এই পুরুষ ত্রিভুবন ভ্রমিলেন বটে।
ছিলেন সকল লোকে সেই বারতা নিশ্চিতই রটে।।
ভ্রমণ তাঁহার অবশ্যই ব্যর্থ কভু নয়।
দূর সীমানায় যাত্রা তিনি করেন সুনিশ্চিয়।।
রুশিয়ার সন্তানের মধ্যে তিনিই প্রথম।
পূর্ব ভারত অভ্যন্তরে করেন পর্যটন।।
হিন্দুস্থানী রীতিনীতির বিস্তারিত বয়ান। তাহাদের ভাষা আরও ভারতীয় জ্ঞান।।
আহরণ সকল কিছু পরম মনের সুখে।
সঙ্গে করি লইয়া আসেন রুশিয়ার বুকে।।
বদ্ধ বিদ্যালাভ না ধরিলেন শিরেতে।
বিশেষ ভ্রমণ সফল হৈল জান দিলেন পহিনীতে।।
তাঁহার সহিত ফেলিও একটি দীর্ঘনিশ্বাস
রাখুন চিঠি পবিত্র এ থান বারো মাস।।
আজ থেকে দুশো পাঁচ বছর আগে ১৮১৭ সালের ২৮ জুলাই গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ এর সমাধিস্তম্ভের চতুস্পদীতে ছন্দোবদ্ধ এই চৈতালিপি পঙক্তি কটি রচনা করেছিলেন শোকে ভারাক্রান্ত সহধর্মিণী নাস্তাসিয়া ইয়াক ভলিয়েভনা। নেভা নদীর তীরে বলশায়া ওখ্তা অঞ্চলে গ্রিগোরিয়েভ সমাধিস্থলে শায়িত হয়েছিলেন গেরাসিম লেবেদেফ। সমাধিস্থলে পরিচয় লেখা হয়েছিল: লেবেদেফ, গেরাসিম স্তেপানোভিচ। স্মারক চৈত্যটি আজও সংরক্ষিত রয়েছে সেন্ট পিটার্সবুর্গের সংগ্রহশালায়।
গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৮ বছর। নামটির সঙ্গে শিক্ষিত বাঙালী পাঠক এবং নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ অল্পবিস্তর সকলেই পরিচিত। বিদ্যালয়ে ও মহাবিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পাঠে, নাট্যচর্চার শুরুতে এই বিদেশি মানুষটির আমরা পরিচিতি পাই। দু-চার পঙক্তিতে তাঁর সম্পর্কে সামান্য কিছু উল্লেখ থাকে, বাংলার নাট্যচর্চায় ওঁনার ভূমিকা প্রসঙ্গে। কিন্তু কিভাবে তিনি সুদূর রাশিয়া দেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন, আর কিভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক মঞ্চে নতুন ইতিহাস রচনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তা আরো একবার অমল আলোয় পর্যবেক্ষণ করি।
আধুনিক রাশিয়ার রাজধানী শহর মস্কো থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে ইয়ারোশ্লাভল শহরে ১৭৪৯ সালে (জন্ম তারিখ জানা যায়নি) এক দরিদ্র যাজক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বাবা স্তেপান ও মা পারাস্কোভিয়ার সন্তান হিসেবে। গেরাসিমের অপর দুজন ভাইয়ের নাম ছিল আফানাসি ও ত্রেফিল এবং বোনের নাম আত্তোনিনা।
পিতা স্তেপান লেবেদেফ স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের রেখেই চলে এসেছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে যাজকতা করতে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে শৈশবে লেখাপড়া শেখার বিশেষ সুযোগ হয়নি গেরাসিমের। পনেরো বছর বয়সে প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন প্রথাগত বিদ্যাচর্চার আর একই সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষার। “পিতা রাজবাড়ির চ্যাপেলে কর্মরত হওয়ায় গেরাসিম সেই পনেরো বছর বয়স থেকে পরবর্তী আরও তেরোটি বছর কাটিয়েছিলেন রাজ পরিবারের কাছাকাছি অমাত্যবর্গের সান্নিধ্যে। এই সময়েই সঙ্গীত চর্চায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ত্রিভুবন বিকশিত হতে থাকে”।
