বহুদিন ধরে ভাবছি, আমাদের থিয়েটারের রোগের কারণটা কি? অসুখ কোথায়? মস্তিষ্কে নাকি লিভার প্রবলেম? সমস্যা ছাড়া জীবন অচল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মানব জীবন ও সমাজ জীবনের তটরেখায় একটার পর একটা সমস্যার ঢেউ আছড়ে পড়ে। এখান থেকে মুক্তি নেই। সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে ভেঙে জীবনের পানসি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে।
৫০ কিংবা ৬০ এর দশকেও থিয়েটারের সংকট ছিল। আজও আছে। থিয়েটারের মানুষজন প্রায় সকলেই বলেন এবং বিশ্বাস করেন যা কিছু সংকটের চেহারা তারা দেখতে পান , তা হল বাইরের সংকট। অর্থাৎ ৭০ এর দশকে বলা হত, স্বৈরাচারি সিদ্ধার্থ-শংকরের পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে থিয়েটার করা যায় কি? সে সময় একটার পর একটা নাটক বেআইনি ঘোষণা হচ্ছে। নাট্যকর্মীরা খুন হচ্ছে! জেলে চলে যাচ্ছে! থিয়েটারের মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে! আবার ৮০ র দশকে থিয়েটার মঞ্চস্থ করবার বাজেট বেড়ে যাচ্ছে। তীব্র আর্থিক সংকট শুরু হয়ে গেছে। কলকাতায় হল ভাড়া নিয়ে থিয়েটার করতে গেলে এক দিনে ৩০০০০ টাকা প্রয়োজন হয়। পরিবর্তে ৩০ জন দর্শক খুঁজে পাওয়া যায় না। সে সময় দু-চারটি বড় বড় দল ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের মোটা অংকের অনুদান বাকিরা কেউ পেত না।
এখানে বলে রাখা ভালো, উৎপল দত্তের নাটক কোনদিন দর্শক আনুকূল্য হারায়নি। কলকাতার হলগুলোতে পি এল টির নাটক মানে, হাউসফুল। বহুবার আমি হলের মধ্যে অতিরিক্ত দর্শককে ঢুকে পড়তে দেখেছি। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় মাছি তাড়াতেন। কালে ভদ্রে তাঁর কপালে দর্শক জুটে যেত। কুমার রায়ের বহুরূপীর নাটকও দর্শক ধন্য হয়েছিল। থিয়েটার ওয়ার্কশপেরও দর্শক ছিল। মেঘনাথ ভট্টাচার্য বাণিজ্যিক কায়দা মেনে নিয়ে দায়বদ্ধ করেছিলেন। ব্যবসা জমে উঠেছিল। অন্যদের অবস্থাটা ছিল করুন। ৫০ জন দর্শক টিকিট কেটে হলে ঢুকলে, ১০০ জন দর্শক আসতেন কমপ্লিমেন্টারি টিকিট নিয়ে। জেলার প্রতিযোগিতা মঞ্চের আসরে স্থানীয় দর্শকরা আসা-যাওয়া করতেন। তবে যেদিন টেলিভিশনে জনপ্রিয় কোন সিরিয়াল থাকতো, সেদিন থিয়েটারের মঞ্চে দর্শক পাওয়া মুশকিল হতো।
২০০০ সাল থেকে শুরু হল অন্য আরেক ধরনের সমস্যা। নাটকের দলে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আসছে না। বাজার অর্থনীতির যুগে কিছু ছেলে মেয়েরা কেরিয়ার সর্বস্ব হয়ে পড়েছে। থিয়েটারের প্রতি প্রেম নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। বিগত ১৫ বছর ধরে গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট হারিয়ে যেতে বসেছে। কোম্পানি থিয়েটারের প্রবক্তাদের জন্য হারিয়ে যেতে বসেছে আদর্শবাদের থিয়েটার। অথবা মালিক থিয়েটার। গ্রুপ শুধু নামে, ভাড়া করা সৈনিক নিয়ে আত্মসাৎ , লুটের থিয়েটার এখন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেখা গেল, শাসকদলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে না পারলে দল বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
