বাংলা সিনেমা ও তরুণ মজুমদার | সুব্রত কাঞ্জিলাল

মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের একটা অংশকে ইন্টেলেকচুয়াল তথা এলিট বাঙালি বলে উপহাস করা হয়। এরা নাক উঁচু জাত হিসেবে অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখেন । বাংলা সাহিত্য সিনেমা সংস্কৃতি নিয়ে এঁরা খুব বেশি উঁচু ধারণা ধারণ করেন না। এই কারণে এই দলটা সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণালদের নিয়ে কথা বললেও, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদার, অজয় করের নাম উচ্চারণ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত আসা-যাওয়া করে যতিচিহ্ন টেনে দেন। শরৎচন্দ্র, নজরুল, সমরেশ বসু, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাত্তা দিতে রাজি নন।

তরুণ মজুমদারের ফুলেশ্বরী ছবিটা শুরু হয়েছিল, সম্ভবত এইসব নাক উঁচু বাবুদের কথা মাথায় রেখে। পাঁচালী গানের মত গান দিয়ে ছবিটা শুরু হয়। পরিচালক বলছেন, সত্যজিৎ, গদার, ফেলিনিদের মাথায় রেখে তিনি সহজ-সরল বাংলার গ্রামের মানুষের গল্প বলতে চাইছেন, বাঙালি দর্শকদের জন্য।

তরুণবাবুর সিনেমাজীবন শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে। প্রখ্যাত অভিনেত্রী কাননবালা দেবীর প্রোডাকশন হাউজ শ্রীমতি পিকচার্সের অধীনে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তরুণবাবুর অন্যতম বন্ধু অভিনেতা এবং পরিচালক দিলীপ মুখার্জি ও সঙ্গে ছিলেন।
শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষী ছবির শুটিংয়ের সময় কোন একটি ঘটনার মুহূর্তে ওই ছবির নায়ক উত্তমকুমার তরুণবাবুকে বলেছিলেন, আমার মনে হচ্ছে তোর এখন ছবি পরিচালনা করা উচিত। তোর মধ্যে আমি সেই লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।
উত্তমকুমারের প্রশ্রয় এবং সহযোগিতায় তরুণ বাবুদের প্রতিষ্ঠান যাত্রীকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। হলিউডি ছবির গল্প মাথায় রেখে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় চাওয়া পাওয়া ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটির এই ছবিটি সে সময় ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছিল।

যাত্রিক এর পরের ছবি কাঁচের স্বর্গ। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার অর্জন করে নেয়। এই ছবিতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন যাত্রিকের অন্যতম পরিচালক দিলীপ মুখার্জি। সে যুগে বাংলা ছবির ধারাবাহিকতায় কাঁচের স্বর্গ ভিন্ন গোত্রের বলে প্রমাণিত হয়ে ছিল।
তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখার্জি, শচীন অধিকারী এই তিন বন্ধু মিলে যাত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন । কয়েক বছর পরে অবশ্য দিলীপ মুখার্জি ও শচীন অধিকারী আলাদা হয়ে যান। তরুণবাবু যাত্রিকের ব্যানারে আরো কয়েকটি ছবি সৃজন করেন।
দিলীপ মুখার্জি সেই সময় বেশ কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। তবে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ করে উঠতে পারেন নি। অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। শচীন অধিকারী সেভাবে কিছু করতে পারেন নি।