সঙ্গীতবিদ্যায় গেরাসিমের আগ্রহ নজরে পড়ে কাউন্ট আনদ্রেই কিরিল্লোভিচ রাজুমোভস্কিরের চোখে, তিনি নিজে ছিলেন সুরকার ও সুদক্ষ বেহালাবাদক। তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন স্বনামধন্য বিশিষ্ট তিন সুরসাধক- হেইড্ন, মোৎসার্ট ও বিটোভেন। “বিটোভেনের প্রখ্যাত রুশ মেলোডি সৃষ্টি হয়েছিল রাজুমোভস্কির সাহচর্য্য ও উৎসাহে এবং বিটোভেন তাঁর রচিত সম্পদের তিনটি কোয়েটেট উৎসর্গ করেছিলেন প্রিয় সুহৃদ আনদ্রেই রাজুমোভস্কিকে”।
কাউন্ট রাজুমোভস্কির বয়স যখন মাত্র পঁচিশ তখন কূটনৈতিক হিসেবে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন মিনিস্টার ও বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত দূত হিসেবে ইতালির নেপ্স্এ দায়িত্বভার অর্পিত হয় তাঁর উপর। “স্নেহধন্য গেরাসিমকে তিনি সঙ্গী করে নেন বিদেশযাত্রায়। গেরাসিমের বয়স তখন আঠাশ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য নেপ্স্ যাওয়া তাঁদের অবশ্য হয়ে ওঠেনি। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে অবস্থান করতে হয় তাঁদের, এই অবস্থানকালে সিদ্ধান্ত নিলেন ইউরোপের অন্যান্য দেশ পরিভ্রমণের”। মোটামুটিভাবে ১৭৭৭-৭৮ এ ভিয়েনাতেই ছিলেন তিনি।
লেবেদেফ লিখেছেন– “মিশন…. ভিয়েনায় বৎসরাধিক কাল অবস্থান করিয়াছিলাম। অতঃপর আমি আমার সঙ্গীতবিদ্যা দ্বারা নিজ ভরণপোষণে সক্ষম হইয়া পরিব্রাজকরূপে স্বাধীনভাবে ভিয়েনা ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি”।
ভিয়েনা ছেড়ে যাবার আগে তিনি কাউন্ট রাজুমোভস্কি এবং অস্ট্রিয়ায় নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত প্রিন্স গালিৎসিন-এর কাছ থেকে শংসাপত্র নেন এবং গেরাসিম লেবেদেফের ভাষ্য অনুযায়ী – … “ইহাদের বদৌলতে আমি ইউরোপের বহু রাজদরবারে মহান রাজন্যবর্গ ও সম্ভ্রান্ত পুরুষদের দ্বারা সম্মানিত হই”।
ভিয়েনা ত্যাগের পর তিনি ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন ১৭৭৮ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত। এই দেশগুলিতেই তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রপ্ত করেছিলেন ইংরেজি, জার্মান বা ফরাসী ভাষায় জ্ঞান।
বিদেশেই তাঁর …”পরিচয় হয়েছিল পিত্ততর বাকুনিন নামে এক রুশ কূটনীতিবিদের সঙ্গে। বাকুনিনের সঙ্গে আলাপচারিতা গেরাসিমকে আগ্রহী করে তোলে” ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে। এ ছাড়া ইংল্যান্ডে থাকার সময় ভারতীয় পণ্য দ্রব্যের বিপুল আমদানি, এবং সংবাদপত্রে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নানান সংবাদও তাঁকে উৎসাহিত করেছিল ভারতবর্ষ অভিমুখে যাত্রা করতে।
