অশোকনগর পত্তন থেকে আজকের সংস্কৃতি চর্চা – ধারাবাহিক ৬

অসীম দাস

বৈগাছি

এই পর্বে আগে একটু পুরনো বৈগাছি বা বাইগাছির গল্প দিয়ে শুরু করি। পরে পশ্চিম বাইগাছির কথা আলোচনা করছি। অনেকের জানা হয়তো আবার অনেকের অজানাও হতে পারে।
হাবরা ২ ব্লকের মৌজা বাইগাছি , (Jurisdiction List- 65) গ্রামের নামও বাইগাছি। ব্রিটিশদের বিমানঘাঁটি করার আগেও এই নামই ছিল। এবং পরেও বাইগাছি এয়ার ফিল্ড ঠিকানা ছিল বহুদিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাণীপুরে ব্রিটিশ সেনাছাউনি ও সামরিক যুদ্ধ বিমানের ঘাঁটি তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধের পরে সেনাদের ফেলে যাওয়া এক হাজার বিঘা জমিতে বৃহত্তর বাণীপুর গড়ে ওঠে। বাণীপুরের নাম অবশ্য তখন ছিল ‘বৈগাছি’। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অখ্যাত ওই গ্রামের নাম পরিবর্তন হয় পরবর্তিতে।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এই বিস্তীর্ণ ভূমির কিছু অংশে গোবরডাঙ্গা জমিদারদের এবং কিছু অংশে ধান্যকুড়িয়া জমিদারদের কিছু এস্টেট ( Estate ) ছিল। এস্টেট হল জমিদারী অংশের কিছুটা অংশ যা কয়েকটি পরিবারবর্গ বা অংশীদারদের তদারকি করবার ভার দেওয়া হতো। এরকমই হাবরার বুকে আশ্রাফাবাদ এস্টেট নামে একটি এস্টেট ছিল। এই এস্টেটটি ছিল তরফদার পরিবারের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৎকালীন হাবরা থানার যে ১৬ টি গ্রামকে মাত্র ৭ দিনের নোটিশে উচ্ছেদ করা হয় তারমধ্যে এই আশ্রাফাবাদ এস্টেটটিও ছিল। এই এস্টেটে মূলত মুসলিম ধর্মসম্প্রদায়ের বসবাস। আশ্রাফ কথার অর্থ- শিক্ষিত ধনী সম্প্রদায়।
কারো মতে তরফদারদের বংশধর সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তি আশ্রাফ আলী তরফদারের নাম অনুসারে আশ্রাফাবাদ নামকরণ।  এর থেকে অনুমান করা যায় যে বৃহত্তর হাবরার মুসলীম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই তরফদারেরাই ছিল অন্যতম শিক্ষিত ও ধনী সম্প্রদায়। শুধু যে শিক্ষা এবং ধন সম্পদের জন্য এরা মান্যগণ্য ছিল এমনটাও নয়। এরা ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী। তার প্রভাব যে শুধুমাত্র হাবরা তাও কিন্তু নয়। কারণ, সুদূর দিল্লির মোঘল বাদশাহ সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে এঁরা লাভ করেছিলেন ‘পাঞ্জা’।

মোঘল আমলে পাঞ্জা ছাপ দেওয়া কোনও বাদশাহি সনদপ্রাপ্তি বা ভূমিদানের স্মৃতিকেই বংশ গৌরব হিসেবে ধরে রাখার জন্য পাঞ্জা ছাপ দেওয়া হতো। যাঁদের কাছে এই পাঞ্জা থাকত তাঁরা সমাজে বিশিষ্ট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করত। তরফদার পরিবারের কাছে পাঞ্জা থাকার সুবাদে তাঁরা অতি সহজেই বাদশাহ দরবারে পৌঁছুতে পারতেন। পাঞ্জাটির সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় ১৯৬৪ এ রায়টের সময় হারিয়ে যায়। তরফদার আমলের একটি নিদর্শন, চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি গম্বুজ এখনো বাণীপুর জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজের পাশে বর্তমান। এই গম্বুজকে সামনে রেখে সমবেত নামাজ পাঠ চলত তখন। ১৯৪২ সালে মিলিটারি ক্যাম্প করার জন্য জায়গাটি ব্রিটিশ সরকার অধিকগ্রহণ করে।

