দীপা ব্রহ্ম
এ যেন এক প্রাচীন স্থাপত্য। এক সময় লোকসমাগমে জমজমাট ছিল। পাইক, বরকন্দাজ, আদালি, দাসী, বাঁদি, রাজা, উজির। কথার পাহাড়। হরেক শব্দ, হরেক কন্ঠ, হরেক মেজাজ। এক একটা দিন, এক একটা জীবন্ত দলিল। এক একটা রাত হলুদ আলোর রোশনাই। বাঈজীদের পায়ের কিঙ্কিণি, তাদের সৌন্দর্য, মাত করা নৃত্য কৌশল, অঙ্গের সুবাস। একদিকে এই বাঈ বিলাসিতা অন্য দিকে গৃহকর্ত্রীর ধনুকভাঙা পণ। চোখের সামনে নিজের মানুষটিকে হারিয়ে যেতে দেখার অমোঘ পরিণতি। দিন দিন শ্বাস-প্রশ্বাসের দীর্ঘতা বৃদ্ধি। বড়ো অদ্ভুত এই উত্থান-পতনের ইতিহাস। আগে ছিল, এখন আর নেই। আচ্ছা, এতো কথা, এতো চলনের আঁকিবুকি কেন এল মনে? একটা অনুষঙ্গ খুঁজে নিতে বোধহয়। আজকের প্রতিবেদনের সঙ্গে এ সদৃশ্যের খোঁজটা একান্ত আপনার।
আজ লিখছি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের সুন্দরী জেলা জলপাইগুড়ির অন্যতম একটি লোকঘ্রাণ পালাটিয়া নিয়ে। অভিনব এর বিষয়। নাগরিক চাপান উতোর, ছলাকলা, আভিজাত্যের যার ধারে না এই লোক প্রকাশটি। একেবারে নিজস্ব ঢঙে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে পরিবেশিত হয় পালাটিয়া। এটি জলপাইগুড়ি ও সংলগ্ন অঞ্চলের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় লোক নাটক। পালা অর্থাৎ লোকনাট্যের গল্প বা কাহিনি থেকেই পালাটিয়ার সৃষ্টি বলা যেতে পারে। পালাটিয়া নেহাতই উৎসবকেন্দ্রিক। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, মেলা উপলক্ষ্যে সারা রাত চলে পালাটিয়ার আসর। পাঁচালি গান বা ধর্মগান পালাটিয়াকে নির্দিষ্ট করা হয়। আবার সব পালাটিয়াই ধর্মগান নয়। ফসল বোনা তোলার ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে এ পালাটিয়া হয়। গীদল, গাইন, বাইন ফকির, পথচারী, জোকার, ছোকরা, ভাঁড়, চাকর, নানা চরিত্রের মানুষ নানা উপস্থাপনায় এ পালার সঙ্গে যুক্ত। ছোকরারাই মেয়ে সেজে পালায় অংশ নেয়।
এর মধ্যেই কথা হলো সড়কটারি পালাটিয়া সংস্থার সঙ্গে যুক্ত শিল্পী রতিকান্ত রায়-এর সঙ্গে। পিঠেপুলি উৎসবকে কেন্দ্র করে পালাটিয়ার আসর বসান তাঁরা। বিভিন্ন দলের মধ্যে পালা প্রদর্শন করে চলে প্রতিযোগিতা। তবে কার পালা ভালো হলো সে বিচার দর্শকরাই করে থাকেন। জানলাম নানা ধরনের পালাটিয়ার কথা। সত্য ঘটনা অবলম্বনে খাস পাঁচাল, কল্পনার গল্পের ওপর ভিত্তি করে রঙ পাঁচাল ও পৌরাণিক পালা নির্ভর মানপাঁচাল। রতিকান্ত রায় একটি পালার পালাকার। পালাটির নাম বারোগালি শাকুয়াঢ়েনা।