ইংরেজীতে রচিত তাঁর আত্মজীবনী থেকে আমরা জানতে পারি ১২ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৫ তে তিনি …”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ ‘রভ্নি’তে আরোহন করেন গ্রেভসেন্ড বন্দর থেকে এবং মাদ্রাজ বন্দরে পৌঁছান ২৭ জুলাই। জাহাজে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় শংসাপত্র ছিল তাঁর সঙ্গে কারণ বিনা অনুমতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে যাত্রী হওয়া ছিল কল্পনাতীত”।
ক্যাপ্টেন উইলিয়াম সিডেনহ্যাম যিনি তেত্রিশ বছর অবস্থান করেছিলেন ভারতবর্ষে এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন মাদ্রাজের ফোর্ট সেট্ দুর্গে। তিনি গেরাসিম লেবেদেফকে আমন্ত্রণ জানান মাদ্রাজে অবরতণের জন্য। …”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেতনভূক কোনো চাকরিতে বহাল না হয়েও ক্যাপ্টেন সিডেনহ্যামের আনুকূল্যে মাদ্রাজের টাউন মেজর সাহেব বার্ষিক দুশো পাউন্ডের মাইনেতে দু-বছরের চুক্তিতে নিয়োগ করেন গেরাসিম লেবেদেফকে। তখন মাদ্রাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের কর্মচারীর বেতন ছিল বৎসরে আট থেকে আশি পাউন্ড। মাদ্রাজ শহরে রইলেন দু-বছর “। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে মুগ্ধ করলেন শ্রোতাদের তাঁর বাদ্যযন্ত্র শুনিয়ে। নিজের চেষ্টাতেই শিখলেন মালাবার উপকূলের ভাষা ‘বুলি’। তাঁর মনে হলো আদি ভাষা সংস্কৃত শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে হবে। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষক কোথায়? ছুটে গেলেন ত্রিচিনাপল্লীতে শিক্ষিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। সেখানেও জয় হলো তাঁর। … “ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির রসাস্বাদ গ্রহণে তিনি তখন গভীরভাবে উন্মুখ”। ধুলোমুঠি সোনা হয়ে যায় এমন শহর কলকাতা তাঁকে টানলো। বন্ধু ও গুণীজনদের পরামর্শে ” সদ উদ্দেশ্য বিনা হবে, চরম সুখদায়ক সেই স্থানে প্রায় সমস্ত জাতির অসংখ্য আগন্তুক দ্রুত প্রভূত সম্পত্তি লাভ করিয়াছিল”।
সেই কলকাতায় তিনি এলেন ১৭৮৭ তে। আর এই শহরেই তিনি কাটালেন তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরবর্তী দশটি বছর। এই দশ বছর কলকাতায় অবস্থানকালে শহরের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত তাঁর দশটি যন্ত্রসঙ্গীত অনুষ্ঠানের সংবাদ আমরা জানতে পারি। এগুলির তারিখ সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী যথাক্রমে- ২৮ ডিসেম্বর ১৭৮৭, ১৮ আগস্ট ১৭৮৮, ১ মার্চ, ৮ মার্চ ও ১১ নভেম্বর ১৭৯১, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৯২, ১৫ নভেম্বর ১৭৯৩, ২২ ডিসেম্বর ১৭৯৪, ১০ ও ২১ জানুয়ারি ১৭৯৭.