মনোজ বসুর চার পাতার গল্প: আংটি চাটুজ্জের ভাই, অবলম্বন করে তরুণবাবু লিখে ফেলেছিলেন চিত্রনাট্য। তারপর বম্বেতে ভি শান্তারাম এর কাছে চলে গেলেন। চিত্রনাট্য শোনালেন। ভি শান্তারাম এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই ছবিটা আমি প্রডিউস করব। সৃষ্টি হল বাংলা সিনেমার একটি অনন্য দলিল চিত্র: পলাতক। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করলেন অনুপকুমার। তার আগে কোনো পরিচালক ভাবতেই পারতেন না যে অনুপকুমারকে নায়ক করে ছবি করা যায়। এবং সেই ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করে। রাজেন তরফদার পরে তাঁর একটি ছবিতে: জীবন কাহিনী, অনুপকুমারকে প্রধান চরিত্রে নিয়েছিলেন।
পলাতক বাংলা মূল ধারার ছবির মধ্যে একেবারেই অন্যরকম ছবি। যার আবেদন আজও অম্লান। তরুণবাবু ষাটের দশকে, কিশোর প্রেমের গল্প নিয়ে ছবি করলেন: বালিকা বধূ। এটাও আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। বাংলা সংগীত জগতের প্রবাদ পুরুষ নিধুবাবুকে নিয়ে ছবি করলেন: অমর গীতি। সত্তরের দশকে আবার ফিরে এলো কিশোর প্রেমের গল্প, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ। সুবোধ ঘোষের গল্প নিয়ে তৈরি হলো ঠগিনী। জনৈক পতিতা এবং এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ যুবককে নিয়ে ছবি তৈরি হলো, আলোর পিপাসা। প্রেমেন্দ্র মিত্রর গল্প: সংসার সীমান্তে নিয়ে ঋত্বিক ঘটক ছবি করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কাজটা করা হয়ে ওঠেনি। রাজেন তরফদার এর চিত্রনাট্য নিয়ে এবার তরুণবাবু ছবিটা করলেন।
এই ছবিতে এক ছিঁচকে চোর ও নিম্ন শ্রেণীর পতিতার গল্প বলা হয়েছিল। অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা রায়। এই ছবিতে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সন্তু মুখোপাধ্যায়।
আশির দশকে তারাশঙ্করের গল্প নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের প্রযোজনায় তরুণবাবু ছবি করলেন গণদেবতা। কালজয়ী এই উপন্যাসের বিশ্বাসযোগ্য চলচ্চিত্রায়ন সৃষ্টি হয়েছিল।

তরুণ মজুমদারের প্রতিটি ছবির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র ছিল। অবশ্য তিনি গ্রাম বাংলার সরল সাদাসিধে মানুষের জীবন নিয়ে ছবি করতে ভালবাসতেন। নাগরিক জীবনের জটিলতা কুটিলতা তিনি একরকম পরিহার করে চলতেন । তাঁর ছবির প্রধান দর্শক ছিল শহরতলির এবং গ্রাম বাংলার অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। বাংলার জলবায়ু, বাংলার শস্য শ্যামলা প্রকৃতি, আম জাম কাঁঠাল তাঁর ছবিতে প্রধান ভূমিকা নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকত। গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি তাঁর ছবিতে বারে বারে ফিরে এসেছে। কবিগান, তরজা গান, ঝুমুর গান, একইসঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর ছবিতে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়লে যেমন বাংলার মুখ দেখতে পাওয়া যায়, একইভাবে শত শত বছর পরে তরুণবাবুর সিনেমাগুলো দেখে ভবিষ্যতের মানুষ বুঝতে পারবে বাংলার চেহারা রূপ-বৈচিত্র্য কেমন ছিল।

তাঁর প্রতিটি ছবিতে ড্রামাটিক এলিমেন্টস প্রাধান্য পেত। মেলোড্রামাকে তিনি শিল্পের পর্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তরুণবাবুর ছবিতে খারাপ মানুষের দেখা খুব একটা মিলত না। সমাজে খারাপ মানুষ, খারাপ কাজ আছে। এটাকে তিনি অস্বীকার করতেন না। তবে সেই সব খারাপ মানুষগুলোকে কালিমালিপ্ত করে, ভয়ঙ্কর ভিলেন বানিয়ে তুলতেন না। সেই সব চরিত্রগুলোকে মনে হতো, আলোর সঙ্গে অন্ধকারের মতো।

ষাটের দশকে তিনি যখন নিজস্ব ঘরানায়, একেবারে নিজের শৈলী এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটার পর একটা জনপ্রিয় ছবি করে যাচ্ছেন, তখন আমাদের মনে হতো তিনি বুঝি, সমাজ বাস্তবতার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। ষাট এবং সত্তরের দশক ছিল ভারতবর্ষ এবং বাংলায়ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংকটপূর্ণ দুটি দর্শক। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। কংগ্রেস দলে ভাঙ্গন, কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙ্গন, নকশাল আন্দোলন, তীব্র শ্রমিক এবং কৃষক আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ঢুকে পড়েছিল এপার বাংলায়। ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন সমস্ত পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ফরাসি দার্শনিক নাট্যকার লেখক ভলতেয়ারের নেতৃত্বে ওই দেশে যুব বিদ্রোহ ঘটে গেছে। আমেরিকা উত্তাল হয়ে উঠেছে আর এক যুবক বিদ্রোহের আগুনে।