একটার পর একটা সরকারি হলের ভাড়া দ্বিগুণ তিন গুণ হয়ে গেল। জেলায় জেলায় অসংখ্য নাট্য উৎসব বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেল। আগে নাট্যকাররা অনেকেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী নাটক রচনা করতেন। নাটকের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল জীবন সংগ্রামের কুরুক্ষেত্র। অন্যদিকে পেশাদারিত্বের অজুহাতে থিয়েটার নিয়ে বাণিজ্য করতে গিয়ে, না হচ্ছে বাণিজ্য, না হচ্ছে থিয়েটার। হাতে হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন চলে আসার পর, নাটকের দলগুলো মোবাইল ফোনটাকে নিজেদের দলের প্রচারের জন্য হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল। অনেকেই বলতে শুরু করল, এখন থিয়েটার হয় মোবাইল ফোনে। বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। দলগুলোর মুখ ঢেকে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের আড়ালে।
গিরিশ ঘোষের সময়ও সংকট ছিল। অনবরত অভিনেতাদের দলবদল। লেংগি মারামারি। পারস্পরিক কাঁদা ছোড়াছুড়ি। এমনকি থিয়েটার চলাকালীন সময়েও চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা! কোন অভিনেতা অপর কোন অভিনেতাকে অপদস্ত করবার প্রতিযোগিতা চলতো। মদ্য পান আর বেশ্যা আসক্তির ব্যাপারটা না হয় ছেড়েই দিলাম। রবীন্দ্রনাথ এই কারণে কখনো পাবলিক থিয়েটারে পা রাখার কথা ভাবেননি। পাবলিক থিয়েটারে সে সময় সৃজনশীল কাজ হতো না। থিয়েটারের মালিকের বাণিজ্যিক স্বার্থে যেসব নাটক চলতো, তাকে আমরা কুরুচি কর না বললেও, মান এর দিক থেকে উপরের দিকে রাখা যাবে না। আমার মত চার দশক ধরে বাংলা থিয়েটারের দর্শকদের খোলা মনে নাটক ওয়ালাদের বিপক্ষে কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, ভালো লাগছে না। আজকের দিনের ৯৮% দলের থিয়েটার বসে দেখা যায় না। ক্রমাগত মান নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। থিয়েটারের লোকজন সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, বাইরের সংকটের কথা। বলবেন, ভালো থিয়েটার করতে গেলে ভদ্রস্থ টাকা লাগে। লাল চা মুড়ি তেলে ভাজা খেয়ে ভালো থিয়েটার করা যায় না। ১২ ঘন্টা অফিস কাচারি করে মহলা দেবার সময় যথেষ্ট এনার্জি থাকে না। তাছাড়া সুস্থ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দরকার। যার অভাব এই সময় যথেষ্ট হয়েছে। নাট্যশিল্পীদের আর্থিক নিরাপত্তা দরকার। দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন যাপন দরকার।
এইসব যুক্তির বাইরে তারা বলবেন না যে, সুশিক্ষিত নাট্যকর্মী দরকার। থিয়েটার বিজ্ঞান না জানা অশিক্ষিত নাট্যকর্মী দিয়ে থিয়েটারের মান বাড়ানো যায় না। যদি কেউ ফুটবল ক্রিকেট খেলতে চায়, তাহলে তাকে ওই খেলা গুলো শিখতে হবে। সুদক্ষ হতে হবে। প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা অভ্যাস করতে হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। একইভাবে কেউ যদি গান শিখতে চান, তাহলে কঠোর অনুশীলন ছাড়া সম্ভব হবে না। আমাদের থিয়েটার ওয়ালাদের যদি বলা হয়, কাল আপনাকে ফুটবল মাঠে নামতে হবে। কিংবা অমুক সঙ্গীত সম্মেলনে গান গাইতে হবে। এদের অবস্থা কি হবে বলুন তো? হাজার হাজার প্রাণ হাতে নিয়ে ট্রেনের ড্রাইভার, উড়োজাহাজের পাইলট যে দায়িত্ব পালন করেন, সেই দায়িত্ববোধ, সেই নিষ্ঠা, কতজন নাটক ওয়ালার মধ্যে আমরা দেখতে পাই বলুন তো?
