অশোকনগর পত্তন থেকে আজকের সংস্কৃতি চর্চা | ধারাবাহিক – ৫

অসীম দাস 

কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লক (সংক্ষেপে ব্লক) ভারতের গ্রামস্তরের স্থানীয় প্রশাসনিক বিভাগ। ব্লকের শাসনভার ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের (বিডিও) হাতে ন্যস্ত থাকে।
১৯৫৭ সালে সর্বপ্রথম পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত আইন বিধিবদ্ধ হয়। ১৯৫৭ ও ১৯৬৩ সালের আইন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে চালু হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী অনুসারে পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আইনটিকেও পুনরায় সংশোধিত করা হয়।
শুরু হয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ । যা পরে ত্রি- স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়নে জোয়ার আনবে পরবর্তী সরকার। সারা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলা জুড়ে শুরু হবে ব্লক ডেভেলপমেন্টের কাজ।

আসলে এ পর্বে চর্চার প্রসঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছি গ্রামকে। অশোকনগর বিধানসভা গঠনে অশোকনগর কল্যাণগড় পৌর অঞ্চল ছাড়াও আটটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মত রাজীবপুর – বিড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে । অশোকনগর পত্তন হওয়ার আগে থেকেই গ্রামের চাষিরা বিক্রির জন্য ফসল বেঝাই করে গরুর গাড়ি কিংবা পায়ে হেঁটে মাথায় করে হাবরা বা এই উপনগরের নাম না হওয়া বাজারগুলোতে বেচতে আসতো। এখনও সেই ধারা চলছে। তবে রাস্তা ঘাট, গাড়ি চলাচলের সুবিধে হওয়াতে গ্রাম আর পিছিয়ে নেই। বিদ্যুতের আলো এসে পৌঁছেছে হয়তো অনেক পরে। লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা করে, মাইলের পর মাইল হেঁটে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে গ্রামের মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। শহরের পথে একশ্রেণির মানুষ বরাবর নিন্দামন্দ করে গেছে। শহরের এলিট শ্রেণি গ্রামকে হেও করেছে। গেও বলে ঘৃণা করে আজও। যদিও সবাই তা নয়, অনেকেই গ্রামকে ভালো বাসেন।

হাবরা ২ নম্বর ব্লকের অনেক পিছিয়ে পরা গ্রামগুলি সরকারি সহযোগিতায় আজ অনেক উন্নত হয়েছে। আলো রাস্তা, গঙ্গা নদী পাইপ লাইনের দ্বারা জলের পর্যাপ্ত জোগান থেকে রাতের রাস্তায় অন্ধকারকে হারিয়ে গ্রাম এখন ঝাঁ – চকচকে রূপ নিয়েছে। এতে শহরের অবশ্য অবদান আছে। উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, ভ্রমণ উদ্যান, আজকের শপিং মল সবই গড়ে উঠেছে শহরকে কেন্দ্র করে। তবে গ্রামের মানুষ যত বেশি কর্মসস্থানের জন্য বা নানান প্রয়োজনীয় কাজে শহরে আসেন শহরের মানুষ কিন্তু সেই তুলনায় খুবই কম যোগাযোগ রাখেন গ্রামের সঙ্গে।