গোটা পৃথিবী এবং আমাদের দেশের এই রকম অগ্নিগর্ভ সময় তরুণ মজুমদার যে ছবিগুলো করছিলেন তার মধ্যে এইসব ঘটনার কোনো ছাপ ছিল না। সত্তর দশকে এসে সত্যজিৎ রায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিদ্বন্দী, জন অরণ্য, অরণ্যের দিনরাত্রি, সীমাবদ্ধ, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, ছবির নির্মাণ করছেন। ঋত্বিক ঘটক কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা, মেঘে ঢাকা তারা, যুক্তি তক্কো গপ্পো, তিতাস একটি নদীর নাম নিয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ করেছিলেন। মৃণাল সেন সেই সময় বাইশে শ্রাবণ, ইন্টারভিউ, পদাতিক, কলকাতা ৭১ , ভুবন সোম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। রাজেন তরফদার করছেন গঙ্গা, জীবন কাহিনী, পালঙ্ক । রবীন্দ্র পরিমণ্ডলে আবদ্ধ তপন সিংহ ততদিনে সাগিনা মাহাতো, এখনই, আপনজন বানিয়ে ফেলেছেন। অন্যদিকে তরুণ মজুমদার যেন সমাজ বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন। এই অভিযোগ আমাদের মতন সেই সময়ের তরুণদের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়ে উঠত। তথাপি তরুণবাবুর প্রত্যেকটি ছবি আমরা দেখতে যেতাম। তিনি যেন আড়াল থেকে বলতেন, যুদ্ধ-বিদ্রোহ, সমাজের অগ্নুৎপাত, রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড় শেষ কথা নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপের মানুষের মধ্যে যে অস্তিত্বহীনতা তৈরি হয়েছিল, এবং ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যে দেশের মানুষের যে ধরনের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল, তার বাইরেও আরেকটি অনন্ত প্রবাহ রয়েছে। বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বাংলার গ্রাম অঞ্চলের আকাশ বাতাস নদী নালা খাল বিল নিয়ে যে প্রাকৃতিক অফুরন্ত সৌন্দর্যের সম্ভার রয়েছে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মানুষ যদি তার মাটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে উলম্ব হয়ে যায়, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। শিকড়ের সন্ধান রুদ্ধ হয়ে গেলে মানুষ তার সমাজ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে নিরালম্ব করে তুলবে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি যেন বলতেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের পথ রাজনীতি নয়। শিল্পের আঙিনায় রয়েছে মানব মুক্তির চাবিকাঠি।
তরুণবাবুর ছবিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকাশ দেখা যায়। বালিকা বধূ, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ ছবিতে সশস্ত্র বিপ্লবীদের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
অন্ধকারের গর্ভ থেকে মুক্তির প্রত্যাশা নিয়ে আলোর পথে এগিয়ে চলবার চরিত্রগুলোও আমরা তাঁর ছবিতে দেখতে পাই।
তিনি বারবার বলতেন, আমি যখন ছবি বানাচ্ছি, তখন আমাদের মাথার উপর বিরাজ করতেন ভারতীয় সিনেমার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণাল বাবুরা। দর্শক ছিল পরিশীলিত। ভালো সিনেমার শিক্ষিত দর্শকদের কথা ভেবে আমাদের ছবি তৈরি করতে হতো। সর্বোপরি রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডলের মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের চারিত্রিক অধঃপতন তখন ঘটেনি। কলকাতার এবং শহরতলির অনেক সিনেমা হলে হলিউডের উন্নত মানের সিনেমা দেখানো হতো। হিন্দি সিনেমার মূল ধারার ছবিগুলো আজকের মত এতটা বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি। হিন্দি এবং আঞ্চলিক ভাষায় রুচিশীল সিনেমা তৈরির সুস্থ প্রতিযোগিতা অবশ্য চলতো।