একবার পি এল টি তে নবাগত অভিনেতা নেওয়া হবে জানতে পেরে অনেকেই ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন। একটি ছেলে বিপুল আবেগ নিয়ে উৎপল দত্তকে বলতে শুরু করেন, আমি থিয়েটার পাগল। আমি বদ্ধ পাগল। উৎপল দত্ত কথাটা শুনে বলে উঠেছিলেন, থিয়েটার দলে পাগলদের জায়গা হয় না। তুমি রাঁচিতে চলে যাও। একই রকম ভাবে, উৎপল দত্ত বলতেন, আবেগ প্রবণতা থিয়েটার সহ সমস্ত শিল্প মাধ্যমে ভয়ংকর বিপদ। আবেগের পিচ্ছিল পথে যারা হাঁটেন তাদের দ্বারা জীবনের কোন ভাল কাজ সম্ভব না। আবেগ বস্তুটা মানবিক গুণ। কিন্তু কন্ট্রোল করতে হয়।
সাহিত্যক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, শিল্পীকে আবেগপ্রবণ হওয়া যাবে না। যুক্তিবাদী হতে হবে। যে কোন বিষয়কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলোধোনা করতে হবে। এইখানেই যত গোলমাল। আমাদের নাট্যকর্মীদের মধ্যে সীমাহীন আবেগ কাজ করে। নাটক লেখা, পরিচালনা করা, অভিনয় সবকিছুর মধ্যে আবেগের আতিশয্যে ভেসে যেতে যেতে তারা বুঝতেই পারেন না যে, তাদের কাজগুলো কতটা বরবাদ হয়ে গেল। চার দশক ধরে নাটক দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, ৯৫ শতাংশ নাটক যদি লেখা না হতো, মঞ্চস্থ না হতো তাহলে বাংলা থিয়েটার ক্ষতিগ্রস্ত হতো কি? এই কারণেই হয়তো আমরা ব্রেশট সাহেবকে বুঝতেই পারলাম না। ব্রেশট সাহেবের নাটকের যুক্তি, বিতর্ক, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আমাদের পছন্দ হলো না। আমাদের রবীন্দ্রনাথ কে আমরা পাবলিক থিয়েটারে, গ্রুপ থিয়েটার এ গ্রহণ করতেই পারলাম না।
একটা সময় আমি নাট্যকার রতন ঘোষ, শ্যামলতনু দাশগুপ্ত, অমল রায়, এবং আরো কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা অনেক নাটক তো লিখলেন। নাটকের মধ্যে বিপ্লব বিদ্রোহ লাল ঝান্ডা আরো অনেক কিছু গমগম করালেন। আমার প্রশ্ন, সেইসব নাটক কতটা শিল্পরসতীর্ণ হয়ে উঠল? কিছু কি সৃষ্টি করতে পেরেছেন? এই ব্যাপারে কোন দুঃখ যন্ত্রণা বা আত্মশ্লাঘা আছে কি? শ্যামলতনু বাবু আমাকে বলেছিলেন, আমার দায়িত্ব ছিল লাল রং, লাল আলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই উত্তর আমার কাছে আশ্চর্য জনক মনে হয়েছিল। লাল রং চেনা বার দায় একজন নাট্যকার নেবেন কেন!!!