২৪ ডিসেম্বর ১৭৮৭ কলকাতার ‘দ্য ইন্ডিয়া গেজেট’ সাপ্তাহিক পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলো। তাতে জানা যায় ওল্ড কোর্ট হাউসে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজনের কথা। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ঠিক আটটায়। টিকিটের প্রাপ্তিস্থান ছিল লেবেদেফের অস্থায়ী বাসস্থান ৯ নং, লালাবাজার কিংবা ভল্ড কোর্ট হাউসে মি. সেলবির কাছে। প্রতিটি টিকিটের দাম ছিল এক স্বর্ণনোহর। ‘দ্য ইন্ডিয়া গেজেটে’ ৩১ ডিসেম্বর সংখ্যা এবং দ্য ক্যালকাটা গেজেটের ৩ জানুয়ারি সংখ্যায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। “ভায়োলিন-চেলো যন্ত্রবাদনে গেরাসিম লেবেদেভের দক্ষতা সেই সব অনুষ্ঠানে কৃতিত্বের দাবী রাখে”।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে নাট্যাভিনয় প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে তার কোনও প্রভাব ছিল না। এখানকার প্রাচীন অভিনয় ঐতিহ্য হল যাত্রা। আর সেই যাত্রা হতো খোলা জায়গায়, মাঠে ময়দানে, দর্শকের মাঝে। ইংরেজিতে যাকে বলে প্রসেনিয়ম, সেই বাঁধা মঞ্চের কোনও ধারণা আগে এখানে ছিল না। ইউরোপের নাট্যধারার অনুকরণে সাহেবরা সেই বাঁধা মঞ্চ বা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্রবর্তন করলো এদেশে।
কলকাতা শহরের প্রথম যে মঞ্চটির কথা জানা যায়, সেটি ইংরেজদের তৈরি। নাম “দি প্লে হাউস” (“The Play House”)। সঠিক প্রতিষ্ঠাকাল জানা যায় না, তবে ১৭৫৩ সালের উইলস্ এর ম্যাপে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরনো ডালহৌসি স্কোয়ার বা বর্তমান বিনয়-বাদল- দীনেশ বাগ অঞ্চলে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চের বিপরীতে, এখন যেখানে মার্টিনবার্ন বিল্ডিংটি রয়েছে, সেখানেই ছিল “The Play House”.
নাট্যঘরটির ঠিক সামনেই লালদিঘি আর দিঘির উল্টোদিকে ছিল সে যুগের ইংরেজদের প্রথম কেল্লা ফোর্ট উইলিয়ম। পলাশির যুদ্ধের আগের বছর, ১৭৫৬ এ সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময়ে, সিরাজের বাহিনী নাট্যঘরটি দখল করে সেখানে। কামান বসায় ঠিক সামনে থাকা কেল্লার দিকে গোলা ছোঁড়ার জন্য। ফলে মঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে সেটিকে প্রথমে প্রার্থনা-ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হতো। আরও পরে সেটি একটি নিলামঘরে পরিণত হয়।
“দি নিউ প্লে হাউস” / “ক্যালকাটা থিয়েটার”।
কলকাতার মঞ্চের ইতিহাসে দ্বিতীয় যে নামটি পাওয়া যায়, সেটি হল— “The New Play House” বা “Calcutta Theater”। জর্জ উইলিয়মসন নামে এক নিলামদার ( ভেন্ডু মাস্টার নামে পরিচিত) বর্তমান মহাকরণের কাছে লায়নস্ রেঞ্জে ১৭৭৫ এ নাট্যঘর তৈরি হয়। এই নাট্যগৃহ তৈরি হয়েছিল শেয়ার বিক্রির টাকায়। সে যুগেই হাজার টাকা মূল্যের একশো শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল বাৎসরিক শতকরা বারো টাকা হারে সুদ দেবার চুক্তিতে।
