স্পষ্টভাষী নাট্যকার অমলেশ চক্রবর্তী, সবার অমলদা | অসীম দাস

স্মৃতি-বিস্মৃতির অতল-করতলে দাঁড়িয়ে গোটা ভারতবর্ষে চলছে অসুখপর্ব, ‘অদৃশ্য অসুখ’ পুঁজিবাদী শক্তির কাছে দেশকে ক্রমশ দেউলিয়া করে দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের তীব্র বিরোধী নাটক ‘অদৃশ্য অসুখ’ (প্রথম অভিনয় ২০.০৫.২০০৩) লিখেছিলেন নাট্যকার অমলেশ চক্রবর্তী। ভারতবর্ষ জ্বলছে। হানাহানি, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা। কি চায় সরকার, মনচিত্র নাকি মানচিত্র টুকরো? অমলদার এই নাটকে মনে আছে উনি নিজে বলেছিলেন খোদ দিল্লিতেও প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে অদৃশ্য অসুখ নাটকটা। সেদিন তাপস সেন রাজনৈতিক নাটক দেখে বলেছিলেন — এ তো ভয়ের নাটক, তোমাদের সাবধানে থাকতে হবে। সেদিন আলোক শিল্পীর কথা শুনে ভয় পায়নি অনীক। ভয়কে জয় করতে জানে রবীন্দ্রনাথের ‘অমল’। সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিবাদ করাই নাট্যকার অমলেশ চক্রবতীর সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বামপন্থী ঘরানার লাল আলোয় মোড়া থিয়েটারের লোকেরা চেনে অমলদা নামে । ট্রেড ইউনিয়ানের সঙ্গে যুক্ত কলেজ জীবন থেকে।

জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়। সেদিন টেবিলে প্রশ্ন শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন অমলদা, সখ করে নাটক করতে এসেছেন বুঝি? সখে নাটক করতে আসিনি। প্রত্যক্ষ রাজনীতি করা ছেলে আমি। প্রয়োজনে নাটকে এসেছি। আমার সাধ্যের নাগালের মধ্যে থিয়েটারের মাধ্যম ছাড়া আর কোন পথ জানা ছিল না। দূরদর্শন, চলচ্চিত্র মাধ্যম হয়ত বেশি লোকের কাছে পৌঁছুতে পারে কিন্তু সেখানে গোলক ধাঁধার জগৎ। প্রতিনিয়ত এক্সপ্লয়টেশন, ধান্দাবাজি। তাই থিয়েটার সেই মঞ্চ , সেখানে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাষা উচ্চারণ করতে পারি।

আজ এতগুলো বছর পরে মানুষটাকে ভীষণ মনে পরলো আমার। প্রয়াণের ছ’বছর পর তাঁর স্মরণে সেমিনারে উপচে পরে ভালোবাসার মানুষ। ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ, সাধারণ পোশাক – আসাকে নিজেকে মুড়ে রাখতেন সর্বদা । নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা ছিলই না বললে চলে। ইকো ব্যংকে চাকুরীজীবি ছিলেন, অনীক অন্তপ্রাণ, তাই বোধহয় ওঁনার মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও গঙ্গা- যমুনার জলপ্রপাতের শব্দ একই ভাবে বয়ে চলেছে। খুব সম্প্রতি তাঁর দল অনীক তিন দিনের উৎসব নিয়ে অমল আলোয় আসবে নভেম্বরে। শুধু অমলদা দেখে যেতে পারলেন না অমল আলো। করোনার মতো মহামারি দেখার অনেক আগেই চলে গেছেন।

অমল চক্রবর্তীর ছাত্র জীবন কাটে কোন্নগর নবগ্রাম বিদ্যাপীঠে , পরে সেন্ট পলস কলেজ। ইন্টার কলেজ কমপিটিশানে প্রথম লেখা নাটক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘তৃষ্ণার অন্ধকারে’ (১৯৬৪)। এরপর ‘কোন্ননগর মহাদেশ পরিষদে’ যোগদান। সেখানে ‘কালান্তর’ নামে ১৯৬৭ এ প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক লেখেন। ১৯৭৯ তে চেতনা নাট্যদলে অংশগ্রহণ। সেখানে মঞ্চের পেছনেই মুখ বুঁজে চলছে সব কাজ। ১৯৮২ তে চেতনা দল ত্যাগ করলেন। মুখ বুঁজে ঘরে বসে নেই তরুণ অমল, চাকরীর সাথে রাজনীতিও চলছে। কিছুদিন দক্ষিণেশ্বর ‘সমসংযোগ’ নাট্যসংস্থায় কাজ করার স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটায় পরে ২৮.১২.১৯৮৮ তে সৃজনে সমন্বয়ে দায়বদ্ধতায় ‘অনীক’ নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন অমল চক্রবর্তী ।

