উদয়নীল ভট্টাচার্য
আসুন মহোদয় , এই সেই সোনালী আপেল, যার পিছু পিছু আমি এসছিলাম, আরো কয়েকজন এসছিল, আপনিও এসছেন। তবে কি না আপেলটা আর সোনালী থাকবে না, কিন্তু গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। কামড় আপনি স্বাচ্ছন্দে বসাতে পারেন যেমন আমরা বসিয়েছিলাম। সুচারু হিসেব করে নয় বলেই হয়তো কিঞ্চিৎ হুমকি আপনার মনে থানা গাড়বে। তখন এক ভিন্ন বোধোদয় আপনাকে এনে ফেলবে গলাজলে। পাড়ে আপনি ফিরে যেতে পারবেন যেমন অনেকে যায়, আর না গেলে? এক সুস্বাদু যন্ত্রণার সাথে বসে আপনি খেলা শুরু করবেন। কেমনতর? ধরুণ দাবা সদৃশ। আপনি গুটি চালবেন, সেও। জমে উঠবে খেলা। আপনি গুটি সাজাবেন, আক্রমণ করবেন, আত্মরক্ষা করবেন কিন্তু খেলা শেষ করতে চাইবেন না। খেলা আপনাকে পেয়ে বসবে। আমাদেরও বসেছিল। তবে কি না মাঝে মাঝে খারাপ হাওয়া দেয় – গুটি উল্টে যেতে পারে, তখন আপনি কি করছেন সেটাই হল আসল কথা?
এই দেখুন না আমার এখন খেলাধুলো করতে বড় অসুবিধে হয়। আপেলের রস কিন্তু শরীরে এখনো বর্তমান। মাঝে মাঝেই গুটি সাজাতে ইচ্ছে হয় ফলে শনিবারের বারবেলায় আমি আবার গুটি সাজাতে চেষ্টা করি। বিশেষত যখন দেখি অন্যেরা গুটি পেতে বসে গেছে আর আমার বরাদ্দ দর্শকাসন। তা কি হয়? বন্ধ পর্দার আড়ালে গুটি আমিও সাজিয়েছি এককালে। নিজেও গুটি হয়েছি আর এখন সর্বনেশে হাওয়া যদি আমায় গুটিপোকা বানাতে চায় তা কি মেনে নেওয়া চলে? কত কি শিখেছি জানেন, বিস্মিত হতে, শিহরিত হতে, পরাজিত হতে সব মিলিয়ে নির্মিত হতে, শুধু জয়ী হতে শিখিনি কখনো। শৈশবে বীজ বুনে গেছে এক পাখি, গোপনে গোপনে পল্লবিত এক ব্যথা গাছ। যেখানে পেয়েছি মাটির খোঁজ, লাগিয়েছি ব্যথা কলম। সেই সব গাছ ছেড়ে কোথায় যাব এখন? সুতরাং মহোদয় আপেলের পিছু পিছু আসুন, আপেলের বেসাতি করুন। কামড় নৈব নৈব চ। রস যদি পেটে যায়, ভেতরে ভেতরে পাখা মেলবে সেই গাছ। আর যখন গুটি আপনাকে চালতেই হবে। গুটি চালা শুরু হলে খেলাও শুরু। কিন্তু শেষ নেই, জয় নেই, তবু আহা কি সুস্বাদু সেই হেরে যাওয়া। ভেবে নিন এবার দাঁত থেকে আপেলের দূরত্ব কমে আসছে … ভাবুন … ভেবে নিন।
বিঃ দ্রঃ আপেল খাওয়ার পর শরীরের বিশেষ কিছু অংশ হাত দিয়ে আড়াল করার কথা মনে হয়েছিল ইভের। কেন? জানা নেই। তবে এ আপেল খেলে সব কিছু উন্মোচনের ইচ্ছে হবে এমনকী অয়দিপাউস ইয়োকাস্তের সম্পর্কও।
কেলেঘাইয়ের ধাতুরিয়া (বোল্ড)
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়াই। ঘুমিয়ে পড়ছে গ্রাম। শুধু মাইকে ভেসে আসে বিলীয়মান কণ্ঠস্বর — এতদ্বারা অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে জানানো যাচ্ছে যে কেলেঘাই নদীর জল বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা সতর্ক করে দেব। এতদ্বারা … !
পরদিন বিপদ দেখতে গেলাম। হুজুগে পড়ে। সবাই নিরাপদে বিপদ দেখতে যাচ্ছে। নদীর ধার পর্যন্ত মোরাম বেছানো রাস্তা চলে গেছে। শুকনো দিনে ট্রলিচালকরা মাছি মারে। বিপদের দিন এলে তাদের নিঃশ্বাস ফেলার জো থাকে না। গোছানো বিপদের পারিপাট্য বড় মধুর দৃশ্য। অনেক অসচেতন ভ্রমণবিলাসী জুটে যায়। নিঃশঙ্ক চিত্তে আশঙ্কা ভ্রমণ। নদীর পাড়ে দেখছিলাম জলের খেলা। সন্ধ্যে নেমে আসছে। গোটা দশেক নৌকো বিপদলগ্নের প্রহরী, খেটো ধুতি পরা জনাকয়েক, যাদের জমি ঘর তলিয়ে যাবার কথা তারা নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে। তবু পাঁপড় ভাজা, চা তৈরির বিরাম নেই ভ্রমণার্থীদের জন্য।
-বাবু।
-ঘুরে তাকালাম, গায়ে আধময়লা জামা, খেটো ধুতি, এক চল্লিশোর্ধ বিষণ্ণ মানুষ।
— আমায় বলছেন?
