সুদীপ সিনহা
রচনার শিরোনামটুকু লিখে নিজেই খানিক থমকে রইলাম। আমি নাটক নির্মাণ করি নাকি নাটক আমাকে নির্মাণ করে তা নিয়ে দ্বন্দ্বে আছি রীতিমতো। যেকোনও সৃজনই গড়ে ওঠে গভীর জীবন বোধ থেকে। নাটকই বা তার বাইরে হবে কেন? বিশেষ করে আমার মতো মানুষদের ক্ষেত্রে যারা জীবনের অনেকটা সময় পার করে নাটকের ঘাটে খেয়া ভিড়িয়েছে। আমি কাজ করতে করতে শিখি, শিখতে শিখতে কাজ করি।
লেখালেখি ছিল আমার প্রথম পছন্দ। বিশুদ্ধ গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর সরকারি চাকরিতে তাঁত বুনে খাচ্ছিলাম দিব্যি। বই পড়া, ভ্রমণ, গান শোনা এবং ফটোগ্রাফির প্রতি গভীর আসক্তি থাকায় যোগ দিলাম যারা পরিযায়ী’ নামে একটি জনপ্রিয় ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদকীয় মণ্ডলীতে। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার ‘সাদা-কালো’ বিভাগে প্রথম পুরস্কার জুটে গেল হঠাৎ। ২০১২ সালে ‘চাঁদের দেশে, চাঁদের পাহাড়ে’ শিরোনামের বইটিতে লাদাখের মঠগুলির উপর দুটি গবেষণাধর্মী নিবন্ধ প্রকাশিত হল। আর ২০১৪ সালে সরকারি উদ্যোগে প্রকাশ পেল ‘পুরুলিয়ার গল্প-সল্প’ নামে প্রথম মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ। লেখালেখির নেশাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল জীবনের প্রথম নাটক ‘অমূল্যর ডায়ারি’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। নবাগত দল চন্দননগর ব্রাত্যজনের প্রথম প্রযোজনা ছিল সেটি। নবীন পরিচালকের অনুরোধ ছিল। নাটক নির্মাণের সময় পাশে থাকতে হবে আগাগোড়া। সেই অনুরোধে সায় না দিলে নাট্যজগতে আমার আসা হত না। তারপর কাজ করেছি ‘দমদম ব্রাত্যজন’, ‘নৈহাটি ব্রাত্যজন’ এবং ‘ব্যারাকপুর ব্রাত্যজন’-এর মতো দলের সঙ্গে। একটু একটু করে থিয়েটার আমার জীবনের গভীরে প্রবিষ্ট হল।
২০১৯ সালের শেষদিকে ‘দ্বিধা’ নাট্যে আমার নির্দেশনায় হাতেখড়ি। তারপর আচমকা লক ডাউন। হতাশার মেঘ ক্রমশ গ্রাস করছে থিয়েটারের সকল কলাকুশলীদের। আর্থিক এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা করা গেল এরকম বেশ কিছু কলাকুশলীদের নিয়ে তৈরি করা হবে ১২টি ডিজিটাল নাট্য। অর্থাৎ থিয়েটারের সেট, লাইট, মেকআপ সবকিছু নিয়েই ইউটিউবের জন্য শুট করা হবে এই নাট্যগুলি (মনে রাখতে হবে তখন থিয়েটার হলগুলি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ)। পাশে এসে দাঁড়ালেন বন্ধু পৃথ্বীশ রাণা। ওরই স্টুডিওতে ‘A বারো সঙ-আলাপ’ শিরোনামে (নামটা পৃথ্বীশেরই দেওয়া) তৈরি হল বারোটি নাট্য। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটির নাম দেওয়া হল ‘থিয়েটার জোন’। দ্বিতীয় দফার লক ডাউনে