এভাবে এক লক্ষ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছিল ওই মঞ্চ তৈরি করতে। চাঁদা দিয়েছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সব ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, রিচার্ড বারওয়েল, বিচারপতি এলিজা ইম্পে প্রমুখ। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী বার্নাড বেসিঙ্ক কলকাতায় আসেন নাট্যমঞ্চটিকে সাজাবার জন্য।
বৃটিশদের এই “ক্যালকাটা থিয়েটার” তখন দেখছেন তিনি। এখানকার ইংরেজ অভিনেতারা ছিলেন অ্যামেচার বা শখের অভিনেতা। পরিকল্পনা করলেন এবার ইংরেজিতে নয় এখানকার স্থানীয় ভাষা বাংলায় হবে থিয়েটার। ইংরেজ ও রুশ থিয়েটারের মিশ্রণে একটি রঙ্গালয় গড়ে তুলবেন লেবেদেফ। ২৫ নং, ডোমতলা লেনে (বর্তমানে ৩৭-৩৯ নম্বর এজরা স্ট্রিট) জগন্নাথ গাঙ্গুলী মহাশয়ের বাড়ির খালি জমিতে মাসিক ৬০ টাকা ভাড়া নিয়ে নিজের উদ্যোগে ইংরাজী ও রুশীয় নাট্যশালার মিশ্রণে “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” পত্তন করলেন তিনি। নিজেই মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহের নক্সা তৈরি করলেন। প্রসেনিয়াম থিয়েটারে প্রথম বাংলা একাঙ্ক নাটকের প্রথম অভিনয় হবে। উৎকৃষ্ট না হলেও প্রথম। সমস্ত চরিত্রে বাঙালী অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে নাট্যাভিনয়।
বাঙালীর নাট্যাভিনয়ে প্রথম নারী ভূমিকায় অভিনেত্রীদের আবির্ভাব। ভাড়া নিয়ে সেখানে নাটকটি বাঙালী অভিনেতা অভিনেত্রী দিয়ে অভিনয় করার পরিকল্পনা করেন। এই ব্যাপারে তাঁর বাংলা শিক্ষক গোলকনাথ দাস তাঁকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেন। গোলকনাথ তখনকার গ্রামের ঝুমুরের দল থেকে ১০ জন পুরুষ অভিনেতা ও ৩ জন মহিলা অভিনেত্রী জোগাড় করে দেন।
২৭ নভেম্বর ১৭৯৫ সাল, “কাল্পনিক সংবদল” প্রথম প্রদর্শন হিসেবে মঞ্চস্থ হয়। রিচার্ড পল জড্রেল -এর “The Disguise” এর বাংলা রূপান্তরের নাম দিলেন “কাল্পনিক সংবদল”।
অনুবাদ ও পরিচালনায় গেরাসিম লেবেদেফ। এই নাট্যের সংলাপ “অধিকাংশ বাংলায় লিখিত”। ড্রপসিনে বাংলার আলপনা, ফুল বেলপাতা, মঙ্গলঘট, পূজার পরিবেশ সৃষ্টি করেন মঞ্চে। দৃশ্যপট জুড়ে ছিল বাংলার চারুকলা। (এইসব নকল করবেন রবীন্দ্রনাথ ও শিশির কুমার শতবর্ষ পরে।) “কাল্পনিক সংবদল” নাটকটি “Comedy of Intrigue” বা ষড়যন্ত্রমূলক রঙ্গপরিহাসের নাটক। নাটকটির প্রথম অভিনয়ে দর্শক সংখ্যা ছিল ২০০ এবং দ্বিতীয়বার এর অভিনয় হয় পরের বছর ২১ মার্চ ১৭৯৬, দর্শক সংখ্যা ৩০০ এবার। দ্বিতীয়বার মঞ্চে প্রথম ও তৃতীয় অঙ্ক বাংলায়, দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য হিন্দিতে, দ্বিতীয় দৃশ্য বাংলায় এবং তৃতীয় দৃশ্য ইংরেজিতে অভিনীত হয়। শুরুতেই টিকিট কেটে নাটক দেখার প্রচলন। টিকিট মূল্য ছিল এক মোহর। প্রধান চরিত্র Lewis> ভোলানাথ (নায়ক), Clara> সুখময়ী (নায়িকা)। মাত্র দুটি অভিনয় হয়েছিল।
(মদনমোহন গোস্বামীর সম্পাদনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় কাল্পনিক সংবদল নাটকটি।) মলিয়ের রচিত “Love is the Best Doctor” দ্বিতীয় নাটক হিসেবে প্রযোজনা হওয়ার কথা ছিল। শেষমেশ হয়নি।