— আপনি বিদ্যাসাগর ব্যাঙ্কে কাজ করেন না?
— হ্যাঁ কেন?
— আমি চিনি আপনাকে, আপনি তো বই লেখেন, অভিনয় করেন, সোসাইটির ম্যানেজার বলছিল।
— ওই আর কি?
— টি.ভি তে দেখলাম আপনাকে।
— বিড়ম্বিত হই। কি আপদ, এখানে এসব কেন? কোথায় বিপন্নতার বিষণ্নতার গান শুনতে এসেছি ফিরে গিয়ে এক কলম ফাঁদব। দুঃখের সংলাপ কেমনধারা হলে মাটির কাছাকাছি হয়, লিখব সে সব কাহন, তা নয়, কোত্থেকে –
— আমরাও বই করি, মানে পালা আর কি।
— আশ্চর্য, এসব কে শুনতে চাইছে। কোথায় বলবে, দু’টো চাষ পরপর তলিয়ে গেল, একবারও শস্যবীমার পয়সা পেলাম না। সোসাইটির লোন শোধ হয় নি। এরপর কি করব জানি না। তা নয় তো শিল্পচর্চা। মনে মনে প্রস্তুত হলাম, পাল্টে নিলাম প্লট। বেশ বিপন্ন এক শিল্পীর- হেরে যাওয়ার কাহিনী টুকে নেওয়ার জন্য।
— করেন, বা: তা আর কি করেন। লিখি, অভিনয় করি, নির্দেশনার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আমি যে পালা লিখি তা ওদের পছন্দ হয় না।
— কাদের?
— আমাদের দল বৈকুণ্ঠ যাত্রাসমাজ।
— ও যাত্রা!
— নিমাই ফেরে নাই, ময়না নদীর পাড়ে, শুনেছেন এসব বইয়ের কথা?
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ইয়ে এসব তো বিখ্যাত সব ইয়ে,তা
কোথায় রিহার্সা — মানে মহড়া দেন?
— যাবেন? কাছেই।
— অগত্যা এড়িয়ে যাবার প্যাঁচ করে বললাম, লেখার কাজেই এসছিলাম তো, দেখছি আর কি সব, সত্যি কি দুরবস্থা আপনাদের। রিলিফ টিলিফ পান। মানে ত্রাণ।
— আমার লাগে না।
— মানে?
— আমার পরিবার নেই, মানে বিয়ে করিনি। — তা থাকেন কোথায়? কিছু করেন টরেন না?
— হাজিরা খাটি, ভাইদের সংসারে থাকি। তবে সেসব বলার জন্য আপনার কাছে আসিনি, একটা নাটক লিখছিলাম—
— নাটক? না যাত্রা?
— নাটক। যাত্রা আমার ভাল্লাগে না বাবু। ওদের তো বোঝাই। ওরা শুনতে চায় না। সেই রড ফিমেল দিয়ে প্রেম, বিরহ, খুনোখুনি — আজকাল তো বাংলা সিনেমাও টুকে দিচ্ছে। বলে কি? এ তো আলোকিত অন্ধকার। আমি মাঝে সাঝে শহরের দিকে যাই। নাটকের প্রতিযোগিতা দেখি। একটা লিখেছিলাম। শুনবেন?
— এখানে? অন্ধকার হয়ে আসছে।
— মানে প্লটটা বলতাম।
— বলুন তাহলে ছোট করে।
— ঐ যে খুঁটিটা দেখছেন না? ঐ যে, গায়ে কালো কালি দিয়ে নম্বর লেখা। ওটা জলের মাপ দেখায়। ঐ যে লাল দাগটা, ওটা হল বিপদসীমা । ঐ দাগ ছুঁলে বাঁধের এপারের লোকগুলো সব ঘোষণা শুনে দূরে চলে যায়।
— ঘোষণা কে করে? এই যে দোতলা বাড়িটা দেখছেন, ওখান থেকে তো ওয়াচ করা হয়। ওরাই মাইকে বলে দেয় —
— নাটকটা কি?
