অভিনেত্রী বহ্নি চক্রবর্তীর জীবনে থিয়েটারের সঙ্গে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। জ্ঞানোন্মেষের পরেই সে চিনেছে থিয়েটারের মঞ্চ, আবহ, আলো আর থিয়েটারের সংলাপ। পিতামহ কানাইলাল চক্রবর্তী থিয়েটার করলেও বহ্নি তাকে দেখেনি। কিন্তু বহ্ণির বাবা বিশিষ্ট অভিনেতা, নির্দেশক বাবুন চক্রবর্তীর কাছে শুনেছে, তাদের বাড়িতে বঙ্কিম ঘোষ, সবিতাব্রত দত্ত, গীতা দত্ত প্রমুখ তৎকালীন থিয়েটার জগতের অভিনেতা অভিনেত্রীদের আসা যাওয়া ছিল।বহ্নি সেই ছোটবেলা থেকেই দেখেছে বাবা বাবুন চক্রবর্তী আর মা উমা চক্রবর্তীকে অভিনয় করতে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই থিয়েটারের সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়েছিল বহ্নি। বীরভূমের সিউড়িতে বড় হয়ে ওঠা বহ্নি লেখাপড়া সিউড়ি সরোজবাসিনী স্কুল এবং আর টি গার্লস হাই স্কুলে।
মঞ্চে তাকে নামতেই হয়েছিল। সেটা ১৯৮৮ সাল। সিউড়ি আনন এর “ফুলমোতিয়া ” নাটকে। ছোটবেলা থেকে থিয়েটার দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে বহ্নির বাড়ির ড্রয়িং রুমেই নাটকের সিটিং রিহার্সাল হত। থিয়েটারের সরঞ্জামে ঠাসা বাড়িতেই ছিল খাওয়া পরার দৈনন্দিন জীবন। বহু নাটক মহলা থেকে মঞ্চে আসার সাক্ষী বহ্নির জীবনে এ ভাবেই রোপিত হয়েছিল থিয়েটারের বীজ। একসময় বহ্নির মনে হয়েছিল জীবনের যে কোন কথা তুলে ধরতে থিয়েটারই সেরা মাধ্যম। তাই সে থিয়েটারে। আর সেই বহ্নি অভিনয় করতে করতে মিনার্ভা রেপার্টারি থিয়েটারে “খড়ির গণ্ডি” নাটকে জুয়েলারি ডিজাইনিং, জুয়েলারি তৈরি এবং নির্ণয় নাট্য সংস্থার “আলবিদা” নাটকে কস্টিউম ডিজাইনিং করেছে। অর্থাৎ অভিনয়ের পাশাপাশি থিয়েটারের এমন সব কাজেও দক্ষতা প্রমাণ করেছে। যদিও এ সবই তার থিয়েটারের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির একটা নাট্য কর্মশালা এবং একটা কেন্দ্রীয় নাট্য কর্মশালায় অংশগ্রহণের সূত্রে অরুণ মুখোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, রমাপ্রসাদ বণিক, সোহাগ সেন, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, দেবেশ রায়চৌধুরী , সুমন মুখোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশ দত্ত, দেবকুমার পালের মত সব বিশিষ্ট নাট্যজনদের স্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছে বহ্নি।এরপর আর থিয়েটার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায়?….. সেটা সে ভালো ভাবেই বুঝেছিল। সিউড়ি থেকেই শুরু তার থিয়েটারে অভিনয়। সিউড়ির সুপরিচিত নাট্যদলে বাবুন চক্রবর্তীর পরিচালনায় ফুলমোতিয়া, পিদিমের আলো, মিছিল, মহাজ্ঞানী, দ্বাদশ ভক্তা চাড়ুম, খোল খঞ্জনী, পান্তা বুড়ি, কিনু কাহারের থ্যাটার, কামার কাহিনি, চোর, হু ইস দ্য গ্রেটেস্ট, ভূত না পুত নাটকে অভিনয় করেছে। এই আনন দলেই উজ্জ্বক হকের পরিচালনায় অন্ধের নগরী চৌপাট রাজা, বুদ্ধিওয়ালা, খেলাঘর, পীযূষ দের পরিচালনায় নিলাম, উত্তম চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় দম্পতি নাটকে অভিনয় করে বহ্নি চক্রবর্তী বিভিন্ন চরিত্রে নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করল।