দীপা ব্রহ্ম
‘এখন আমার ৬৮ বছর বয়স। এর থেকে ১২ বছর বাদ দিয়ে দ্যান, অতদিন আমি আলকাপ করছি।’—কথাগুলি শোনান করুণাকান্ত হাজরা। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম মিথ তিনি। মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের একটি বহুল প্রচলিত লোকগ্রন্থনা আলকাপ। নিত্য নতুন কাঁচা কথা, গান নামে আলকাপ ব্যঙ্গকৌতুক পালা হিসেবে পরিচিত।
মুর্শিদাবাদকে বাদ দিলে মালদহ, বাংলাদেশের রাজসাহী, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বিহারের পূর্ববর্তী কিছু অঞ্চলে আলকাপ অনুষ্ঠিত হয়। কেউ বলেন ‘আল’ মানে আধুনিক কাপ, মশকরা থেকেই আলকাপ কথাটি এসেছে। আদতে আলাপ ও গম্ভীরার আঁতুর ঘর এটাই। এর সঙ্গে আলকাপ শিল্পী সুবেদ আলি শেখ-এর কথা থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে নানা কারণে যখন ইংরেজ যাত্রা, নাটক বন্ধ করে দেয়, তখন সুদূর গ্রামের মানুষজন খানিক নিজেদের বিনোদনের জন্য বাঁশতলায় সঙ সেজে শিবের মতো প্রায় অর্ধবস্ত্রে নাচানাচি, পালা অভিনয় করতো।
সরকারের প্রশ্নের উত্তরে সাধারণ মানুষ বলতো ওখানে কিছু আলকাপ হচ্ছে। অর্থাৎ ফাজলামো বা ফচকেমি চলছে। ‘আলকাপ’ ইয়ার্কি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তবে এই লোকপ্রীতির হালহকিকত ও তার সুবিস্তৃত চিত্রপট চোখের সামনে তুলে ধরলেন কিংবদন্তী আলকাপ শিল্পী করুণাকাস্ত হাজরা। এটা তাঁর পরম্পরা। দাদু রাজবল্লভ হাজরা, বাবা রামচন্দ্র হাজরা আলকাপে যুক্ত ছিলেন। বলা যায়, আলকাপের ঘর তাঁদের। এমনকি তাঁর স্ত্রী, ছেলে সবাই এ রঙ্গরসাত্মক আঙ্গিকটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি জানালেন, আলকাপের নিয়ম অনুযায়ী ছেলেরা মেয়ে সেজেই এই পালা করে। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘ছেলেরা যদি পারে, আমি এ যুগের মেয়ে, তো আমিই বা পারবো না কেন? এমনই মনোবাসনা থেকে তিনিও এ পালায় অংশ নেন। মুর্শিদাবাদে আলকাপ দলের সংখ্যা এখন বেশ কমে এসেছে। করুণাবাবুর দল ‘মা কালী আলকাপ’।
মুর্শিদাবাদে আরও রয়েছে কিছু দল। যেমন— ‘রাধামাধব আলকাপ’, ‘মা মনসা আলকাপ’ ইত্যাদি। করুণাবাবুর ওস্তাদ বা গুরু ঝাকসু মণ্ডল। তাঁর কাছে মহড়া নিয়েছেন প্রায় দশ বছর। ঝাকসু মণ্ডল বলতেন, ‘আল’ মানে হুল এবং ‘কাপ’ মানে কাব্য। কথার হুল অর্থাৎ কথার চালাচালি থেকে সৃষ্ট কাব্যই আলকাপ। কৃষিজীবন, চাষবাস, ছেলে বড়ো না মেয়ে বড়ো এসব নিয়ে আলকাপ পালাগুলি হয়। খানিক ভাঁড়ামো, রং-তামাশা এই