অমলদা নিজেই বলতেন যে, আমি একজন ভালো সংগঠক কারণ সুষ্ঠু সংঘটন না থাকলে নাটকটা করব কোথায়? মঞ্চের জমিটা তো আগে চাই? দলের প্রয়োজনেই কলম ধরা, সেই ধারাবাহিক নাটক লেখা শুরু, শুধু মাত্র দলের জন্য। হলদী নদীর তীরে, ক্রেমলীনের ঘড়ি ( প্র.অ. ১৬.১০.১৯৯০), একজন প্রতারক ( প্র.অ. ৯.১০.১৯৯২) নাটক লেখার জন্য ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অাকাদেমি সম্মান লাভ করেছেন অমলদা। এছাড়া পেয়েছেন লেবেডফ পুরস্কার (ইউ এস এস আর), নুরুন নাহার সামাদ নাট্য পদক ( বাংলাদেশ), দীপংকর সেনগুপ্ত স্মৃতি সম্মান (সায়ক), নান্দীকার পুরস্কার, হযবরল পুরস্কার, ড্রামা অাকাডেমি পুরস্কার সহ আরও অজস্র সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন ।

এরপর আরও অসংখ্য নাটক ‘লাল ঘাসে নীলঘোড়া’ (প্র.অ.২৩.১১ ১৯৯৪) প্রযোজনার জন্য এবার দল পায় নাট্য আকাদেমির মতো সরকারি সম্মান। নাটক পূর্ণ-অপূর্ণ (প্র.অ. ২২.০৮.১৯৯৯) বহু অভিনীত অনীক প্রযোজনা ছাড়াও বহু অভিনীত আরও নাটকগুলোর মধ্যে ‘অদৃশ্য অসুখ’ (প্র. অ. ২০.০৫.২০০৩) ‘সময়ের আবর্তে’, ‘জল্লাদ’, ‘প্রস্তরযুগ’ এমনই আরো অসংখ্য নাটক লিখেছেন। মোট ২২ টি পূর্ণাঙ্গ এবং ২ টি একাঙ্ক নাটক লিখেছেন, অমলেশ চক্রবর্তী নামে নাটক লিখতেন প্রথম থেকে। অন্য দলের জন্য লিখলেন পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘দাঁত পাকে বাধা’, চন্দন দাশের নির্দেশনায় নাট্যদল শৌভনিক মুক্তাঙ্গন মঞ্চে অভিনীত করে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

বরাবরই কমেডি নাটক লিখতে পছন্দ করতেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল একটা সম্পূর্ণ হাসির নাটক লিখবেন একদিন । অনীকের প্রযোজনায় বাংলা নাটকের ইতিহাসে বোধহয় রেকর্ড পরপর আটটি প্রযোজনায় নাট্যকার অমলেশ চক্রবর্তী, নির্দেশক মলয় বিশ্বাস, মঞ্চ অজয় দত্তগুপ্ত একসাথে জুটি গড়ে কাজ করেছেন। গ্রুপথিয়েটার পত্রিকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল অমলদার। ছোট নাটকে প্রতিযোগিতা মঞ্চে বিচারক হয়ে অনেকবারই বিচার করতে বসেছেন তিনি। পাশাপাশি বলতেন – ‘যদিও শিল্পের বিচার হয় না সেই অর্থে বলছি না তবু অভিনয়ের গুণগতমান কনটেন্ট, শিল্পতো মানুষ নিয়ে সমন্বয় সৃষ্টি করা। এতে খুব একটা উৎসাহিত নই, আমার তো মনে হয় কিছু দলকে পাইয়ে দেবার প্রতিযোগিতা কর্ম। শুধু মফস্বলে কেন নগরেও কম কোথায়, ধরাধরি সব জাগাতেই আছে শুধু কলকাতার মঞ্চে নাটক করে গেলে অনেক দলই উঠে যেত। বাঁচিয়ে রেখেছে কল-শো গুলো। যা শো হয় তার বেশির ভাগই কলকাতার বাইরে। শুধু এখানে সীমাবদ্ধ থেকে লাভ নেই থিয়েটারকে নিয়ে যেতে হবে মফস্বলে, অনেক মানুষের মধ্যে। মুখাপেক্ষা হয়ে থাকার মধ্যে নেই অনীক। অনীকের আয়োজনে ‘গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসব’ চলছে চলবে এবছর পঁচিশ বছর পা দেবে । বিবেকানন্দ যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনে দীর্ঘ ১৫ বছর অনীক অস্থায়ী মঞ্চে আন্তঃ বিদ্যালয় প্রতিযোগিতা চলেছে। বর্তমানে তপন থিয়েটার মঞ্চ অনীক সম্পূর্ণটা নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রেখেছে।