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সুবিনয় দাসের পরিচালনায় “ঢোলিয়া ” নাটকের পথ পেরিয়ে বীরভূমের আনন দলেও বহু নাটকে বহ্নির অভিনয় প্রশংসিত হল। বীরভূমের আনন দলে বাবুন চক্রবর্তীর পরিচালনায় পাগলা ঘোড়া, অনির্বাণ, ঈশ্বর, হরকালী সামন্ত সংঘের রবীন্দ্র জয়ন্তী, মহাজ্ঞানী, সাগরের এক বেলার প্রেম এবং ভাই তথাগত চক্রবর্তীর পরিচালনায় বশীকরণ নাটকে অভিনয়ের পথ পেরিয়ে সিউড়ির বহ্নি পৌঁছে গেল কলকাতার চেতনা নাট্যগোষ্ঠীতে। এমন একটি নাট্যদলে যুক্ত হওয়ার সূত্রে অভিনয়ের বিস্তৃত ক্ষেত্রে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেয়ে গেল বহ্নি। চেতনা দলে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মানুষ কিংবা কোলবালিশ, চিরকুমার সভা, পুতুলনাচের ইতিকথা সহ সুজন নীল মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় হরিপদ হরিবোল নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেল। আর চেতনা ছাড়াও থিয়েটার ওয়ার্কশপ, অন্য থিয়েটারর মত নাট্যদলেও অভিনয় করেছে সে। থিয়েটার ওয়ার্কশপে অশোক মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মুছে যাওয়া দিনগুলি এবং অন্য থিয়েটারে অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় অলীকবাবু নাটকে অভিনয়ের সুযোগ মিলেছে। এছাড়া সুব্রত দত্ত, সঙ্গীতা পাল, কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়, পার্থসারথী রাহার মত নির্দেশকদের অধীনে অভিনয়ের সুযোগ এলো লাভ এরিয়া লাভ এরিয়া (অণ্বেষক), রস, ইয়ারমা (নির্ণয়), ঠাম্মি (অশোকনগর প্রতিবিম্ব) প্রভৃতি নাটকে।
এরপর বহ্নি থিয়েটার এবং অভিনয় নিয়ে বাঁচার স্বপ্নকেই লালন করছে। শুধু থিয়েটার নয়, দূরদর্শন ধারাবাহিকের জগতেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে সে। থিয়েটারে যে প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল সিউড়ির বাড়ির ড্রয়িং রুমে সেই শিক্ষা এখন বিস্তৃত অভিনয়ের নানা মাধ্যমে। আকাশ ৮ এ “স্বামী বিবেকানন্দ” ধারাবাহিকে গোকুল মিত্রের স্ত্রী দেবকী এবং স্টার জলসায় “আলতা ফড়িং” ধারাবাহিকে ছোট কাম্মা চরিত্রে অভিনয় তার নিত্যদিনের সহচর হয়ে উঠেছে। তাই অভিনয়কে জীবনে জড়িয়ে নিয়ে বহ্নি সবটুকু কৃতজ্ঞতা দিতে চায় বাবা বাবুন চক্রবর্তী আর মা উমা চক্রবর্তীকে। ভাই তথাগতও অভিনয়ের জগতে পরিচিত। তাই থিয়েটারটাই তার পরিবার হয়ে উঠেছে ।
অভিনীত অজস্র চরিত্রের মধ্যে চিরকুমার সভা নাটকে নীরোবালা, চোর নাটকে কাদম্বিনী, অলীকবাবু নাটকে হেমাঙ্গিনী, রস নাটকে ফুলবানু আর কিনু কাহারের থ্যাটার নাটকে জগদম্বা তার প্রিয় চরিত্রের তালিকায়। নির্ণয় আর বীরভূমের আনন দলের নিয়মিত অভিনেত্রী বহ্নি মাঝে মাঝে ভাবে, বাড়ির ড্রয়িং রুম থেকে যে নাট্যপ্রেম শুরু তা পরবর্তীতে বিস্তারিত অভিনয়ের প্রশস্ত ক্ষেত্রে। “নিফা” অভিনয় শিক্ষাকেন্দ্রে যুক্ত থাকার সময় জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, (পি এল টি) সহ চিত্র পরিচালক রাজা সেনের কাছেও অভিনয় শিক্ষার সুযোগ হয়েছিল বহ্নির।
অভিনয়কে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার ব্রত নিয়েই সিউড়ি থেকে কলকাতায় চলে এসেছিল বহ্নি। নানা নাট্যদলে নানা চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ মিললেও সে একসময় অনুভব করেছে, এ বড় কঠিন কাজ। বিশেষত করোনা বিপর্যয়ে থিয়েটারজীবীদের সঙ্কট সে দেখেছে খুব কাছ থেকে কিন্তু অভিনয় সে ছাড়েনি। অভিনয়ের মাধ্যম বদলে দূরদর্শন ধারাবাহিকে অভিনয় করেছে। তবে থিয়েটারের চরিত্রগুলো তার স্মৃতিতে একান্তে ভিড় করে। তাই বহ্নি জানিয়েছে, জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা আছে থিয়েটারের সঙ্গেই।
বহ্নির অভিনয় জীবন শুরুতে নাট্যমুখ নাট্যপত্র ওর ইন্টারভিউ নিয়েছিল।
খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসা রইলো।