থিয়েটারে একটা শক্তিশালী প্রজন্ম উঠে আসছে একথা গত পর্বগুলোতেও বলেছি।আসলে বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ নতুন জেনারেশন নিজেরা নিজেদের নিঙড়ে এরা সমৃদ্ধ করছে থিয়েটারকে। বিভিন্ন নাট্যদলে এই তরুণ প্রজন্ম বিজয়কেতন উড়িয়ে ঘোষণা করেছে , তারা থিয়েটারেই থাকতে চায়। এমনই একটি উজ্জ্বল মুখ শরণ্য দে। থিয়েটারকে ভালবেসে যারা থিয়েটারের জন্য প্রতিনিয়ত শ্রম ও সময় দিচ্ছে শরণ্য তাদের অন্যতম।
যাদবপুরে বেড়ে ওঠা শরণ্য থিয়েটারে এসেছে ভালবেসেই। শরণ্য একেবারে ছোট থেকেই থিয়েটার দেখায় অভ্যস্ত ছিল। সিনেমার চেয়েও থিয়েটার তাকে বেশি আকর্ষণ করত । থিয়েটারের মঞ্চে কুশীলবদের অভিনয় দেখতে দেখতে কোথাও একটা ভালবাসা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে বেঁচে থাকার পথটা বড় কঠিন জেনেও সেই কঠিনেরেই ভালবেসেছে শরণ্য।
অবশ্য থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণের আর একটা কারণ ছিল শরণ্যর । বাবা হরিদাস দে নব্বই এর দশকে অভিনয় করেছেন ‘নান্দীকার’ দলে। নান্দীকারের ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’,’এক থেকে বারো’ প্রভৃতি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। মা শিপ্রা দে ছেলের থিয়েটার করার ইচ্ছেতে প্রেরণাই জুগিয়েছেন। তাই শরণ্যর থিয়েটারে আসতে কোন সমস্যা হয়নি।
একজন ছাত্র হিসাবেও শরণ্য মেধাবী হিসাবেই চিহ্নিত । দশম শ্রেণি পর্যন্ত বালিগঞ্জ কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়ার পর সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
তার জীবনযাপনের দুটি পথ। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো আর থিয়েটার করা। শরণ্যর কথায়, থিয়েটারের জীবনটা তার বেশ ভাল লাগে। এখানেও নিজের মেধাকে প্রমাণ করা যায়। আর হলো থিয়েটার জীবনবোধের মাধ্যম।
এই শরণ্যর থিয়েটারে আসার ইচ্ছেটাও জাগে থিয়েটার দেখে। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তখন শরণ্য। আকাদেমিতে ‘নয়ে নাটুয়া’ দলের গৌতম হালদার অভিনীত ‘বড়দা’ নাটকটা দেখে সে প্রায় চমকে যায়। আঠারোর যৌবন আকুল হয় থিয়েটারের জন্য। তাই যখন সে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন যোগ দেয় গৌতম হালদারের ‘নয়ে নাটুয়া’ দলেই। শুরু হল থিয়েটারে পথ চলা। থিয়েটার করতে করতেই সে থিয়েটার শিখেছে। শেখার একটা অসীম ইচ্ছা তাকে যেন তাড়া করে বেড়াত। এছাড়া মণীশ মিত্র, গৌতম হালদার, প্রসন্নজীর মত থিয়েটার প্রশিক্ষকের সান্নিধ্য তাকে একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
অভিনয় করতে করতেই নিজে ‘টেন্থ প্ল্যানেট’ নামে নাটকের দলও তৈরি করে। শরণ্যর নির্দেশনায় এই দলের বিভিন্ন প্রযোজনা থিয়েটারের দর্শকদের মন ভরিয়েছে। টেন্থ প্ল্যানেট এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো – একটি সেলসম্যানের মৃত্যু, গ্যালিলিও, বাদল সরকারের ‘বীজ’ নাটক অবলম্বনে বীজ – A Reconstruction, একটি বন্ধ পোস্ট অফিস ইত্যাদি। একটি সেলসম্যানের মৃত্যু নাটকে বাংলা থিয়েটারের সুপরিচিত অভিনেত্রী সীমা ঘোষ অভিনয় করেছেন। একটি বন্ধ পোস্ট অফিস নাটকটি পশ্চিমবঙ্গ নাট্যমেলা, পূর্ব পশ্চিম নাট্য উৎসব, লোকরঙ্গ নাট্য উৎসবে মঞ্চস্থ হয়ে দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে।