তিনটি শ্রুতিনাট্যও নির্মাণ করেছে থিয়েটার জোন। ১৪ এপ্রিল, ২০২১-এ মঞ্চস্থ হল থিয়েটার জোনের প্রথম প্রসেনিয়াম প্রযোজনা ‘বিনয়ের জীবন’। আমারই নাট্যরূপ ও নির্দেশনায়। একে একে তৈরি হল চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নাট্য ২য় পক্ষ’, ‘ঘাসফুলের কবি’, ‘কড়ি ও কোমল’ এবং ‘সুখ’। নির্মিত হচ্ছে আরও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নাট্য ‘সংসার’। ইতিমধ্যে ‘বারাসাত রমেশপল্লী থিয়েটার গ্রুপ’ নামে নিবন্ধীকৃত হয়েছে আমার দল।
নাট্য নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা দুটি সুস্পষ্ট পছন্দ আছে। এক, সাহিত্যনির্ভর নাট্য এবং দুই, বাচিক অভিনয়। অর্থাৎ নাট্যনির্মাণের বিষয়ে আমাকে খানিক প্রাচীনপন্থীও বলা চলে। শুরু করেছিলাম আবদুল হাসনাত হাইয়ের গল্প দিয়ে। তারপর কাজ করেছি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, বিমল কর এবং কৃষাণ চন্দরের রচনা নিয়ে। আমার কাজের একটা ধারা আমি সচেতনভাবেই তৈরি করেছি। প্রতিটি নাট্যের ক্ষেত্রেই আমি গোটা দলকে নিয়ে আমি একটি আবাসিক শিবির করে থাকি। এতে সুবিধে হল চট করে দলটা একটা পরিবার হয়ে যায়। কিন্তু সামলাতে হয় বিপুল খরচের ধাক্কা। বারোটি ডিজিটাল নাট্য এবং তিনটি শ্রুতিনাট্যকে হিসাবে ধরলে মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই আমার দল নির্মাণ করেছে মোট ২১টি প্রযোজনা, আগামী মাসেই মঞ্চস্থ হবে আরও ১টি প্রযোজনা। মনে রাখতে হবে দলের কোনও সরকারি বা বেসরকারি অনুদান নেই। সরকারি মাসমাইনেয় এতখানি আর্থিক দায়ভার মেটানো যায় না। ফলে মাথার উপর ক্রমাগত ভারি হচ্ছে ঋণের বোঝা।
বাস্তবিকই থিয়েটার আমার আর্থিক পুঁজিকে তলানিতে নিয়ে গেছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা, মানুষ চেনার ক্ষমতা এসবের পুঁজি বেড়েছে বৈকি। আগে যখন ছবি তুলতাম তখন দাদারা পিঠে হাত দিয়ে গাইড করতেন রীতিমতো। প্রদর্শনীর জন্য ছবি বেছে দিয়েছেন পর্যন্ত। থিয়েটারে এসে এই পিঠে হাত রাখাটা মিস করছিলাম। অতি সম্প্রতি সেই হাতটা পিঠে রাখলেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি। এবছর স্বল্পদৈর্ঘ্যের বিশিষ্ট প্রযোজনা হিসাবে মনোনীত হয়েছে ‘ঘাসফুলের কবি’। কোনও সেট ছাড়াই নির্মিত হয়েছিল এই নাট্যটি। আলোর পরিকল্পনা সেভাবে করা যায়নি, আবহ নির্মাণের সঙ্গে আবহ প্রক্ষেপণের দায়িত্বও আমাকেই নিতে হয়েছিল। কারণ অর্থের নিদারুণ অভাব। সেই নাট্য যখন পুরস্কার পায় তখন বড়ো তৃপ্তি হয় বৈকি।
মনে হয়, থেকে যাই আরও কয়েকটা দিন থিয়েটারে।
কারণ আমার নির্মাণপর্ব এখনও সম্পূর্ণ হয়নি থিয়েটারে।
❤️
বাহ। ভাল লাগলো। এই নাট্যের গল্পকার কবির সঙ্গে আলাপের রোমহর্ষক কাহিনীটা উল্লেখ কোরো।
দারুন লেখা 😃
দারুন ❤
দারুন ❤️
Osadharon
দারুণ লেখা
Sotti e darun ❤️