কালের নিয়মে এই পরিবার আজ নিঃস্ব। বিট্রিশ উচ্ছেদের পর এবং দেশভাগের পর ছড়িয়ে পরে এই পরিবার। এই পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন একসময়ের বৃহত্তর হাবরার একমাত্র এম.বি ডাক্তার ইসমাইল তরফদার। যিনি একসময় হাবরা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বর্তমান হাবরা থানা এই তরফদার পরিবারের জমিতেই গড়ে উঠেছে।

বাইগাছি

১৫ ও ২২ নম্বর পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডের অংশ বিশেষ নিয়ে তৈরি বর্তমান বাইগাছি অঞ্চল। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডটি সাধারণ মানুষের জনমত নিয়ে ১৯৮১ সালে গঠন। উন্নয়নের প্রসারে অশোকনগর কল্যাণগড় পৌরসভার সীমানার সাথে যুক্ত হয় নতুন ২২ নম্বর হিসেবে ১৯৯০ সালে একটি ওয়ার্ড তৈরি হয়। এলাকা হিসেবে শ্রমলক্ষ্মী কলোনি, আদর্শপল্লী, কালীনগর, মানিকতলা এবং বাইগাছি নিয়ে অশোকনগর কল্যাণগড় পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অশোকনগর থানা হওয়ার আগে প্রশাসনিক আইন শৃঙ্খলা পরিচালনা হতো বাইগাছি ফাঁড়ি থেকেই। তখন এই ফাঁড়িটি অবশ্য হাবড়া থানার অধীনে ছিল। প্রশাসনিক অঞ্চল এত বড় হয়ে যাওয়াতে ১৯৭৯ তে অশোকনগরে একটি শাখা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। নাম দেওয়া হয় বাইগাছি ফাঁড়ি। তখন শুধুমাত্র সেখানে জেনারেল ডাইরি নেওয়া হতো। বড় কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে হাবড়া থানায় পাঠাতে হতো। বারাসাত সাব ডিভিশনের অধীনে ২০০০ সালে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে উত্তর চব্বিশ পরগণায় প্রশাসনিক স্তরে নতুন একটি থানার প্রতিষ্ঠা হয়। নাম অশোকনগর থানা। বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন পুলিশ মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অশোকনগর থানার উদ্বোধন করেন।

পূর্বের ইতিহাস অতল তলে তলিয়ে যাওয়া কথা, মুখে মুখে শোনা গল্প সে সব ছিল ভয়ংকর দিনের কথা। আজ থেকে চারশো বছর আগে, চারিদিকে বাওর আর সারি সারি গাছেরা দোল খেত ইচ্ছে মতো। বাইগাছি স্কুলের মাঠ থেকে গুমা স্টেশন দেখা যেতো পরিষ্কার। গ্রামের মানুষ হেঁটে গুমোর হাটে যেতো। বাইগাছি পূর্বপাড়াতে মোল্লাদের বসবাস ছিল একদম যশোর রোড পর্যন্ত। যেখানে মানিকপিরের মাজার ছিল। মাজারটি এখন অবশ্য নেই। স্বাধীনতার পরে মানুষ বিনিময়ের সময় অনেক মোল্লা পরিবার ঘর বাড়ি ছেড়ে ওপার বাংলায় চলে যায়। ওই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় মানিকনগর। মাঝখানে ব্রাহ্মণ ঘোষ বাগদিদের বসবাস ছিল যুগ যুগ ধরে। এখানকার জমিদার ছিলেন অধরনাথ ব্যানার্জী। আজো সেই দোতলা বাড়ির অস্তিত্ব চোখে পড়ে। হাবড়াতে সবটাই মুসলিম অধ্যুষিত থাকলেও, অশোকনগর (যা আগে বাইগাছি, মমিনপুর ও তাবেরিয়া নামক তিনটি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল) এখানে যথেষ্ট হিন্দু লোকের বাস ছিল এবং পরে ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ( হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, যিনি দীর্ঘ দিন গুমা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন)। এই অঞ্চলের বহুপুরাতন যাত্রা দল ‘আমরা ক’জন’ নাট্য সংস্থা হিন্দু- মুসলমান অভিনেতারা মিলে এবং মহিলা অভিনেত্রী ভাড়া করে বাঁশের মাচা বেঁধে নিয়মিত অভিনয় হয়েছে বাইগাছি প্রাইমারি স্কুল মাঠে। নেতৃত্ব দিয়েছেন মৃগাঙ্ক ব্যানার্জী। অশোকনগরে যাত্রা নাটকের মেকআপ পোশাকের একমাত্র দোকান ছিল আট নম্বরে, তপন সাজঘর। আজ অবশ্য দোকান নেই। তবে নাম বদলেছে। এখন মা মনসা সাজঘর নামে তপন সাজঘরের প্রতিষ্ঠাতা সুখরঞ্জন দত্তের মেঝো ছেলে মানিক দত্ত সেই পরম্পরা আজো ধরে রেখেছেন।