ইতিহাস থেকে জানতে পারি গেরাসিম লেবেদেফ নির্মিত “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” প্রথম বঙ্গীয় নাট্যশালা। বাংলা নাট্য ইতিহাসের বাঘা বাঘা গবেষকবৃন্দের মতে প্রসেনিয়ম মঞ্চে বাংলা নাটক উদ্বোধনের এই সন্ধিকালকে ( ২৭.১১.১৭৯৫) অনেকেই মানতে চান না। অবশ্য সাধারণ রঙ্গালয়ের উদ্বোধন নাকি প্রথম চিৎপুরে হয়েছিল ৮.১২.১৮৭২ তে। এই অবান্তর সিদ্ধান্ত অনৈতিক এবং এর সমস্ত কৃতিত্ব গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ এরই প্রাপ্য, ইতিহাস তাই বলে।
লেবেদেফ বিদেশি এবং তাঁর কাজে ধারাবাহিকতা ছিল না, এই যুক্তিতে আমরা কি লেবেদেফ এর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা অস্বীকার করতে পারি? ইংরেজদেরই নিজেদের থিয়েটার হতে পারে, বাঙালীর হতে পারে না। এই হীনমন্যতা বোধ থেকে তিনি বাঙালী নাট্যরসিকদের মুক্তি দিয়েছিলেন। লেবেদেফের নাট্য প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে লেবেদেফের নাটকে ভাষার দুরূহতা, দুর্বোধ্যতা ও আড়ষ্টতা সাধারণ বাঙালী জনসমাজের পক্ষে সহজবোধ্য ছিল না। বাঙালীর উৎসাহ ও রুচির সঙ্গে এর যোগ ছিল না। এই জন্য কোন কোন সমালোচক তাঁর নাট্য প্রচেষ্টাকে পরবর্তী বাঙালীর নাট্য প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করতে চাননি। লেবেদেফ বাঙালী জাতির মধ্যে নাট্যবোধ বা উৎসাহ জাগ্রত করতে পারেননি।
তাঁর নাট্য প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারণ গুলি যদি এভাবে ভাবা যায় তাহলে রেখাচিত্রটা এসে এভাবে দাঁড়াবে – লেবেদেফের “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” ক্ষণস্থায়ী ছিল না। এখানে একটি মাত্র নাটক দু’বার অভিনীত হয়। প্রবেশ মূল্য সাধারণের পক্ষে ক্ষমতার বাইরে ছিল। তাঁর সময় এদেশে ইংরাজী শিক্ষা চালু হয়নি। ইংরাজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব তখনও হয়নি। বাঙালীর পরবর্তী নাট্য প্রচেষ্টার বিকাশে এই ইংরাজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালীর ভূমিকা ছিল সবার উপরে ।
সংগীত জগতের সঙ্গে যুক্ত লেবেদেফ “কাল্পনিক সংবদল” নাটকে ভারতচন্দ্র রায়ের দুটি গান ব্যবহার করেছিলেন— এক. “প্রাণ কেমন রে করে না দেখে তাহারে/যে করে আমার প্রাণ কহিব কাহারে”। দুই. “গুণসাগর নাগর রায়/নগর দেখিয়া যায়”।
এই নাটকে লেবেদেফ মূল নাটকের চরিত্র ও স্থানের নামের বাংলার রুচি অনুযায়ী পরিবর্তন ঘটান। রুশদেশীয় লেবেদেফের এই সাফল্যে তৎকালীন ইংরেজ ( “ক্যালকাটা থিয়েটার”) কর্তৃপক্ষ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। বণিক ইংরেজদের চক্রান্তের শিকার হন তিনি। এ সময়ের মধ্যে একবার তিনি ঋণের দায়ে গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পাওয়ার পর নানা দেশ ঘুরে অবশেষে ১৮০১তে স্বদেশে ফিরে যান।
