ডেথ অফ সেলসম্যান; টেন্থ প্ল্যানেট নাট্য | নীলাঞ্জন

“ডেথ অফ আ সেলসম্যান”! “সেলসম্যান” শব্দটা চোখ টেনে নেয়। “ম্যান” হলে একটু ম্যাড়ম্যাড়ে হতো। মানুষ তো হরদম মরছে। কিন্তু সেলসম্যান! বিক্রেতা! এই! আয়নাটা কেউ ঘুরিয়ে দিলো নাকি আমাদের সময়ের দিকে?!

সীটের ওপর টানটান হয়ে বসি।

জীবনের একটা সময় ধরে মানুষ নিজেকে গড়ে তোলে। তারপর তাই ভাঙিয়েই মোটামুটি তার জীবন কেটে যায়। অভিরূপ চ্যাটার্জী কিভাবে গড়ে উঠেছিলো তার কাহিনী তেমন নেই। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, সংসারী, দুই ছেলের বাবা। অভিরূপ আসলে এই সময়ের নাম। মৃত দাদাকে সে মাঝে মাঝে ডাকে, মদত চায়, দাদা বলে জঙ্গলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে, তারপর চলে যায়। অভিরূপের কাছে এই অন্ধকারের দ্ব্যর্থ পরিষ্কার নয় (এখানে কী জীবনানন্দ মনে পড়ে! “নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো/জন্তুগুলো আনুপূর্ব অতিবৈতনিক/বস্তুতঃ কাপড় পরে লজ্জাবশত”)। তার নিজের অবস্থান পরিষ্কার নয়। এবং এই অস্পষ্টতার কথা সে বুঝতে পারে। তবু টিকে থাকতে তো হবে তাই সে অফিসে একরকম, ছেলেদের কাছে একরকম, স্ত্রীর কাছে একরকম আর বর্ধমানের সেলসগার্লের কাছে একরকম।

অভিরূপ চ্যাটার্জীকে গালাগাল দেওয়া যেতে পারে, দর্শক হিসেবে আমারও বিরক্ত লাগছিলো খুব, লীনা এত সহিষ্ণু একজন জীবনসঙ্গী, তার পাশে ওই মেয়েটি! অভিরূপের মুখে “একাকীত্ব” শব্দটাকে বাজে অজুহাত শোনাচ্ছিল কিন্তু নিজের ভালোলাগা না লাগার ভেতর থেকে বার হয়ে যদি অভিরূপকে বাবা, স্বামী, সহকর্মী, বন্ধু এবং সর্বোপরি এই উৎপাদন ব্যবস্থার পুতুল হিসেবে দেখি তবে অভিরূপ ইজ অলমোস্ট আ ডেড ম্যান।

তাই বিরক্ত লাগতে লাগতেও চোখ ভিজে যাচ্ছে যখন দেখছি বড়ছেলের মনে বাবার প্রতি এখনো কিছু ভালোবাসা টিকে আছে ভেবে অভিরূপ খুশী হন। অভিরূপ আগেই মৃত। সে জানে। শুধু execution টুকু বাকি। তবু ছেলের ভালোবাসা তার কতো কাত। ভালোবাসা কতো কাঙখিত৷

10th Planet এর এই নাটকে এক সেকেন্ড কোনো রিলিফ নেই। রিলিফ নেই কথাটা বলা যতটা সহজ, স্টেজ ক্রাফট দিয়ে সেটাকে ঘটিয়ে তোলা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। এতজন অভিনয় করছে, কেউ মিউজিকটা করেছে, আলো করছে, এতসবের পরেও আছে সকলেরই একটা বীমূর্ত যোগদান, যা আবার প্রচুর অনুশীলন থেকেই আসে। এত সামনে বসে আছি, সেট প্রপ মিনিমাল একেবারে, ওটুকু বোধহয় না হলেই নয় আর কি, তাতেই একেকজায়গায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেলসগার্ল মেয়েটি হেসে উঠলো, সেই হাসির রেশ ধরে হেসে ওঠে স্ত্রী লীনা, অভিনয়ে অবিসংবাদী সীমা ঘোষ! নির্দেশক অভিনেতা মিলে স্থান আর কালকে প্রয়োজনমতো জুড়ছে ভাঙছে। গোটা নাটক জুড়ে বারবার এই স্থানকাল ভাঙাজোড়া একেকসময় স্থানিক ও কালিক ভ্রমের জন্ম দিচ্ছে এবং তা দিচ্ছে বলে দর্শককেই কয়েক সেকেন্ডে নতুন করে বুঝে নিতে হচ্ছে যে ও আচ্ছা পুরানো কথা বলছে! এখানে বিশ্রামের কোনো গল্প নেই। এই বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে বেশ উপভোগ করেছি নির্মাণের দিক থেকে। একজনের ছেড়ে যাওয়া হাসিকে আরেকজন এত সঠিক সময়ে ধরে ফেলেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় শরীর জুড়ে। ক্রাফট এর দিক থেকে এই জায়গাটা একদম চলচ্চিত্র সম্পাদনার মতো। এর কৃতিত্ব নির্দেশক ও অভিনেতাদের। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিলো আশেপাশে কোনো উইংস নেই। আশপাশটা ফাঁকা।

