অমল আলো বর্ষপূর্তি নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় সন্ধ্যা

অমল আলো নিজস্ব প্রতিবেদন:

অশোকনগর নাট্যমুখের সমন্বয়ে দশটি ভিন্ন দলের সম্মিলিত আয়োজনে অমল আলো বর্ষপূর্তি নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় সন্ধ্যার সূচনা হয় একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। গত ২৩ নভেম্বর উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে থিয়েটারের কন্যাদের আমন্ত্রণ জানায় অশোকনগর নাট্যমুখ তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন প্রজেক্ট প্রমিথিউসের নির্দেশক ইন্দুদীপা সিনহা। তবে পেশায় চিকিৎসক ইন্দুদীপা তার কর্তব্য পালনের তাগিদে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে উৎসবের দ্বিতীয় দিনে তিনি উপস্থিত ছিলেন অমল আলোতে। এদিন অশোকনগর নাট্যমুখ তাকে সম্মাননা প্রদান করে। অশোকনগরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলার তথা পৌরসভার সি আই সি সদস্য মিলি চক্রবর্তী তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন এবং তাঁর হাতে তুলে দেন স্মারক ও বই। এছাড়াও এদিন উপস্থিত ছিলেন মূকাভিনয় পত্রিকার সম্পাদক এবং বাংলার মূকাভিনয় শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম রণেন চক্রবর্তী। নাট্যমুখের পক্ষ থেকে অশোকনগরের দীর্ঘদিনের থিয়েটারের মানুষ দীপক নাগ এবং আলোকশিল্পী সুব্রত সরকার তাঁকে উত্তরীয়, স্মারক ও বই তুলে দেন। এরপর নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি জানান অমল আলো সম্পর্কে তার অনুভূতি, পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতে অমল আলোয় কাজ করবার ইচ্ছের কথা। ইন্দুদীপা জানান অশোকনগর নাট্যমুখের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ও তার দল প্রজেক্ট প্রমিথিউসের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কের কথা। অশোকনগর নাট্যমুখের সম্মাননার প্রতি উপহার রূপে তিনি পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‛ভুল স্বর্গ’ কবিতাটি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অশোকনগর নাট্যমুখের নির্দেশক অভি চক্রবর্তী। এদিন অমল নাট্যোৎসবের দুটি প্রযোজনা ছিল বারাসাত জনস্বর প্রযোজিত নাটক ‛হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং স্টেজ দ্য ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ল্ড প্রযোজিত নাটক ‛রাক্ষস’।

হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড বারাসাত জনস্বরের এক তীব্র ঝাঁঝালো কন্ঠ –

মানুষের মস্তিষ্কে কত দুষ্টু বুদ্ধি । মানুষ মানুষকে নিয়ে খেলে, বোকা বানায়,ধর্মের নামে অস্ত্র তুলে দেয়, বশ করে নানান খেলা খেলে। বারাসাত জনস্বরের এই জনমুখী ঝাঁঝালো স্বর দিয়ে মনের দুয়ারে ধাক্কা আসলে সময়কে চিনতে শেখায়। মানুষের অধিকার, কন্ঠ, ধর্ম ছিনিয়ে রাষ্ট্রের এই ছিনি বিনি খেলার প্রতিবাদে নাটকের ভাষায় গর্জে ওঠার এক চরম দুঃসাহস দেখালেন তারা। এন আর সির নামে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা কেন্দ্রের এই জনবিরোধী মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করে হাসির ছলে ঘন প্রসহনের নাট্য ঘটিয়ে গেল আজ অমল আলো নাট্য উৎসবের দ্বিতীয় দিনে। দর্শকের মনে ভীষণ ভাবে হাসতে হাসতে নাড়া দিয়ে গেলেন সঙ্ঘমিত্রা, প্রজ্ঞা, অনুসূয়া, অর্পণ, অর্করাগ, সুদীপ্ত, সায়ন, রাজু পল্লবরা।

এককথায় বলা যেতে পারে বর্তমান ভারতবর্ষের উলঙ্গ ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি তীব্র চপেটাঘাত।

হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড একটি ডার্ক কমেডিও বটে। নাটকে দুই চরিত্র নরেন শাসমল ও অমিত রাহা নিজেদের বেকারত্ব দূর করতে একটি কোম্পানি খোলে, যার নাম হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড। যাদের প্রধান কাজ কোনো মানুষ বা পার্টিকে ভোটে জিতিয়ে ক্ষমতায় পাঠানো। বিভিন্ন ভাবে তারা নিজেরাই প্রশ্ন তোলে দেশ বলতে কে কি বোঝে। বর্তমানে গণতন্ত্র কি তাহলে প্রহসনে পরিণত হয়েছে? গান ও গিটারে ডেঙ্গু বেশ ভালো সংগত দিয়েছেন নাট্যে। তালবাদ্যে দেবোজিৎ। নাটক ও নির্দেশনা দিতে গিয়ে প্রলয় নিজের মতো করে যে কথা বলবার চেষ্টা করেছেন তা হলো –

হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড পেশাদার থিয়েটার হিসাবে ওদের দ্বিতীয় কাজ। লু সুন এর পাগলের ডায়েরি ২০১৮ তে কাজ করার পর আবার ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড করার ভাবনা মাথায় আসে প্রলয়ের। প্রকৃত অর্থে ‘ নির্দেশক আমি একেবারেই নই, থিয়েটারের একজন শিক্ষার্থী বলা যেতে পারে ‘। শিক্ষার্থী হিসাবে এবং চারপাশে ঘটে চলা অনেক ঘটনার, অনেক রি-অ্যাকশানের অ্যাকশন এই নাট্য। এ নাট্যের ভাষা অত্যন্ত সহজ, যা একটা বিরাট সংখ্যক দর্শকের কাছে সহজেই পৌঁছাতে সাহায্য করবে। বর্তমান ভারতবর্ষের নগ্ন ফ্যাসিবাদী শক্তিকে প্রকাশ্যে আঘাত করা,তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা, যেখানে বক্তব্যই প্রধান এবং মুখ্য, সেখানে নাট্যের চলনে ব্রেখট এর alienation জনস্বরের প্রধান অস্ত্র। রাষ্ট্র যখন তার দাঁত নখ বার করে, নাগরিকের চোখে চোখ রেখে তার শোষণ যন্ত্র কায়েম করতে মত্ত হয়ে যায়, তখন একজন থিয়েটার কর্মী হিসাবে প্রলয় তাঁর নাট্যে সরাসরি কথা বলেছেন বা আঘাত হানার প্রয়োজনীয়তা মনে করেছেন।

দ্বিতীয় নাটক রাক্ষস। মূল গল্পের ভাবনা মোহিত চট্টোপাধ্যায় হলেও তাতে অতিরিক্ত উপাদান অলংকার দিয়ে নাট্যের শরীরে এক গল্প বলতে চেয়েছেন নির্দেশক শুভঙ্কর মুখার্জি। যা একটি দল বিরোধী দলীয় প্রহসনই বটে। থিয়েটার গ্রুপের ভেতরে একটি দলের সাংগঠনিক পরিকাঠামো এবং মঞ্চে একটি নাটকের শো নিয়ে সব অভিনেতারদের মাথা নিচু করে এক বধির অদ্ভুত স্বরে রাক্ষসের খিদে পূরণ করা নিয়ে এক ঘন্টার দোলাচল চললো। কস্টিউমে এত যত্ন নিয়েছেন অথচ নির্দেশনা ও গল্প বুনটে প্রচন্ড দুর্বল এক গতি গিলে খেল নাটকের শরীরকে। আরো প্রস্তুতি নিতে হবে এই দলকে সব দিক থেকে। স্টেজ দ্য ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ল্ডকে দলগত ভাবে অনেক সময় দিয়ে তৈরি হতে হবে অভিনেতা সুমন, সাথী,পুষ্পিতা, রাজু, শুভঙ্কর অভিরূপদের, আরো মন দিতে হবে নাট্যে।