আটের দশকে বাইগাছি ধানকল অঞ্চলে গ্রুপ থিয়েটারের একটি দল তৈরি হয়েছিল, নাম ‘অকিস’। অশোকনগর কিশোর সংঘ। শংকর আচার্যর নির্দেশনায় অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
সহযাত্রী নামে একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থাও ছিল। শংকর আচার্যর পরিচালনায় নাট্যকার রতন ঘোষের সমুদ্র সন্ধানে, মনোজ মিত্রর নৈশভোজ প্রভৃতি নাটক প্রযোজনা করেছিল। দলদুটির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। সত্তরের দশকে মিলনী সংস্থার প্রযোজনা সম্পূর্ণ মহিলা শিল্পী নিয়ে অমর আচার্যর নির্দেশনায় নিমাই সন্ন্যাস গীতিপালা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। অমরসুখ নামেও একটি গ্রুপের জন্ম হয়েছিল অমর আচার্যর মৃত্যুর পর।

এই অঞ্চলের বাসিন্দা তখন বেশিরভাগ স্থানীয় মুসলিম। বলা যেতে পারে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। কেউ কেউ ‘ মিনি পাকিস্তান বলে বাইগাছিকে জানত!’ ছোট বড় মিলিয়ে তিনটি মসজিদ, একটি গির্জা (যেটি কালীনগরে অবস্থিত) ঘেরা হিন্দু- মুসলমান- খ্রিস্টান পরিবার পাশাপাশি বসবাস এখন। স্বাধীনতার আগে থেকেই জেলেপাড়ায় ( বর্তমানে বাইগাছি চৌমাথার পাশেই হরিতলা) পারুইরা গাজনের আসর বসাতো। যা অশোকনগরে এখনও পর্যন্ত কোথাও চরকের উৎসব, ঝাঁপ হয়না। একমাত্র হরিতলায় জেলে পারুইদের ঘরের মানুষরা গ্রামের, সংসারের মঙ্গল কামনায় এই গাজনের উৎসব করে। ভয়ংকর শিব রুষ্ট হলে সেই সন্ন্যাসীর কপালে দুর্ভোগের অন্ত নেই। যতক্ষণ শিবলিঙ্গের মাথায় দেওয়া একেক জনের নামে এক একটি ফুল না ঝড়ে মাটিতে পরছে ততক্ষণ সেই সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্যে ভোলানাথের কাছে কাতর মিনতি চলে আজও। গাজন উপলক্ষে মাটির তৈরি বিশাল একটা মাটির কুমীর হা করে থাকে বহুদিন। তারপর ভয়াল কালবৈশাখীর ঝড় বৃষ্টি এসে ধুয়ে একাকার হয়ে যায়। তাই চৈত্রের শেষে আজও মানুষ ভিড় করে ডণ্ডি কাটে, মানত করে বুড়োশিবের কাছে। এখন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে। মেলায় পসার জমায়। বাঁশের ঝাঁপী থেকে ভক্তের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া ফলমূল কুড়িয়ে নেওয়ার হুড়োহুড়ি আজও চলে। এই এত বড় বাইগাছি অঞ্চলে হিন্দু মন্দির বলতে একমাত্র এখানেই ছিল। পড়ে অবশ্য স্থানীয় হিন্দু মানুষজন রাস্তার মোড়ে মোড়ে শনি- কালী মন্দির নির্মাণ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ম নিগমের শিল্প তালুক গড়ে উঠেছে সরকারি উদ্যোগে