নিজের দলের বাইরে অশোকনগর নাট্যমুখ, কসবা অর্ঘ্য, পূর্বরঙ্গ, যাদবপুর মন্থন, কাব্যকলা মনন প্রভৃতি নাট্যদলে অভি চক্রবর্তী, মণীশ মিত্র, মলয় রায়, রাজীব বর্ধন, সুমিত কুমার রায় প্রমুখ পরিচালকের অধীনে কাজ করেছে শরণ্য। মণীশ মিত্রর নির্দেশনায় ‘ড: ফস্টাস’ ( Dr. Faustas) ‘ম্যাকবেথ বাদ্য’, ‘আমেরিকান ফুটবল’, অভি চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘টু সোলস’, মলয় রায়ের পরিচালনায় ‘স্পার্টাকাস’, ‘পাঁচ অধ্যায়’, যাদবপুর মন্থনে রাজীব বর্ধনের পরিচালনায় ‘ডাম্ব ওয়েটার’ ( Dumb Waiter), সুমিত কুমার রায়ের পরিচালনায় কাব্যকলা মনন এর প্রযোজনা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ নাটকে শরণ্য নিজের অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। তার নিজের পরিচালনায় ম্যাকবেথ, ‘একটি সেলসম্যানের মৃত্যু’ দর্শকদের ভাল লাগার নাটক হয়ে উঠেছে।
একটা কিছু করার তাগিদ থেকে, নিজের সৃষ্টিশীলতাকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা থেকে, মনের খিদে মেটাতে এবং অবশ্যই নিজের দক্ষতাকে শক্ত মাটিতে দাঁড় করাতে শরণ্য নিজের ‘টেন্থ প্ল্যানেট’ ( ২০১৭ সালে) নাট্যদল গঠন করে। অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেকে পরিচালক হিসাবেও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। একটি সেলসম্যানের মৃত্যু নাটকের অভিরূপ চ্যাটার্জী, টু সোলস নাটকের জিম, আমেরিকান ফুটবল নাটকের হ্যারল্ড পিন্টার চরিত্রগুলো তার প্রিয় চরিত্রের তালিকায়।
প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পাশাপাশি নন প্রসেনিয়াম থিয়েটারেও অভিনয় করেছে শরণ্য। বাড়িতে বাবা থিয়েটারের মানুষ হওয়ার সূত্রে অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে।শরণ্যর ভাই পাঞ্চজন্যও মিউজিসিয়ান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। ছোটবেলা থেকেই নাচ, গান, বইপড়া এবং পরবর্তীতে দেশ বিদেশের থিয়েটারের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করার অভ্যাস তাকে এই শিল্পচর্চার জগতে নিয়ে এসেছে।
শিল্পচর্চার পথে নেমে পড়া মানেই একটা লড়াই। সেই লড়াইএ জিততে চায় শরণ্য ‘হ্যামলেট’ দে। তার বিশ্বাস, এমন একটা মাধ্যমকে সে ভালবেসেছে যেখানে নানা চরিত্রকে মাধ্যম করে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করা যায়। তাই থিয়েটারের পথই শরণ্যর পথ।
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, এই কঠিন সময়ে থিয়েটার নিয়ে বেঁচে থাকার ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক? … এ প্রসঙ্গে শরণ্যর অভিমত হল, তৃতীয় বিশ্বের দেশে যে কোন শিল্পকলা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই ঝুঁকি। তবু
সেই ঝুঁকি নিয়ে থিয়েটারের মত মাধ্যমে যুক্ত হয়ে সে কোন ভুল করেনি বলেই মনে করে।থিয়েটারে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে করতে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে আবিষ্কার করে শরণ্য। সেই আবিষ্কারের আনন্দই তার অভিনয়ের জীবনের আনন্দ। আর সেই আনন্দেই থিয়েটারে থেকে যেতে চায় শরণ্য।
Thank you so much ❤️ Loads of love.
তোমায় নিয়ে এই শব্দ আলোড়ন ছড়িয়ে দাও।
সবাইকে জানাও। আমরাও সমৃদ্ধ হবো।
অভিনন্দন।আরো কাজ হোক।আরো সুনাম হোক।শুভেচ্ছা।