অমল রায় বলেছিলেন, সময় আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। আমি সময়ের দাস হিসেবে কাজ করেছি। এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না। এও এক ধরনের হতাশা। কারণ অমল রায় বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর নাটক খুব বেশি দিন কার্যকর হবে না। চিরায়ত হবার ভাবনা তাঁর ছিল না। গণনাট্য সংঘের নাট্যকারদের মধ্যেও একই রকম ধারণা বদ্ধমূল ছিল। তাঁরাও বলতেন, শিল্পকর্ম করবার আগ্রহ তাঁদের ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির কথা প্রচার করবার দায় নিয়েছিলেন তাঁরা। আমার প্রশ্ন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিজমের দর্শনে বিশ্বাসী দিকপাল কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকারদের কেউ কমিউনিস্ট পার্টির লেজুর বৃত্তি করার জন্য শিল্পকর্মে আত্মনিয়োগ করেননি। তাঁরা সবাই ছিলেন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁরা বলতেন, শিল্প সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই সত্যের কাছে পৌঁছতে হয়। যা স্লোগান সর্বস্ব, প্রচার মূলক তার পরমায়ু, অভিঘাত অত্যন্ত সীমিত।
মোহিত চট্টোপাধ্যায় বাংলা থিয়েটারের জন্য বেশ কিছু অন্য ধারার আঙ্গিক প্রয়োগ করেছিলেন। মোহিতবাবু বাস্তববাদকে প্রায় বর্জন করেছিলেন। একদিন আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার নাটকগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিদেশি নাটকের এক রকম অনুবাদ বলা চলে। সেইসব অনুবাদ মূলক নাটক, বা বঙ্গীকরণ নাটকগুলো আপনার নামে চলে কেন? তাছাড়া ওইসব বিদেশি নাটকগুলো অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি যা লিখেছেন, সেগুলো কি যথার্থ অর্থে শিল্পরসর্তীণ ? দেশজ আঙ্গিক বর্জন করে আপনি কি পেরেছেন ভিন্ন দেশের আত্মার সঙ্গে বাংলার আত্মাকে একাকার করে দিতে? উৎপল দত্ত মশাই ও বিদেশী নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটক লিখে গেছেন। সেই সব নাটক পাঠ করলে, মঞ্চস্থ হতে দেখলে, আমরা একাত্ম হয়ে পড়ি। ব্যারিকেড নাটকের ঘটনা আমার রাজ্যের ঘটনা বলে মনে হয়। মানুষের অধিকার নাটকটি দেখার পর কখনো মনে হয় না ওটা দক্ষিণ আমেরিকার কোন অঞ্চলের ঘটনা। উৎপল দত্ত জানতেন কিভাবে অন্য সুরকে আত্মস্থ করতে হয়। রবীন্দ্র সংগীতের বিভিন্ন গানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সুরের মূর্ছনা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বুঝতেই পারি না যখন গান শুনি। মনে হয় সুরের এই সংশ্লেষ একেবারে দেশজ। সলিল চৌধুরীর সংগীতের মধ্যেও এইরকম আশ্চর্য রকম সৃষ্টি অব্যাহত ছিল। সত্যজিৎ রায় ও তার সিনেমার গানে নানা রকম বিদেশি টিউন ব্যবহার করেছেন। তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন বাংলার লোকজ সংগীতের সুর। আমি নাট্যকারদের কাছে বারবার যে প্রশ্নটা করেছি, আপনি অনেক লিখেছেন, কতটা সৃষ্টি হয়েছে বলতে পারেন? কারখানাজাত পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য প্রাত্যহিক জীবনের স্থূল প্রয়োজনকে সাহায্য করে। আর শিল্প সৃষ্টির আনন্দ গোটা জীবনকে সুন্দরের পথে চালিত করে দেয়। ফুল ফোটে ফোটার আনন্দে। মালির ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মেটাতে নয়। বাঁদরের কাছে মুক্তোর মালার প্রয়োজন বিন্দুমাত্র নেই। শিল্প সৃষ্টির সাধনায় মানুষের সিদ্ধিলাভ ঘটে। সৌন্দর্য জিজ্ঞাসাহীন মানব সমাজ প্রকৃতি ও নিজেকে ধ্বংস করে।