মহিলাকেন্দ্রিক এ পালার মূল চরিত্র বারোগালি ঘরজামুতা (ঘরজামাই) রাখে এক ছেলেকে। একদিন গ্রামের এক প্রশাসনিক ভবন থেকে ‘জিআর’ আনতে গিয়ে বারোগালি আবিষ্কার করে তার স্বামীর নামের জায়গায় তার ঘরজামুতা (জামাই) শাকুয়াচেনার নাম রয়েছে। তখন সেই বিধবামহিলা খুবই বিব্রত হয়। এই রঙ্গরসাত্মক কাহিনি নিয়ে অভিনয় হয় পালাটিয়ায়। আগে এই পালাগুলিতে হারমোনিয়াম, কর্তাল, আখড়াই সহযোগে নাচগান হতো। এখন কর্নেট, ফুট ড্রাম, ক্যাসিও ব্যবহৃত হয়। কখনো ভাওয়াইয়া সুরে গানের সঙ্গে সংলাপ পরিবেশিত হয়। দেবতাকে স্মরণ করে বন্দনা দিয়ে শুরু হয় পালা। রতিকান্ত রায় জানালেন, তারপর তাদের মধ্যে এক নেতা-গোতা গোছের মানুষ পালার নাম ঘোষণা করে। শুরু হয় পালা। নাচ-গান, কখনো সংলাপ সহযোগে পালা এগিয়ে চলে। কোথাও এক পালা, কোথাও দুই পালা আবার কোথাও বা পালার সংখ্যা থাকে তিন।
এক অদ্ভুত বিশ্বাস তাঁর কথায় ফুটে উঠল। প্রথম পালা অভিনয়ের পর, দ্বিতীয় দল যখন অভিনয় করতে যায় তখন ‘ছিনো’ (পাতা চট) উলটে নেন তাঁরা। কারণ আগের দল যদি কোনো তুক তাক করে তার প্রভাব যাতে তাদের পালায় না পড়ে। ভারি মজার এই রীতি বটে। বলা বাহুল্য, এ হলো গ্রামের মানুষের অতি সরল বিশ্বাস। পালাটির নাচের সঙ্গে বাংলা খেমটা নাচের খানিক মিল আছে। শিল্পী রতিকান্ত রায় প্রায় ২০ বছর পালাটিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এখন তাঁর বয়স ৬০-এর বেশি। তিনি জানালেন এ অঞ্চলে পালাটিয়ার আসর খুব কমই বসে। তেমন দলও নেই।
তবে তাঁর বিশ্বাস আবার কখনও মানুষের মধ্যে নিশ্চয় পালাটিয়া দেখার চাহিদা বাড়বে। নিজেকে সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে রাখতে তাই বাধ্য হয়ে কখনো তিনি বিষহরা পালা করতেও চলে যান। তিনি কোনো সরকারি ভাঙার অন্তর্ভুক্ত নন। তাঁকে পাশাপাশি কৃষিকাজও করতে হয়। রতিকান্ত রায়ের বাবা তরণীকান্ত রায় ছিলেন একজন খোলবাদক (খুলি)। এহেন শিল্পীদের জন্য বর্তমান সরকার যে আর্থিক সুরাহার ব্যবস্থা করেছেন শিল্পী রতিকান্ত রায়ের মতো আরও শিল্পীদের মুখে হাসি ফোটাতে বা মনে বল জোগাতে তা যেন একটা পরিপূর্ণতা পায় এই আশা রাখি। যে মানুষগুলির মনের তাগিদ আর অর্থের আনুকুল্যের দাঁড়িপাল্লা কোনোদিনই এক সমতলে থাকে না তাঁদের জন্য আমার এই ক্ষুদ্র কলম না হয় একটি যোজক হয়েই থাক। এটুকুই আমার প্রাপ্তি, মনে করব একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে।
😃
গ্রামীণ আনন্দ সন্ধ্যার এই আসর আসলে সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর নিজেরা নিজেদেরকে এবং গ্রামের মানুষকে রস আস্বাদন করানোর এই প্রচেষ্টা থেকে সৃষ্টি। আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক এই সব লোকসঙ্গীত বা লোকভঙ্গিমায় মনমাতিয়ে পালার পর পালা গান গেয়ে আজও ছেলেরা রঙ মেখে শাড়ি চুল লাগিয়ে নেচে গেয়ে মনোরঞ্জন করে। এখন এইসব পালায় আমি দেখেছি শহরের হাওয়ায় টিভির ধারাবাহিকের চাপে বেশ কিছুটা কোনঠাসা। এরচেয়েও মারণ নেশায় মগ্ন রেখেছে মুঠোফোন যাকে মোবাইল বলা হয়। ভয়ংকর এই মোবাইল সন্ত্রাস গ্রামীণ জীবনকে বিষাক্ত পথ দেখাচ্ছে।
এইসব পালা গ্রাম -শহরের মাঠে ময়দানে হওয়ার জন সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করি।