মে, ১৭৯৭ সাল “ক্যালকাটা থিয়েটার” কর্তৃপক্ষের ঈর্ষান্বিত বৃটিশ দুষ্টু চক্রের অগ্নি সংযোগে ভস্মীভূত হয়ে যায় লেবেদেফের সাধের “দি বেঙ্গলী থিয়েটার”। এই ভাবে লেবেদেফের বাংলায় নাট্য প্রচেষ্টা শেষ হতে শুরু করে। অপমান আর লাঞ্ছনা নিয়ে রাশিয়া ফিরে যান ১০ ডিসেম্বর ১৭৯৭ তে। সেখানে গিয়ে রাশিয়ার ফরেন কলেজের অনুবাদক ও কোর্ট কাউন্সিলর পদে নিযুক্ত হন এবং ‘নাইট’ উপাধি লাভ করেন। রাশিয়ার সম্রাটের অর্থে ‘ইম্প্রিমের ইন্ডিয়েনে’ নামক বাংলা ছাপাখানা স্থাপন, একটি ব্যবহারোপযোগী অভিধান ও বাংলা পাটিগণিত প্রণয়ন এবং ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের অংশবিশেষ রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন।
তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো: “এ গ্রামার অব দি পিওর অ্যান্ড মিক্সড ইস্ট ইন্ডিয়ান ডায়ালেক্ট” (লন্ডন, ১৮০১), “অ্যান ইম্পারশিয়াল কনটেমপ্লেশন অব দি ইস্ট ইন্ডিয়ান সিস্টেম অব ব্রাহ্মিনস” (সেন্ট পিটার্সবার্গ, ১৮০৫), “এ কালেকশন অব হিন্দুস্থানি অ্যান্ড বেঙ্গলী আর্যস” ইত্যাদি। ১৫ জুলাই ১৮১৭ গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফের অসময়ে মৃত্যু হয় ; মস্কোর লেনিনগ্রাডে তাঁর সমাধি রক্ষিত আজও।
লেবেদেফকে নিয়ে যেসব নাটক বাংলায় লেখা হয়েছে তার মধ্যে-
- লেবেদেফ, প্রথম অভিনয় ২০.৮.১৯৬৫ থিয়েটার সেন্টার। উপন্যাস : প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র। নাট্যরূপ নির্দেশনা তরুণ রায়।
- লেবেদেফ। নাট্যকার চিত্তরঞ্জন ঘোষ, ২৮.৫.১৯৯৫ অন্য চেতনা, নির্দেশনা :দেবব্রত দাশগুপ্ত।
- ১০.১২.১৯৯৫ নান্দীপট, নির্দেশনা : বিমল চক্রবর্তী।
- ১২.৬.২০০৪ নকশা, গোবরডাঙা। নির্দেশনা আশিস দাস।
- লেবেদেফ নামে নাটক লেখেন বাংলাদেশের নাট্যকার মামুনুর রশীদ।
লেবেদেফকে নিয়ে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে অরুণ সান্যাল রচিত “বাঙালী সংস্কৃতি ও লেবেদেফ”, হায়াত মামুদ রচিত “গেরাসিম লেবেদেফ “, “কলকাতায় আমি ও অামার থিয়েটার”, সম্পাদনা তন্দ্রা চক্রবর্তী, ড.প্রতাপ চন্দ্র চন্দের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস “লেবেদেফের রঙ্গিনী”, “লেবেদেফের জীবন কথা” ইত্যাদি বইগুলি আজও জাতীয় গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থেকে ধুলো বালি কণা মেখে মুক্তির স্বাদ এনে দেয় আমাদের।
ঋণ: প্রদ্যোত ঘোষ, গৌতম ঘোষ, কমল সাহা,
বাংলা নাট্যের ভগীরথ সম্পর্কে জানতে এই লেখা পড়তেই হবে।
I’m more than happy to uncover this page. I need to to thank you for ones time due to this fantastic read!!
I definitely liked every bit of it and I have you saved to fav to check out new things
in your site.
May I simply just say what a relief to find someone who truly understands what they are discussing on the web. You definitely understand how to bring a problem to light and make it important. More and more people ought to check this out and understand this side of your story. Its surprising you arent more popular because you definitely have the gift.