খালেদ চৌধুরী মশাই তাঁর একটি বই প্রকাশ করতে গিয়ে ভূমিকায় লিখেছিলেন, গন্ডায় গন্ডায় নাটক তৈরি হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে কতটা? অনাসৃষ্টির কালো জলে প্রতিদিন যা ভাসমান তা দিয়ে জীবনের গান গাওয়া যায় না। এইখানেই আমাদের থিয়েটারের আসল সংকট। অসুখ মস্তিষ্কে। মেধাহীন, অযোগ্য কিছু মানুষ এখানে ঢুকে পড়েছে। তারমানে এ কথা বলছি না, যথেষ্ট প্রতিভাবান মানুষেরা এখানে নেই। এরা একেবারেই সংখ্যালঘু। এরা লেখাপড়া করেন। বিশ্ব থিয়েটার বিষয় নিয়ে এদের পাণ্ডিত্য রয়েছে। এরা নিজের মতো কাজ করে চলেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের সংখ্যাটা যেহেতু বেশি, তাই যোগ্য ব্যক্তিরা মর্যাদা পান না। বাংলায় যতগুলো নাটক কেন্দ্রিক পত্র-পত্রিকা রয়েছে সেগুলো ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে, যেসব নাটক সেখানে প্রকাশিত হয়, তার ৯০ শতাংশ প্রকাশ যোগ্য নয়। পাঁচ শতাংশ নাটক দুর্বোধ্য। ইউরোপের চতুর্থ শ্রেণীর নাটক। এইসব পত্রিকার সম্পাদকরা বলেন, আমরা তরুণ নাট্যকারদের উৎসাহিত করার জন্য চেষ্টা করি। আসলে এইসব সম্পাদকরা নিজেরাও যথেষ্ট শিক্ষিত নয়। এক পেশে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানচিত্র থেকে শ্রেষ্ঠ নাটক গুলো নির্বাচন করে বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন না।
বিগত দিনে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের হাজার খানেকের মত প্রতিযোগিতার আসর আয়োজন করা হতো। সেখানে বিচারকের আসনে যাঁরা বসতেন, সেখানেও অযোগ্য লোকদের ভিড় বেশি। সেইসব বিচারকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস ভূগোল জানেন না। আধুনিক নাটকের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা নানা রকম চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এইসব প্রতিযোগিতার আসর থেকে পুরস্কার পাওয়া নাটকগুলো যখন বাজার করে, অন্য দলগুলো ভেবে নেয় যে, ঐরকম ভাবেই নাটক লিখতে হবে। মঞ্চস্থ করতে হবে। তখন প্রতিযোগিতা স্পেশাল ধরনের একরকম নাটক তৈরি হতো। নাটক নিয়ে যেসব ম্যাগাজিন গুলো প্রকাশিত হয়, সেইসব কাগজের নাট্য সমালোচকরাও তাঁদের যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন করেননি। নাট্য সমালোচনার মান মোটেও ভালো না।
আমরা অনেকেই জানি, আমাদের অনেকের অভিজ্ঞতা রয়েছে, একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা ব্যাপারটা ছিল বামপন্থী রাজনীতির চর্চা কেন্দ্র। শিল্প সৃজন কেন্দ্র নয়। এইখানেই গভীর অসুখের বীজ লুকিয়ে রয়েছে। ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে, চল্লিশের দশকে সমগ্র দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পীদের সংঘ এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শিল্প-সংস্কৃতি জগতের দিকপাল মানুষেরা। সেই সময় আমাদের বাংলা সহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, কথাশিল্প, কাব্য জগতে যে ধরনের কালজয়ী কাজ সৃষ্টি হয়েছিল তার তুলনা পরবর্তী ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। নানা রকম কারণে ওইসব সংগঠন থেকে প্রতিভাবান শিল্পীরা সাহিত্যিকরা সরে গিয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল ভয়ংকর অবক্ষয়। এই কারণেই কুমার রায় বলতেন, প্রতিভাহীনদের জায়গা হয়ে গেল গণনাট্য সংঘ।