আঙ্গিকটিতে যুক্ত। বিভিন্ন পালা-পার্বণকে কেন্দ্র করে এই পালা বছরের বিভিন্ন সময় হয়। করুণাবাবু জানালেন, তাঁর দলে ছোকরারাই মেয়ে সেজে এখনও আলকাপের নিজস্বতা ধরে রেখেছে। এটিই তাঁর জীবিকা। তবে যখন দলে আলকাপ অনুষ্ঠান না থাকে, দলের সদস্যরা অন্যান্য ব্যবসা, চাষবাস করে দিন গুজরান। তাঁরা স্বামী-স্ত্রীও কখনও বিড়ি বাঁধতে বসে যান। এহেন সুধীপ্রধান পুরস্কারপ্রাপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ তথ্য সংস্কৃতি দফতরের মান্য শিল্পীকেও জীবিকার জন্য কষ্টার্জন করতে হয়। তবে বর্তমান সরকারের লোকশিল্পী ভাতা তাঁকে ও তাঁর দলকে অনেকটাই বাঁচানোর পথ দেখায়।
পঞ্চরস সম্পর্কে তাঁর মনোভাব থেকেই বোঝা গেল, তিনি তাঁর লোক আঙ্গিকে কতটা বিশ্বাসী। তাঁর মতে, চানাচুরের মতো টক, ঝাল, মিষ্টি মশলা বানানোর ফলশ্রুতি পঞ্চরস। তিনি জানান, চিতপুরের থেকে ছিটকে পড়া কিছু যাত্রাশিল্পী মুর্শিদাবাদকে ছুঁতে চলে আসে আলকাপের পরিচিতিকে ব্যবহার করতে। আলকাপের কাপটাকে রেখে, পালাতে চিতপুরের যাত্রাকে টেনে এনেছে তারা। এখানে মেয়েরাও যুক্ত হয়েছে। তিনি গাইলেন—’আলকাপে গান করা নয় অত সোজা, বুদ্ধি লাগে বোকার বোঝা।
আসর-বন্দনা, সংস্থার ছোকরাদের প্রেমিক-প্রেমিকার রং-তামাশা (লাব্বার বা লাভার নামে পরিচিত), এদের ঝগড়া-খুনসুটি, নানা দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসা সমাজের নানা সমস্যা, মোড়লের আগমন—এইভাবেই কাপ শেষে ছড়াদারের ছড়া শুরু, ছড়ার উতোর- চাপান শেষে পালা। একটা সম্পূর্ণ পালা শেষ হলে, আলকাপ অনুষ্ঠানও শেষ হয়। এ পালাকে করুণাবাবু ‘হঠাৎ কাব্য’ বলেন। এর কোনও স্ক্রিপ্ট নেই, প্রায় সবাই পরিচালক। অলটি, হারমোনিয়াম-বাদক, ছোকরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। বর্তমানে আলকাপ কিছুটা যুগের উপযোগী করা হয়েছে। বলা যায়, পাশাপাশি অন্যান্য মাধ্যমের চাকচিক্কের সঙ্গে পাল্লা দিতে খানিক ভাষাগত, সাজ-পোশাক, আলো, মেক- আপ এ কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু করুণাকান্ত হাজরা মনে করেন মুর্শিদাবাদের আলকাপ আছে আলকাপের ঘরেতেই।
অশোক বিশ্বনাথন, স্বপন বসু করুণাবাবুকে নিয়ে ডকুমেন্ট্রি করেছেন। তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলী, মহাশ্বেতা দেবীর মতো মানুষজনের। ‘আমি আদু’, ‘ফালতু’, ‘দুঃস্বপ্ন’ ছবিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি। এখন নিজের বাড়িতেই নতুন আলকাপ শিল্পীর তত্ত্বতালাশে তিনি ব্রতী। নানা প্রশিক্ষণ প্রায় সারা বছরই চলে। কলকাতার ব্লাইন্ড অপেরাতেও আলকাপের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন শিল্পী। তবে তাঁর স্পষ্ট মনোভাবে প্রকাশিত হল পঞ্চরস কখনোই আলকাপ নয়। তাঁর কথায় বনমানুষ থেকে যেমন সভ্য মানুষ হয়েছে। কিন্তু বনমানুষ শব্দটিকে আমরা তো মুছে ফেলতে পারি না। আগে ছিল কাঁচা পথ, এখন হয়েছে পাকা। কিন্তু পথ তো একটাই। সে পথ শিল্পের অগ্রগতির পথ। শিল্পের সাধনার পথ।
দীপাদির লেখায় বাংলার লোক আঙ্গিকের সনাতনী রূপের এমন বিশ্লেষণ আমি কোথাও পড়িনি।
এগিয়ে চলুক লেখা।