প্রসঙ্গত এই পর্বের আলোচ্য জনপদ শতাব্দী প্রাচীন রাজীবপুর গ্রামটি সেই তুলনায় বহু পুরাতন। এখানে জমিদার বাড়ি, হাট, বাজার, উচ্চবিদ্যালয়, হস্টেল, শ্মশান, হিন্দু কবরস্থান, সরকারি হাসপাতাল, ব্যাংক রয়েছে। যে ইতিহাস হয়তো অনেকেরই অজানা। রাজীবপুর হাটখোলা ( গ্রামীণ ভাষায় সাপ্তাহিক দুইদিন পাশাপাশি গ্রামের মানুষরা জিনিসপত্র এনে বেচে এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কেনে ) ছাড়ালেই বিড়া স্টেশন থেকে পনেরো মিনিটের পথ এলে বাঁদিকে জমিদার বাড়ি পড়ে। ভগ্নসৌধ হয়ে বিশাল বাড়ি, ঠাকুরদালান, নাটমন্দির, আমোদপ্রমোদের জন্য বিরাট বসার ঘর, সুরঙ্গপথ। এই সুরঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল ডাকাতের ভয়ে বাড়ির সকলে লুকিয়ে বাঁচার জন্য। বড় বড় জানলা, ভাঙ্গা চোড়া দেয়াল ধসে যাওয়া ছাদ থেকে আকাশ দেখার মধ্যে ফাঁকা হয়ে আসা মনের গভীরে গম্বুজগুলো হাপিত্যেশ করে দিনরাত। প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন হিসেবে প্রজন্ম ধরে বহমান এই ‘চন্দ্রভবন’।রাজীবপুর হাটের লাগোয়া জমিতে হাইস্কুল, শ্মশান, হস্টেল, মেয়েদের জন্য স্কুল — সবই জমিদার বংশোধরদের নির্মিত অংশবিশেষ। একটা জিনিস পরিষ্কার এই অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে জমিদার বাড়ির সন্তান যিনি ইংরেজকে খুশি করে রায়বাহাদুর উপাধি লাভ করেছিলেন সেই রায়বাহাদুর কান্তিকুমার ঘোষ ( জন্ম.১৮৯৩ — মৃত্যু. ১৯৮৮) মহাশয়ের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলায় বর্গীদের প্রবেশ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুটপাট চালাত বর্গীরা। লুটতরাজপ্রিয়রা ঘোড়ায় করে আসা মারাঠা সৈন্যদলের নামই হলো বর্গী। বাংলা জুড়ে বর্গীদের এই কেড়ে নেওয়ার কপটতা একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।

১৮৪০ সালে জমিদার মধুসূদন ঘোষ মহাশয়ের ধান পাটের ব্যাবসায় ভালো মুনাফা হওয়াতে পুকুর কেটে মাটি তুলে সেই মাটি থেকে ইট তৈরি করে চুন সুরকি আর শালকাঠ দিয়ে দোতলা এই বিশাল রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়ির নামকরণ করেন ‘চন্দ্রভবন’ । কাঁচরাপাড়া থেকে ছন্দ হারিয়ে সুখাবতী নদী বা সুঁটি কেউ বলে সুবর্ণমতি নদী নাম নিয়ে এই রাজীবপুর ন’পাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে এসে শ্মশান কালি মায়ের মন্দিরের পাড়ে এসে মিশেছে বলে জানা গেছে । আসলে
সুবর্ণমতি বা সুখাবতী বা সুঁটি এগুলো একটাই নদীর বিভিন্ন নাম। বর্তমান অশোকনগরের বুকে প্রথম নদী,দ্বিতীয়টি বিদ্যাধরী নদী।

প্রায় মজে যাওয়া গ্রামের আদিবাসী মানুষদের ধারণা বিদ্যারদেবী সরস্বতীর বরেই সুবর্ণমতি নদীর জন্ম। বালি থেকে বর্গী হামলার পর প্রাণে বাঁচতে এই নদীর পারেই ধীরে ধীরে চলে আসেন মধুসূদন ঘোষের বাবা ধনী ব্যবসায়ী চন্দ্রকান্ত ঘোষ সহ পরিবারের লোকেরা। ঘোষেদের বিরাট পরিবার এখানে হয়ে উঠলেন ‘বালীর ঘোষ’ থেকে ‘কুলীন কায়স্থ ঘোষ’। জমিদারদের তৈরি পেল্লাই গেট যা আজ আর চোখে পড়েনা। দীর্ঘদিনের শোকার্ত বড় বড় গম্বুজের গায়ে কোথাও শান্তিবাস কোথাও চন্দ্রভবনের ফলক চোখে পড়ে।