সলিল চৌধুরী ভয়ংকর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আমাদের চলে যাবার পর শুরু হল ভিগু ভে গু গণসংগীত। ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্তের মতো সৃষ্টিশীল মানুষেরাও গণনাট্যের জগত থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, ওখানে সৃষ্টিশীল কাজ হবার কোন সুযোগ নেই। আমরা দেখলাম, সেই ধারা থেকে গেল। কিছুই পাল্টালো না। সময় বদলায়। মানুষ বদলায়। তথাকথিত বামপন্থী পরিবৃত্তের মধ্যে অবস্থান করা নাট্যকর্মীদের কনসেপ্ট বদলায় না। বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটকের মত মাটির সঙ্গে মিশে থাকা, মানব জীবনের সমুদ্রে অবগাহন করা আর কোন নাট্যকারদের আমরা খুঁজে পেলাম না। মনোজ মিত্র মশাই কে অনেকেই বলেন, তিনি তখনকার দিনের অফিস ক্লাবগুলোর চাহিদা মিটিয়ে নাটক লিখেছেন। যদিও নিজের দলের জন্য কয়েকটি নাটক লিখেছেন যা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকগুলো নাটকের মধ্যে টলস্টয় এর গল্প নিয়ে পাপপূণ্য নাটকটি বাংলা থিয়েটারের মান বৃদ্ধি করেছিল। ৬০ এর দশক থেকে বৈচিত্র পিয়াসী হয়ে তিনি এবং তাঁর দলের কয়েকজন মনে করলেন, শেক্সপিয়র নয়, ইউরোপের অন্য সব নাটকগুলোকে বঙ্গিকরণ করতে হবে। চেষ্টা করলেন বটে, বাংলার দর্শকরা মোটেও সাড়া দিলেন না। শম্ভু মিত্রের মত রুদ্রপ্রসাদ, অজিতেশ বাবুরা মনে করতেন বোধহয় যে, গ্রুপ থিয়েটারের কালচার হল মাইনরিটি কালচার। অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষদের জন্য গ্রুপ থিয়েটারের নাটক একেবারেই অচল। ওঁরা অশিক্ষিত। ফাইন আর্টসের কিছুই বোঝেনা। অজিতেশ বাবুর পরপর নাটক গুলো ফাঁকা মঞ্চে অভিনীত হতে থাকলো। হাতেগোনা কয়েকজন টিকিট কেটে হলে ঢুকতেন। আমি নিজে দেখেছি, প্রতিদিন অভিনয়ের আগে অজিতেশ বাবুর প্রেসার বৃদ্ধি পেত।
বাদল সরকারের নাটক ও দেশের রাজনীতির সুস্পষ্ট চেহারা প্রকাশ পেত না। কার্জন পার্ক, রবীন্দ্র সদনের তিন তলার হল ঘরে হাতেগোনা কয়েকজন দর্শক ছাড়া বৃহত্তর অংশের সারা ছিল না। একই সময় উৎপল দত্তের নাটক যখন বিভিন্ন জেলা ও ছোট বড় শহরে প্রকাশ্য মঞ্চে অভিনীত হতো, ৫ কিংবা ১০ হাজার দর্শক ভিড় করতো। মুকুন্দরাম দাসের স্বদেশী যাত্রার মত অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল উৎপল দত্তের নাটক। কারণ তিনি শেক্সপিরিয়ানা তে বিশ্বাস করতেন। মনে রাখতে হবে বাংলা থিয়েটার শেক্সপিয়রের নাটক অবলম্বন করে শুরু হয়েছিল। উৎপল দত্ত জানতেন শেক্সপিয়রের নাটকের সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতির, আবেগের গভীর সম্পর্কের দিকগুলো।
কলকাতা কেন্দ্রিক বেশ কিছু নাটকের দল বাংলা থিয়েটার নিয়ে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গিয়ে ছিলেন। এরা কলকাতার এলিট হাতে গোনা দর্শকের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছিলেন। বাংলা থিয়েটারের কোন উন্নতি এদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। বাংলা সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যারা সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয় ধারাকে অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন, তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। থিয়েটার