তরুণবাবু তাঁর লেখাতে বর্ণনা করেছেন, পথের পাঁচালী মুক্তির পরে বাঙালি দর্শক কীভাবে এই ছবিকে রিয়্যাক্ট করেছিল। ওই ছবির প্রতিঘাত তরুণবাবুর ছবির মধ্যেও আমরা দেখতে পাই। তবে ভিন্ন আঙ্গিক এবং প্রকাশভঙ্গিতে।
সিনেমা তৈরির কলাকৌশল তিনি গুলে খেয়ে ছিলেন। নিজেই চিত্রনাট্য তৈরি করতেন। ক্যামেরা অপারেট করতেন । সম্পাদনায় নাক গলাতেন। তাঁর মিউজিক সেন্স ছিল অসাধারণ। সংগীত বিষয় তাঁর আগ্রহের গভীরতা অনেক বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞকে অবাক করে দিয়েছিল। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেমন রবীন্দ্রসংগীতকে তাঁদের কন্ঠ-সম্পদ দিয়ে জনপ্রিয় করেছিলেন। একইভাবে সিনেমাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার কিভাবে করতে হয় এবং জনপ্রিয় করে তুলতে হয় সেটা তরুণবাবুর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। বাংলা সিনেমাতে পঙ্কজ মল্লিক, প্রমথেশ বড়ুয়াদের যুগ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার চলে আসছে। তরুণবাবুর সময় এবং তার পরেও বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ আমরা দেখেছি। তবুও বলতে হবে, তরুণবাবুর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিঘাত অন্যরকম ছিল।
সিনেমায় গল্প বলার ধরণ বিভিন্ন পরিচালকের বিভিন্ন রকম। তরুণবাবুর গল্প বলার ধরন নিতান্ত সহজ সরল। অনেকটা শরৎচন্দ্রের গল্প বলার ভঙ্গিতে তিনি যেন বিশ্বাসী ছিলেন। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তে গেলে এমন থেমে থাকা যায় না, গল্প বলার আকর্ষণে পাঠক আবিষ্ট হয়ে পড়েন। আমার মনে আছে, সত্তরের সন্ত্রাস আবিষ্ট কলকাতা ও শহরতলির অগ্নিগর্ভ অবস্থার মধ্য থেকে, আমরা যখন তরুণবাবুর সিনেমা দেখবো বলে ঢুকে পরতাম, কখন বাইরের বোমা বন্দুকের জগত নিমেষের মধ্যে হারিয়ে যেত। আমার মত কলকাতায় জন্ম নেওয়া এবং বড় হওয়া যুবকরা, তরুণবাবুর সিনেমা দেখে বাংলার গ্রাম দেখার জন্য উদ্বেল হয়ে উঠেছিলাম। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলো আমরা বীরভূমের গ্রামে গ্রামে খুঁজে বেড়াতাম। যেমন বিহারের শিমুলতলায় চলে যেতাম তরুণবাবুর সিনেমার চরিত্রদের সন্ধান করতে।
অগাধ পড়াশোনা করতেন তিনি। বাংলা সাহিত্য মন্থন করে সিনেমার গল্প খুঁজে বেড়াতেন। সে যুগের প্রায় সব চলচ্চিত্র পরিচালকরা সুশিক্ষিত ছিল। নানা বিষয়ে তাঁদের দক্ষতা ও আগ্রহ দেখা যেত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আধুনিক সিনেমার পরিভাষাতে তরুণবাবুর ছবিগুলো কতটা বিশুদ্ধ সিনেমা হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে যুগের অনেক চলচ্চিত্র পরিচালকদের মতো তরুণবাবুও কি সেলুলয়েড লিটারেচার তৈরি করেন নি? প্রশ্ন উঠতে পারে অনেক পরবর্তী যুগে তরুণবাবুর ছবিতে সিনেমাটিক টেকনিক্যাল কাজে কতটা আধুনিক প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়?
