শ্রীরূপের। একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার নাটককে উপস্থাপন করতে চাই দম। শাসকের চোখে চোখ রেখে সত্যি কথা বলতে চাই সাহস। যা আমরা অনেকেই আজ হারিয়েছি।যে কারণেই হোক। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে যখন কেউ পিছিয়ে নেই তখন গাটের কড়ি খরচ করে স্বপ্ন নীড় সত্যিকার স্বপ্ন দেখতে পিছিয়ে থাকবে কেনো? স্বপ্ন বোনা চলতে থাকুক, চলতে থাকুক ঘৃণিত অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। আজ না হোক কাল আসবেই জয়।
সবশেষে নাট্যকার-পরিচালক শ্রীরূপ শেঠ মহাশয়কে জানাই অকুন্ঠ অভিনন্দন।
“স্বপ্ন নীড়” নাট্যদলটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
স্বপ্ন নীড় দলের চোখ নাটকটি সত্যিই একটি সাহসী রাজনৈতিক স্যাটায়ার। প্রসাদ দাশগুপ্তদার প্রথম অমল আলো তে আসা একটা মতামতও সঙ্গে পাওয়া গেলো।