ব্যাপারটা ইউরোপ থেকেই এসেছিল। যেমন সিনেমা সম্পূর্ণভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা শিল্প মাধ্যম। আমরা দেখেছি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, যেমন চীন জাপান, লাউস ,কম্বোডিয়া ভিয়েতনাম তাদের নিজস্ব অভিনয় কলার মধ্যে আত্মস্থ করে নিতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, দক্ষিণ ভারত তাদের নিজস্ব লোক নাট্যর মধ্যে আত্মস্থ করতে পেরেছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর নাটক কে বাংলার যাত্রার আঙ্গিকে ঢালাই করে নিতে পেরেছেন। ঋত্বিক ঘটক যেমন ইউরোপ থেকে আমদানি সিনেমা শিল্প কে একেবারে বাঙালি করে নিতে পেরেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ছিল খাঁটি বাংলা সিনেমা। সত্যজিৎ রায় তাইতো বলেছিলেন, ঋত্বিক বাবুর সিনেমা আমার চেয়ে অনেক বেশি খাঁটি বাঙালি সিনেমা। কারণ ঋত্বিক ঘটকের নারীর যোগাযোগ ছিল বাংলার জলবায়ুর সঙ্গে। পূর্ববঙ্গের নদী আকাশ মাটি ও মানুষ কে তিনি দূর থেকে দেখেননি। অধ্যাপক শ্রেণীর নাক উঁচু মনোভাব নিয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব করেননি।
আমার মনে হয় বাংলা থিয়েটারের সংকট, গভীর অসুখ এইখানে। শিল্পবোধহীন , শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতির অনুগামী হওয়া প্রবণতা অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভাকে বামন করে দিয়েছে। হাজার হাজার নাট্যকর্মী আজও অন্ধকারে রয়ে গেছে। তারা জানে না, কোনটা আসল হীরা কোনটা নকল। জনপ্রিয়তা লাভের তাড়নায় রাজনীতিতে যে ধরনের বিপর্যয় ঘটে, নাটকের ক্ষেত্রেও একই বিপর্যয় ঘটে চলেছে। আজকে যিনি সরকারি কিংবা বেসরকারি পুরস্কার লাভ করে ভাবছেন, অমর হয়ে গেলাম। কালের বিচারে তার কাজ স্বীকৃতি না পেলে, ইতিহাস তাকে মনে রাখবে না। ইতিহাসের বিচার বড় নির্মম।
বাঙালি দর্শকের পালস বুঝতে পারতেন উৎপল দত্ত। তরুণ মজুমদার। সেই কারণেই তাঁরা সিদ্ধিলাভ করতে পেরেছিলেন। তবে বিগত এক দশক ধরে বাংলা থিয়েটার নিয়ে যারা কাজ করছেন, এদের মধ্যে আমি কোনো বাঙালিকে আবিষ্কার করতে পারিনি। যে বাঙালি, তার জন্মভূমির প্রতি প্রেমে অপ্রেমে আবেগে বিশ্বাসে আন্দোলিত হতে পারেন। জীবনানন্দ দাশের মত বাংলাকে হাতের তালুর মত চিনতে পারেন। তাদের সৃজনশীল নাট্যকর্মের মধ্যে বাংলার জল বাতাস আকাশ ধরা পড়ে না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, কবি ছাড়া জয় বৃথা। মনে রাখতে হবে বিভিন্ন দেশে বড় বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পেছনে শিল্পীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যেমন রুশ বিপ্লবের দর্পণ ছিলেন তলস্তয়। চেখভ, তুর্গে নিভ, ম্যাক্সিম গোর্কি, মিথাইল সলখাভ দের ভূমিকা অসামান্য ছিল। ফরাসি বিপ্লবের পেছনে, বাস্তিল দুর্গের পতনের কান্ডারী ছিলেন ফরাসি দেশের দার্শনিক, শিল্পী সাহিত্যিকরা। রাজনীতির বাহনে আরোহন করে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন ঘটানো যায় না। শিল্প সংস্কৃতির দর্পণে মানুষের মুখগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাইতো শিল্পী উচ্চারণ করে, আমার কোন ঘর নেই। আমার আছে আকাশ। আমার কোন বাঁধন নেই। আমার আছে নদীর স্রোতে পারাপার।
এই সংকটের মুক্তির পথ দেখার আশা রইলাম।