করম কথা | পর্ব- ২৩ | দীপা ব্রহ্ম

তরুর বিজয় কেতন উড়িয়ে পৃথিবী মাতার যে যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল সেই নক্ষত্র বিচ্যুত অংশ ভাগে ধীর গতিতে প্রাণের সম্ভার হয়েছিল। খুব মন্থরে এক এক করে প্রাণের ধারা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলো। ঠিক যার যেখানটায় থাকবার কথা সেখানেই সে থিতু হয়েছিল। কোনো দাবি না রেখে শিশুর মতো নিজেদের শৈশব নিয়েই মত্ত ছিলো প্রাণীকূল। অন্যদিকে সৃষ্টিকর্তার আদেশ অনুসারে মনুষ্যকূল পেল সর্বোচ্চ সম্মান। বুঝে-বেছে নেওয়ার স্বীকৃতি। সর্বময় কর্তার উপস্থাপনা। প্রয়োজন নানা অছিলায় নিয়মে রূপান্তরিত হলো। স্তরায়ন সৃষ্টি হলো অনেক। প্রকৃতিদেবীর খুব কাছের মনুষ্যকুলের মধ্যে আজও সেই ‘দরকার’ এ নিয়ম প্রদর্শন বেশি বেশি ভাবে প্রকাশিত হতে থাকলো। তাই বোধহয় ‘করম’ উৎসবের মূল লক্ষ্যই মাটি মায়ের সঙ্গে তরু-তমালের আলেখ্য সম্পর্ক স্থাপন। গাছ পোঁতাকে মুখ্য করে করম উৎসব আজও পালন করা হয়। অনুষ্ঠান, নিয়ম, অনিয়ম, আচার- উপাচার, একটাই লক্ষ্যে সবাই স্থির । ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’, ‘করম উৎসর আইসেছে গো. হেঁ সবে লেগে পরো’।

করম রাজাকে বন্দনা করতে বনের মধ্যে গিয়ে প্রথমে গাছ নির্বাচন করা হয়, কোন্ গাছটি পোঁতা হবে। তারপর করম রাজার (বৃক্ষের) অনুমতি নিয়ে শাখাদুটি নির্বাচন করে আনা হয়। শাখা আনার সময় কিশোরীরা শাখা বরণ করে গান-নাচের মাধ্যমে। একটা আখড়া প্রস্তুত করে রাখা হয়। প্রথমে গ্রাম-মুখিয়া শাখাটি রোপণ করেন। তারপর মেয়েরা জাওয়া ডালি নিয়ে বেদীর কাছে রাখে। জাওয়া অর্থাৎ জন্মানো বা জাত। এখানে জননীরাও ডালি আনেন। জাওয়া মেয়েরা জাওয়া ডাল নিয়ে বেদীর কাছে রাখে। জাওয়া ডালিতে যেমন পঞ্চশস্য থাকে, তেমনি থাকে ছোটো ছোটো সিঁদুর মাখানো শসা। জননীদের কাছে ওগুলো তাদের সন্তানের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভরা ভাদোরে চলে এই উৎসব। বৃষ্টির উষ্ণতা সব মিলিয়ে সৃষ্টির রঙে রাঙিয়ে করম রাজা এ পৃথিবীকে ‘ছাওয়া’ দেওয়ার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হন যেন।