নাটকটি অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদ এক অন্তহীন সম্ভাবনা তাই আমরা একই বিষয়ের একাধিক অনুবাদ পড়তে পাই। বোঝা যায় অনুবাদের কাজ বেশ কঠিন। একটা ভিনদেশের টেক্সট তার সময় কাল ভূগোল ইতিহাস সমাজ রিচুয়াল এমন আরো বহু কিছু ছেড়ে বহুদূরের দেশে একেবারে আলাদা একটা সেটআপে আসছে, যেখানে দর্শকের মানসিক সংগঠন, গ্রহণযোগ্যতা, দৃষ্টিভঙ্গীও অনেক আলাদা। সেখানে একটা টেক্সটকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে গেলে অনুবাদককে অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। আমরা যদি সমতুল বা ইকুইভ্যালেন্স এর কথা ভেবে বলি তবে চরিত্র, কথা, ঘটনা, বিভিন্ন পরিভাষা, এমনকি পরিবেশ, অনুবাদের যাথার্থ্য বাদে খানিক বদলেও ফেলতে হতে পারে। সেসব মিলিয়ে দেখলে এ নাটকের বঙ্গায়ন হয়েছে চমৎকার। একবারও মনে হলোনা অনূদিত নাটক দেখছি। যেটা মনে হতেই পারতো। কিন্তু তেমন কোনো যান্ত্রিকতা পাওয়া গেলোনা। আর এই অনূদিত টেক্সটকে এমনভাবে সব অভিনেতা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছেন যে মনে হলো পাশের বাড়ির গল্প দেখছি।

ব্যক্তিগতভাবে এমন পরিবার থেকে belong করি যেখানে স্বাধীনতা আছে। শত আর্থিক সমস্যা সত্বেও ইচ্ছেমতো নানা কাজ, নানা চর্চা করার সুযোগ আছে। সেখান থেকে এই নাটকের আবহ আমার কাছে ক্রমশ দমবন্ধকর হয়ে উঠেছিলো। তাহলে যারা এমন সমস্যায় ভুগছে তাদের কি হবে?

জানিনা ঠিক কি হবে। আমাদের অভ্যস্ত জীবনে আর্ট কি করে, আমাদের ঘাড় ধরে দেখায়, “দেখো, নিজেদেরকে দেখো একবার।” ভালো কি মন্দ জানিনা। ধাক্কা খাওয়া জরুরী কারণ গতি আমরা বুঝতে পারিনা। গতির তারতম্যই শুধু অনুভব করি। তাই যাত্রাপথে ঝাঁকুনিগুলোই মনে থাকে। এই নাটক একটা প্রবল ঝাঁকুনি। মনে হয় মানুষও এখন চাইছে এমন করে আয়নায় নিজেকে দেখতে। বন্ধুত্বের বড় অভাবের দিনে মানুষ চাইছে তার ভালোমন্দ কেউ দেখাক। সমালোচনা করুক। চাবুক মারুক। আবার ভালোবেসেও কিছু কথা বোঝাক। কে বলতে পারে এই নাটক দেখে আত্মসমালোচনা করে একজন মানুষ নিজের অভ্যস্ত জীবনে কিছু গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটাবেনা?

পিনপতনের নৈঃশব্দ্যে, হাততালিতে কতো কথা আছে তা কি আমরা জানি?

ঘরে ঘরে আজ এই সমস্যা। একটা বয়সের পরে আমরা সব মৃত। আমাদের আত্মা নিয়ে গেছে অর্থনীতি। সে বলছে কনজিউম করো, আমরা করছি। সে বলছে, এটা খাও, ওখানে চলো, এভাবে শোও, এই জিনিসটা কেনো, ওই সুগন্ধী গায়ে দাও, একে আভিজাত্য বলে ভাবো, একে চর্চা বলে ভাবো, একে ইতিহাস বলে ভাবো, ভবিষ্যৎ যেমন দেখাচ্ছি দেখো। আমরা বাধ্য কনজিউমার হয়ে তা সব করে চলেছি। রিসোর্স কিন্তু কয়েকজনের হাতে তাই খেলাটা শেষ অবধি “মিউজিকাল চেয়ার”। চেতনাও প্রায় হৃত বলে মৃত্যুভয় নেই। অভিরূপ চ্যাটার্জী তাই বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে এ তার ভালোবাসা, মরিয়া চেষ্টা, পালিয়ে যাওয়া এবং সত্যি বলতে কি, বিকল্পহীনতাও। মিউজিক্যাল চেয়ারে সবাই সব রাউন্ডে বসতে পারবেনা যে! প্রতিবারই তো কাউকে না কাউকে খেলা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