সত্যজিৎবাবু বহুবার বলেছেন, ক্যামেরাটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিও না। টেকনলজি দিয়ে শিল্প সৃষ্টি হয় না। শিল্প সৃষ্টি করার জন্য রসসিক্ত একটা মনের দরকার। প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের সবচেয়ে বড় গুণ তার সরলতা, বলিষ্ঠতা, আর সাবলীল ভঙ্গি। এইসব গুণ তরুণবাবুর ছবিতে পাওয়া যায়।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি যেমন প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না, একই রকম ভাবে তিনি, তাঁর শিল্পকর্মে নিজের পাণ্ডিত্য, বৈদগ্ধ ইত্যাদি প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন।
আমি তাঁকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি আদ্যোপান্ত বামপন্থী মানসিকতার মানুষ। অথচ আপনার ছবি দেখে মনে হয়-
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বলেছিলেন, আমার ছবি দেখলে মনে হয়, আমি দক্ষিণপন্থী? ভাববাদী?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, বামপন্থীরা তাঁদের কাজ কর্মের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম, মিছিল, বক্তৃতা, রাজনৈতিক হানাহানি প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
উনি বললেন, কার্ল মার্কস, মাও সে তুং, হোচিমিন এবং আরো অনেকে প্রচুর প্রেমের কবিতা লিখেছেন। লেনিন কবিতার প্রেমে পড়েছিলেন।
একজন গরীব মানুষ, কৃষক মজুর কি মধ্যবিত্ত সব সময় শ্রেণিসংগ্রাম করে? প্রেম করে না? তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নেই? তাঁরাও তো গান গায়! প্রেমের গান!
তিনি বলতেন, সাহিত্য শিল্পের আদর্শ কি সমাজের নর্দমার পাক ঘাটা? নাকি নর্দমার পাকের মধ্যে ও পঙ্কজ প্রস্ফুটিত হয়, সেইটা দেখানো? শরৎবাবু তো এই কথাই বলে গেছেন।
তিনি বলতেন, জীবন সুন্দর। প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিল্পের কাজ ও অনেকটা এরকম। সুন্দরের আরাধনা করা।
তরুণবাবুর ছবিতে প্রেমের স্নিগ্ধতা দর্শকের মনকে পবিত্র করে রাখে। তাঁর ছবির সংখ্যাগরিষ্ঠ চরিত্র প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকে।
পরিতাপের বিষয়, তরুণবাবুর পরবর্তী অধ্যায়ে বাংলা সিনেমার মূল ধারার পরিচালকরা প্রায় কেউ তরুণবাবুকে অনুসরণ করলেন না। যেমন সত্যজিৎবাবুর কাছ থেকে বাংলা সিনেমা প্রায় কিছুই গ্রহণ করেনি। মুনাফা সর্বস্বতা, বাণিজ্যমুখি বাংলা সিনেমা রসাতলে চলে গেছে।
আমাদের যেমন সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণালদের প্রয়োজন। অন্যদিক থেকে তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, রাজেন তরফদার, অজয় কর, অগ্রদূত গোষ্ঠীর সরোজ দে প্রমুখ পরিচালকদেরও একান্ত প্রয়োজন। তানসেন, রবি শংকর, আলী আকবর দের পাশাপাশি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মন, সলিল চৌধুরীদের বাঙালি নিঃশ্বাস বায়ুর মত অপরিহার্য।