এই উৎসবের প্রেক্ষাপটে আছেন দুই ভাই। করম ও ধরম। তাদেরই গল্প। ধরম ঘোর বিষয়ী কিন্তু করম একেবারেই আলাভোলা। সে বৃক্ষের পূজারি। ধরমের আবার পুজো একেবারেই না পসন্দ। সে একদিন ভাইয়ের পূজ্য দেবতা বৃক্ষ শাখাটিকে ভেঙে ফেলে দেয়। পৃথিবী রণচন্ডী হয়ে ওঠেন। চারিদিকে দুর্যোগ শুরু হয়। যাবতীয় প্রাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্লিপ্ত করম তখন ভাইকে বৃক্ষ পুজো করতে বলেন। অনেক দূরে গিয়ে রাজা করমের সাক্ষাৎ পান। রাজা তখন তাঁকে তাঁর একটি শস্য নিয়ে যেতে আজ্ঞা দেন। বলেন সবুজ শাখার পুজো আরম্ভ করতে। এভাবেই দুই ভাই ভাদোরের মায়াবি আলোয় করম রাজার পুজো আরম্ভ করে তাঁকে তুষ্ট করেন ও সম্পদে-সুখে বাস করতে থাকেন। লোকবিশ্বাসে এভাবেই সবুজের অভিযান শুরু হয়। “করম দেবতা” কোথাও ‘করম ভূত’ কোথাও ‘করম গোঁসাই’ আবার কোথাও শুধু করম নামে পরিচিত। ঊষা মাহাতো, চূড়ামণি মাহাতো, সন্তু মাহাতো তাঁদের করম উৎসব পালনের কথা বলেন। তাঁরা বলেন, তাঁদের পাড়াবন্দী অর্থাৎ পাড়ার প্রায় দশ জনের দল গিয়ে গান, নাচ প্রদর্শন করেন। মা, কাকিমাদের কাছ থেকে এ নাচ তারা শিখেছেন। পাণ্ডু মাহাতো, মামনি মাহাতো বললেন, ”ডাল গাড়বার’ একটা গান আছে। সে গান গাহিতে গাইতে জাওয়ার ডালি নিয়ে তাঁরা এ উৎসবকে মাতিয়ে রাখেন। বৃদ্ধি (ডাল), বুট, মুগ-এর বীজে জল দিয়ে অপেক্ষা করা হয় যতক্ষণ না তার থেকে ভাল বের হচ্ছে। উপোসের একটা দিন থাকে। সেটা ভাদ্রমাসের শুক্র একাদশীতে। চাহি দে গো আখড়া, বারহাই দে গো জালোয়া ইহ গো নাচি গো দিহা নাচি দিহা আখোড়া মাঝে।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সলজ্জ আটপৌরে সুরে শুনলাম করন-এর গান।

পুরুলিয়া গড় জয়পুর থানার নমো পাড়ার বৌ ঝি-দের মাঝে দাঁড়িয়ে নাগরিক খোলসে মনটা যেন একটু উদাস হলো। আজ যখন গোটা পৃথিবীর মানুষ একই সঙ্গে সবুজ মায়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন আবার উন্নয়নের স্বার্থে কখনও ধ্বংস করছেন সবুজ অবলা প্রাণগুলিকে সেখানে এই মানুষগুলি শুধু রীতি রেওয়াজের স্বাভাবিক ছন্দে কত বড়ো যে পুণ্যির কাজ করে চলেছেন, সবচেয়ে বড়ো কথা কিছু না ভেবেই। এ সচেতনতা তাঁদের সহজাত। এ গাছ না পুঁতলে তাঁদের ক্ষতি হবে এই বিশ্বাস তাঁদের। যখন অসময়ের বন মাটি ক্ষয় করে পৃথিবীর শরীরে জ্বর আনে, তখন ক্ষীণ সাধ্যির এই মানুষগুলোর গভীর বিশ্বাসের জোর নামে পাড়া ছাড়িয়ে কোথায় কোন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে সে আমার অজানা।

তবু এই বিশ্বাস যাপন করে আর যে মানুষগুলো একদা চিপকো আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন বা সবুজ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন তাঁদের যোজক হিসেবে আমি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করলাম। সবুজের জন্ম হোক বললেই হবে না, ব্রত পালনে কুত্থির ভাল গাড়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আমরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবুজের ধ্বজা নিয়ে এগিয়ে যাবো করম রাজার পুজোয়। এ ব্রত অবুঝের নয় সবুজের।

3 thoughts on “করম কথা | পর্ব- ২৩ | দীপা ব্রহ্ম

  1. দীপা দি, এমন যত্নশীল লেখা আমাদের ঋদ্ধ করে।

  2. May I simply just say what a relief to find someone who truly understands what they are discussing on the web. You definitely understand how to bring a problem to light and make it important. More and more people ought to check this out and understand this side of your story. Its surprising you arent more popular because you definitely have the gift.

Comments are closed.