এই অঞ্চলের বাদামতলায়। ছোট-বড় অনেক গুলো কারখানা আছে। অনেক মানুষের কাজের সংস্থান হয়েছে। অশোকনগর বরাবরই রকমারি ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। শাঁখা, টোপর ইত্যাদি তৈরি করেন অনেকে। প্রস্তুত হয় গয়না রাখার বাক্স, চিরুনিও। ওই সব শিল্পের সঙ্গে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ জড়িত। কিন্তু নানা কারণে শিল্পগুলি মৃতপ্রায়। সেগুলিকে বাঁচাতে এলাকায় একটি শিল্পতালুক প্রয়োজন তাই সরকারি আশ্বাসে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের জমিতে এই ক্ষুদ্র শিল্পের হাব গড়ে ওঠা। পাশেই বহু পুরাতন হাতে টানা তাঁতকল ছিল। আজও আছে তবে স্মৃতি হয়ে। নরেন্দ্রপুর মিশনের সহযোগিতায় রয়েছে রামকৃষ্ণ সংঘ। শিশু শিক্ষার পাশাপাশি চোখের চিকিৎসায় কলকাতার চিকিৎসক মেলে সপ্তাহে দুইদিন। তার পাশেই আরো একটি ক্ষুদ্র শিল্প ছিল কয়লা তৈরি হতো। আজ সেই কারখানা ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে।  অশোকনগরে ধান থেকে চাল করার জন্য কারখানা একমাত্র পুরনো ধানকল তৈরি যে নামে আজও নৈহাটি হাবরা রোডে একটি বাস স্টপেজ গড়ে উঠেছে। বর্তমানে পাশেই গড়ে উঠেছে প্লাস্টিক কারখানা।  ২০১৮ সালে বিদ্যাধরী খালের পাড়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতে প্রথম খনিজ তেলের খনির মেলে অয়্যাল এন্ড ন্যাচরাল গ্যাস কর্পোরেশন (ওএনজিসি) সংস্থার অনুসন্ধানে। বর্তমান কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক তেল উত্তোলন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন এবং উৎপাদন শুভারম্ভ ওইদিন থেকেই শুরু।

বাইগাছি আদিবাসী সর্দার পাড়ায় হেমাঙ্গ সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে বুলা ব্যানার্জী স্মৃতি মঞ্চ তৈরি হয়েছে ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ সালে। উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। প্রতিষ্ঠাতা তাপস ব্যানার্জী। সেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রতি বছর দুই বাংলার নাট্য ভাববিনিময় উৎসবের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের সংস্কৃতির আদান প্রদান হয়ে চলেছে।

3 thoughts on “অশোকনগর পত্তন থেকে আজকের সংস্কৃতি চর্চা – ধারাবাহিক ৬

  1. অত্যন্ত পরিশ্রমী জরুরি অনুসন্ধান। সকলে তথ্য দিয়ে এ লেখাকে সহায়তা করুন। অনেকানেক ধন্যবাদ।

  2. সমৃদ্ধ হলাম। নিজের জেলাকে নিয়ে অনুরূপ একটি সন্ধানে অনুপ্রাণিত হলাম।

Comments are closed.