অনেকদল এখন অপেক্ষায় থাকে এই উৎসবে আসার জন্য। অমলদা সবাইকে যোগ্য সম্মান দিয়ে সবাইকে ডাকতেন। অশোকনগর নাট্যমুখও ডাক পেয়েছিল গত বছর। অমলদা ছিলেন না শুধু। দেখাতে পারিনি তাঁকে আমার দলের অভিনয়, এটা সারাজীবনের আমার আফসোস থেকে গেল। সেই সময় তিনি আফসোস করেছিলেন আমি সবাইকে ডেকে অভিনয় করিয়েছি কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে কিন্তু কেউ অনীককে ডাকেনি। প্রথমে এই আক্ষেপ ভেতরে দংশন করলেও পরে মফস্বল বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে ডাক পেয়েছে অনীক। ডাক পেয়েছে বাংলাদেশ থেকেও। মফস্বলের দল এমন কি বাংলাদেশ থেকেও এসেছে এই উৎসবে নাটক করতে। এখনও আসে তবে আগের মতো দলের অভিনেতারাই শুধু অভিনয় করেন না এখন দেখা যায় ফ্রিল্যান্সার অভিনেতাদের ভিড়, যাঁরা সংগঠনের নয় অর্থের বিনিময়ে অভিনয় করছেন । যদিও সকলে ব্যস্ত, এই ব্যস্ততার মাঝে সংগঠনের হাল ধরে রেখেছেন শক্ত হাতে পরবর্তী জেনারেশন । সরকারি গ্র্যান্টে অমলদার বরাবরই আপত্তি ছিল তবু সরকারের মুখাপেক্ষা হয়ে সকলের মতো অনীকও সাহায্য পায়। অমলদার মৃত্যুর পর প্রযোজনার বিষয়ে এসেছে পরিবর্তন। ততদিনে বাংলায় এসেছে নতুন সরকার। তাঁদের দলের প্রযোজনায় সেই কমিটমেন্টের আভাস কোথায় আজকাল!

বরাবর আফসোস করে গেছেন যে থিয়েটারকেও মিডিয়া গ্রাস করে নিচ্ছে । ধারাকে বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্য, গ্রুপ গুলোকে তুলে দেবার উদ্দেশ্য এঁদের। চারিদিকেই সম্মিলিত প্রয়াসে প্রযোজনা শুরু হয়েছে। এতে নতুন অভিনেতা তৈরী হচ্ছে কোথায়? মহাভারত, ভাইরাস M, সাজাহান লোকে নিচ্ছে কই! ব্রাত্য বসুর নাটক ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ শো-তে উপচে পড়া ভিড়ের কথা শুনেছেন, কিন্তু কোনোদিন দেখিননি। শুনেছেন অনেকেই নাকি মাঝরাতে উঠে কাঁদছেন। ২৫ বছর ধরে কি একটা জিনিস, একজায়গায় থাকে কখনও। বদলাবেই তো। রাজনৈতিক নাটক লিখতে গেলে অন্তত রাজনীতিটা জানা দরকার। গিমিক লিখলেই হয়না, ভাবনার দৃশ্যে এলে লোকে হো-হো করে হাসছে। অদ্ভুত! নাটক মানুষের কথা বলে তাই সময়ের কথা ভাবতে হবে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আর মতাদর্শ থেকে বিশ্বাস করতেন নিজের দেশটাই যদি না বাঁচে তাহলে পশ্চিমবঙ্গ বাঁচবে কি উপায়ে! তেমন পরিস্থিতি এলে আমি নিজেই বিরোধিতা করব! নাটকে বলব, সময় আসুক আগে। অনীক গড়ার স্বপ্নে দলের সকলের সহযোগিতা আন্তরিকতায় এগিয়ে চলতে কোনোদিন সমস্যায় পড়তে হয়নি দলকে। পিছু ফিরে তাকানো নেই, মন কষাকষি নেই। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের মতো মারণ অসুখে ভুগেছেন, অবশেষে চিরবিদায়, ঘুমের দেশে চলে গেলেন ২০১৬ সালে ৮ ডিসেম্বর ।

আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অমলদা নেই, দল কি তবে বন্ধ হয়ে হেছে? উৎসবের বাতি কি নিভে গ্যাছে? যায়নি। গঙ্গা – যমুনা নাট্য উৎসব বন্ধ হয়ে যাবে এমন ভাবনাও নেই। অমলেশ চক্রবর্তী নামে চলছে স্মারক সম্মান প্রদান এবং স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠান। এ বছর ষষ্ঠ বর্ষে বাংলা আকাডেমি সভাঘরে এই অনুষ্ঠান হয়েছে ৪ সেপ্টেম্বর। এই সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন অসংখ্য গুণী মানুষ। প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনীক বিস্তার করছে তার সমৃদ্ধির শেকড়। জেলায় জেলায় পৌঁছে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে আন্তঃ বিদ্যালয় সারা বাংলা ছোট নাটক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা এবার ১৮ বছরে পদার্পণ করলো । দলের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করোনা মহামারিতে অসহায়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অনীকের বন্ধুরা। অমলদার স্বপ্নের অনীক এখন সামলাচ্ছেন তপতী ভট্টাচার্য, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, অংশুমান দাশগুপ্ত, অরূপ রায় সহ প্রমুখরা। সারা বছর ধরে নাটকের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেদের সৃজনশীল কাজে জড়িয়ে রেখেছেন তাঁরা।

আজীবন বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী অমলদা রেখে গেছেন সব স্বপ্নময় প্রযোজনার ডালি। তাঁর শেষ নাটক লেখা অনীকের প্রযোজনাগুলির শকুন্তলা,পুনরুজ্জীবন ( নাটক দুটি অমলদার নির্দেশনায় নির্মিত) অ্যাডভেঞ্চার কারে কয়, চিকিসসা, একুশের গল্প, সম্পর্ক, লাল ঘাসে নীল ঘোড়া, প্রতীক আজও থিয়েটার প্রেমী বন্ধুদের কাছে চির অজেয় হয়ে থাকবে। দল গড়ে তোলার পর আর তাঁকে কেউ অভিনয় করতে দেখেন নি অথচ অসংখ্য অভিনেতা তৈরি করে গেছেন সারাজীবন ধরে।  অমলরা দুঃখে ভেঙে পড়েনি কখনও, দুঃখ তাঁকে গ্রাস করে না বরং দুঃখকে গ্রাস করেন তিনি। অমলদা একটা ইচ্ছের কথা সেসময় ব্যক্ত করেছিলেন – “ইচ্ছে ছিল এখন একটাই দুর্যোধন কে নিয়ে নাটক লেখা। এই চরিত্রটি সকলের বঞ্চনার শিকার।” জানি তাই, স্বপ্ন পূরণ চাইলে অপেক্ষা করতে হয়। উপর থেকে অপেক্ষার হাত ধরে অনীক এগিয়ে চলেছে এখন নগর ছেড়ে প্রান্তে অমল আলোয়। শুধুই এগিয়ে চলা। পিছু ফেরা নেই।

One thought on “স্পষ্টভাষী নাট্যকার অমলেশ চক্রবর্তী, সবার অমলদা | অসীম দাস

  1. অমল আলো জার্নাল এগিয়ে চলুক।
    রানারের মত পৌঁছে দিক থিয়েটারের
    সেই সব যোদ্ধাদের চিরকুট আমাদের
    কাছে।

Comments are closed.