অভিরূপরা একে একে মরে যায়। ধ্রুবও এই সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। ধ্রুব আমাদের অনেকের প্রতিনিধি যারা রোজ বলছে, “আমাদের মন খুলে একটু বাঁচতে দাও প্লিজ। আমরা অসাধারণ কিছু নই। আমার যা আছে তাই নিয়ে আমরা আনন্দে কাটিয়ে দিতে চাই।”

মানুষকে এইভাবে দেখাটাই তো অনুচিত। এই দেখাটাকে আমরা অনেকে পালটে ফেলতে চাই।

নাটকের শেষে অভিরূপের ভূত যেনো গিয়ে ঢুকছে তার ছোটছেলের ভেতর। কোনটা যে স্বপ্ন আর কোনটা যে স্বপ্নরূপ প্রতিযোগিতা, তার বিভাজনরেখাকে সুকৌশলে লুপ্ত করে দিয়েছে এই সময় এই সিস্টেম।

তার পুতুল সকলে।

তবু লীনা আছে, ধ্রুব আছে, অভিরূপের তাস খেলার সঙ্গী সেই বন্ধুটি আছে। সেও এইসব খাঁচার বাইরে কিছু নয় তবু মন্দের ভালো।

সকলে প্রাণ দিয়ে এ নাটকে অভিনয় করেছে। যেসব কথা একা বলা যায়না, বললে ফেসবুকে, পরিবারে দুইতরফা অনর্থক খাপ বসতে পারে, সেকথা সকলে মিলে প্রচুর পরিশ্রম করে এত অর্থপূর্ণভাবে বলারই দরকার ছিলো। এই পরিশ্রমকে শ্রদ্ধা জানাই। প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ থাকার কথা ছিলো কিন্তু তা হয়নি। বাংলায় অনেক কষ্ট করে থিয়েটার করতে হয়। অনেকে ডালভাত খেয়েও সেটা করে থাকেন। এখানে এতজন ছেলেমেয়ে যাদের অনেকের অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার দুর্দান্ত, তারা বকের মতো কেরিয়ারের দিকে চোখ না রেখে, এই বয়সে চাকরি বিয়েশাদি সংসার না করে এই আর্থিকভাবে হাবুডুবু খাওয়া থিয়েটারে এসে জান লড়িয়ে এমন কাজ করছে, অনেক শোতে ভালো টিকিট সেল হচ্ছেনা, জানিনা কিভাবে তারা সব পেমেন্ট সারছে। ভাবুন তো, এই মারাত্মক চাপের যুগে, যেখানে জল কিনে খেতে হয় সেখানে এতসব সঙ্গে নিয়ে থিয়েটার করে যাওয়া, এবং শুধু করে যাওয়া নয়, সবটা জেনেই, স্বীকার করেই এত শ্রম দেওয়া, ক্রমশ উৎকর্ষ সাধন করে চলা, এতো বড়ো আশার কথা তাইনা?

এই জোর, এই নিষ্ঠা অনেক শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করবে৷

শেষ করি এই বলে যে, এই অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থার মতো এত গভীর ও সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা আগে বোধহয় মানবসমাজে আসেনি। এত সিদ্ধান্তহীনতার সম্মুখীন কোনো প্রজন্মকেই হয়তো হতে হয়নি। তবু জন্মে তো আমাদের হাত নেই, তাই জন্মে গেলে বাঁচতেই হবে যদিনা আত্মহত্যার পথ বেছে নিই। কিন্তু সে বেঁচে থাকা এত কঠিন যে এসময় আমাদের নতুন পথ খোঁজা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আবার নতুন পথ খোঁজাও কঠিন। তাতে অনেক অনেক মানুষকে নানাভাবে শামিল হতে হবে।

10th Planet এর এই সৃষ্টিকে, তার সমস্ত অস্বস্তি, বিরক্তি, ভাবিয়ে নাড়িয়ে দিতে পারার প্রবল শক্তিকে এসময়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ বলে মনে রাখলাম। একবার দেখে সবটা নিয়ে লেখা যায়না। আরো কয়েকবার দেখবো।

Hall এ লোক থাকুক বা না থাকুক এ নাটক যেনো চলে। তবে এ নাটক দেখতে আসুন। আমার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বলি তোমরা অবশ্যই এসো।

আগামী পৃথিবী আমাদের। এরই মাঝে রোজ নবজাতকেরা এসে চলেছে। সব দায়দায়িত্ব তো আমাদেরকেই মাথায় নিয়ে চলতে হবে!

2 thoughts on “ডেথ অফ সেলসম্যান; টেন্থ প্ল্যানেট নাট্য | নীলাঞ্জন

  1. খুব ভালো আলোচনা হয়েছে। ধন্যবাদ।

  2. এই সময়ে এই নাটক আর এই অসাধারণ পর্যালোচনা ধরে একটু সোজা হয়ে দাঁড়াই

Comments are closed.