দিশাহীন বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তরুণ মজুমদারকে বাতিল করে দেবার অবিরাম চক্রান্ত আজও অব্যাহত। তাই এবার শুরু হোক তরুণবাবুর সিনেমাগুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক চর্চা । সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, তরুণ মজুমদারের ছবি নিয়ে চর্চা করতে গেলে দেখা যাবে, সেলুলয়েডে জীবনানন্দ দাশের কবিতার ছবি এঁকে গেছেন সারা জীবন।

11 thoughts on “বাংলা সিনেমা ও তরুণ মজুমদার | সুব্রত কাঞ্জিলাল

  1. সদ্য প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার কে নিয়ে সুব্রতদার এই অসাধারণ লেখা, অসম্ভব ভালো কাজ হয়েছে।
    আগামীতেও আরো লিখবেন দাদা।
    শ্রদ্ধা জানবেন।

  2. দারুণ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা দাদা। অসীম দার সম্পাদকীয় কৃতিত্বে আমাদের জার্নালে এ লেখা এলো।

  3. Sandys said, Honestie the best policie, which in modern English is…
    People often use this quote when discussing health, but Franklin was talking about fire safety.
    Aphorisms state universal truths about life that encourage reflection.
    It’s time.
    The term aphorism originates from late Latin aphorismus and Greek aphorismos.
    Guy standing at a bookshelf
    It’s better safe than sorry, right.
    Michael Corleone from The Godfather II disagreed with that.
    This is especially true if the excuse is a lie.
    Finally, Actions speak louder than words is another classic example.
    Skilled writers use aphorisms to evoke big ideas in a relatable way.
    So my advice.
    An aphorism is a literary device that uses a short, clever saying to express a general truth.
    Take this proverb, for example.
    This famous motto highlights the truism that life is full of ups and downs.
    It’s become one of the most viral memes on the internet.

  4. Кулінари розповіли, чи потрібно промивати манку перед приготуванням. Проте кулінари, які мають пристрасть до експериментів, все ж спробували провести такий досвід цікаві і корисні поради. Речі та аксесуари, від яких варто відмовитися після 50, щоб виглядати свіжо і стильно. Через кілька годин після нанесення косметика починає розтікатися по шкірі. Помада потрапляє в дрібні зморшки навколо губ, а частинки тіней і тонального крему забиваються в зморшки на повіках. Якщо немолода жінка вибирає яскраву косметику, до кінця дня її макіяж може стати схожим на клоунський грим. Незручних ситуацій не трапиться, якщо користуватися стійкими косметичними засобами. Вибирайте відтінки, які трохи більш насиченіше природного кольору губ, брів і шкіри.

  5. Check it out.
    Picture of Benjamin Franklin and a caption that says “Aphorist Extraordinaire”
    It’s easier to do it yourself rather than try to explain it to someone else.
    (I say these words to make me glad),
    But there’s no certain magic to sprinkling aphorisms into your writing.
    But not today.
    Take this proverb, for example.
    The meaning.
    Check it out.
    Life is too short to surround yourself with toxic people.
    Want a few more.
    It meant that the person was versatile and adept at many things.
    Give it a try!
    Are you in.
    If you do, you agree with George Herbert’s famous aphorism from his book, Outlandish Proverbs.
    Nanakorobi yaoki.

  6. Opportunities don’t happen.
    Sandys said, Honestie the best policie, which in modern English is…
    Yup, he was reminding Philadelphians that preventing fires is better than fighting them.
    The original saying was, Eat an apple on going to bed, and you’ll keep the doctor from earning his bread.
    And then.
    How do aphorisms differ from adages and proverbs.
    And since they’re universal truths about life, they help persuade your reader to accept your message.
    This quote originated from Thomas Howell in New Sonnets and Pretty Pamphlets.
    Keep your friends close, but your enemies closer.
    Napoleon Bonaparte could relate.
    People often use this quote when discussing health, but Franklin was talking about fire safety.
    Why is this stuff important.
    Build a storyline around that saying.
    Don’t judge a book by its cover.
    Your wish is my command.
    Nanakorobi yaoki.

  7. The early bird gets the worm.
    Nanakorobi yaoki.
    Another example comes from Spider-Man, where Uncle Ben turns to Peter Parker and says, With great power comes great responsibility.
    Picture of Benjamin Franklin and a caption that says “Aphorist Extraordinaire”
    The complete quote was, A Jack of all trades and master of none, but oftentimes better than a master of one.
    Let’s talk about that.
    Aphorisms can act as a guideline to help narrow the focus of your work.
    An aphorism is a literary device that uses a short, clever saying to express a general truth.
    Now that we’ve covered the aphorism definition, are you ready for more examples.
    Another aphorism that’s adapted is, Don’t count your chickens before they hatch.
    Michael Corleone from The Godfather II disagreed with that.
    Life is too short to surround yourself with toxic people.
    Other Common Examples of Aphorisms
    Aphorisms state universal truths about life that encourage reflection.
    It’s time.
    The term aphorism originates from late Latin aphorismus and Greek aphorismos.

Comments are closed.