— এই নিয়েই। বিশু একটা লোক। গরীব, কিন্তু পড়াশুনো করে। দেখার বাইরে দেখতে চায়। বিপদ আপদ হলে লোককে সাহায্য করে। প্রতিবছর যে ভৌগোলিক কারণে (চমকে যাই) বন্যা হয়, কি করলে, কি ভাবে আন্দোলন করলে এসব ঠেকানো যায়, স্থায়ী সমাধান কি হতে পারে এ নিয়ে লোককে বোঝায়, কিন্তু সবাই হাসে আর বন্যা হলে কাঁদে।
এ পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল হঠাৎ বাঁধ দেওয়ার ব্যাপারটা গ্রামের লোকেদের নিয়ে না করিয়ে ঠিকাদার দিয়ে করানোর ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। ফলে বাঁধ হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিবছর কোথাও না কোথাও ফাটল ধরে। ঠিকাদার পয়সা পায়। বিশু হঠাৎ আবিষ্কার করল একটা তথ্য (বাবা, এতো অ্যাকাডেমি স্টারদের ইন্টারভিউয়ের মত বলে! )। জল বিপদসীমার ওপরে বইলে বাঁধ আরো উঁচু করার নির্দেশ দেয় প্রশাসন। ঠিকাদার তাই রাতের অন্ধকারে সীমা নির্দেশক মাপকাঠিটা লোক দিয়ে জলের নীচে আরো ঠেসে দেয় ফলে মাপ যায় গুলিয়ে। বিপদসীমা পার করিয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসন নির্দেশ দেয় ঠিকাদার পয়সা পায়, গরমেন্টের পয়সা (এই তো বাপু ধরা পড়েছো, গরমেন্ট?) জলে যায়। বিশু সেটা ধরে ফেলে। জলে লাফ দিয়ে সে মাপকাঠির জালিয়াতি আটকাতে যায়।
— এবং মারা যায়, তাই তো?
— না বাবু, বিশু খুঁটি উপড়ে দেয়। ফলে নতুন করে মাপ হয়। ঠিকাদার প্রতিশোধ নেবার ছক কষে। তাছাড়া প্রশাসনেও তো খারাপ লোক থাকে, তারা গ্রামবাসীদের ভুল বোঝায় বিশুকে একঘরে করার জন্য। বিশু একঘরে হয়ে যায়।
— কিন্তু আপনার তো বিশুকে জেতানো উচিত ছিল। মানুষের বিপদ নিয়ে যারা জালিয়াতি করে তাদের ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। হারিয়ে দেওয়া —
— বাস্তবে তা কি হয়?
— বলে কি, এভাবে নাটক শেষ করলে তো
শহরতলির মঞ্চেও কল্কে পাবে না। উত্তরণ
নেই! জয়গান নেই!
— বাস্তবে যা হয় তা দেখানো তো নাটক নয় সেটা বাস্তব। নাটক তো যা হলে ভাল হতো সেটা দেখাবে। লোকগুলো যারা দেখবে তারা জেতার খুশি নিয়ে বাড়ি চলে যাবে বাস্তবটা পাল্টাবে না। আমার একটা কথা ছিল বাবু আপনি যেখানে নাটক করেন সেখানে এ নাটক করানো যায় না?
আরণ্যক উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। বালক ধাতুরিয়া সত্যচরণকেও এ প্রস্তাব দিয়েছিল। ছক্করবাজি নাচের কদর বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে কেউ দেয় নি, সত্যচরণ যদি তাকে কলকাতায় নিয়ে যায়, সেখানে প্রকৃত গুণীদের ভীষণ কদর। সেই কদর সন্ধানীর ট্র্যাডিশন আজো চলছে।
— এভাবে বলা মুশকিল। আমি গিয়ে কথা বলি তারপর আপনাকে জানাব, চলি।
নদীর বাঁধ থেকে নীচে নামার জন্য পা ফেলি।
— আরেকটু বাকী ছিল বাবু নাটকটা, মানে লাস্ট সিন, জলের মাপ লক্ষ্য করার যে ঘরটা, ওয়াচ হাউস, সেইখানে। গভীর রাতে সেখানে বসে ঠিকাদার আর প্রশাসনের বদ বাবুরা মদ খায়। তার সামনে দিয়ে চলে গেছে বাঁধটা। বিশু নদীর নীচে ডুব দিয়ে দিয়ে বাঁধের সেই জায়গাটা সকলের অলক্ষ্যে ফুটো করে দেয় ইঁদুরের মত। আর অপেক্ষা করে ভরা বর্ষার জন্য। অন্তর্ঘাতের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
লোকটার মুখোমুখি হই। সন্ধ্যের শেষ লগ্নেও চকচক করছে মুখটা। সাধ্য কি ব্রাত্য জনের সঙ্গীত রুদ্ধ করার!
— এ নাটকের জন্য কলকাতা গিয়ে কি করবেন আপনি। বরং এখানেই করুন আমিই যাব আপনাদের মহড়ায়। এ নাটক যাতে এখানেই হয় সেটা বোঝাব আপনার বন্ধুদের। যোগাযোগ করবেন।
পা চালিয়ে নেমে আসতে লাগলাম দ্রুত। ভারী ভয় ভয় করছে। অন্তর্ঘাতের ভাবনা ভারী ভয়ানক, সংক্রামিত হলেই মুশকিল। এ নাটক কেউ করে না কি? পাগল!