এলাকার মানুষের মানবিক অধিকারের কথা ভেবে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা নিয়ে জমিদার মধুসূদন ঘোষ তৈরি করলেন অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল। স্বাধীনতার পর সংস্কার করে স্কুলটির নামকরণ করা হয়েছে রাজীবপুর এ.ভি. হাইস্কুল। এমন হাইস্কুল তখন কোথায়? এখানে বহু দূরদূর থেকে ছাত্ররা পড়তে আসতো, যাতায়াতের একটা বড় সমস্যার জন্য জমিদার বাড়ির আরেক সন্তান সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ ১৯২৪ সালে তাঁদেরই নিজস্ব জমিতে তাঁর পিতার নামে উৎসর্গ করে কালিভূষণ ঘোষ হিন্দু ছাত্রাবাস তৈরি করেন। আজও সেই হস্টেলে ছাত্রদের পঠনপাঠনের সুযোগসুবিধা আছে। এই ছাত্রাবাসের সামনে কালিভূষণ ঘোষের আবক্ষ মূর্তি আজও বসানো আছে। নারীর উচ্চশিক্ষার কথা মাথায় রেখে স্বাধীনতার পড়ে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে মেয়েদের জন্য রাজীবপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন জমিদারবাড়ির অর্থ সাহায্য থেকে। সুঁটি নদীর পাড়েই ১৯৬৩ সালে স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন মন্মথ রায় নামক এক ব্যাধ। নদীর পাড়েই মৃতদেহ সৎকারের জন্য মহাশ্মশান গড়ে তোলা হয়।

অশোকনগরের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরত্বে থাকা হাবরা – নৈহাটি জিরাট রোডে ঈশ্বরীগাছা মোড় (এখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাই এসেছিলেন তাই এই নামকরণ ) থেকে হাঁটা পথে মাত্র দেড় কিলোমিটার রাস্তা। হাটখোলার আগেই ডানদিকে একটা দীর্ঘ রাস্তা চলে গেছে। জমিদারিপ্রথা চলেছে তিন পুরুষ ধরে। ১৯৮৬ সালে রায়বাহাদুর কান্তিকুমার ঘোষের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের মানুষজন এখন টাকিতে বসবাস করেন। এই জমিদার বাড়ির শেষ জমিদার হিসেবে ফলকে নাম পাওয়া যায় সুধারাণী ঘোষের ( জ.১৯০২ — মৃ.১৯৮৪) তবে এঁনার পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি।
পুরনো জমিদার বাড়ির পাশেই তৈরি হয়েছে বর্তমানে একটি রাজপ্রাসাদসম অট্টালিকা। কিন্তু কেউ বসবাস করেন না। জমিদারবাড়ির একটু দূরে রাজীবপুর থেকে গুমা যাবার পথে বাদুরতলা একটি বিখ্যাত জায়গা আছে । প্রায় ছশো বছরের বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে আজও পিচের রাস্তার পাশে। হাজার হাজার বাদুর ঝুলে আছে তাতে। বছরে একবার চড়কের সময় এখানে মেলা বসে।

আজকের রাজীবপুরের গ্রামীণ পরিবেশ, প্রকৃতি, রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থা, শিক্ষার বিস্তার, অধিকাংশ মানুষ চাষবাস ছেড়ে চাকরিতে মনোনিবেশ এসব এই জনপদের অধিকাংশটাই সেইসময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ও জমিদারি সু- ব্যবস্থার মূল্যায়ন। চব্বিশঘণ্টা বৈদ্যুতিন পরিষেবা, পঞ্চায়েতের একশো দিনের কাজে এলাকার সাফাই ও পরিচ্ছন্নতার রূপরেখা এখন সবটাই দেখাশোনা করে গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তর। তবে হ্যারিটেজ জমিদার বাড়িটির সংরক্ষণের ব্যাপারে জীবিত ঘোষ বংশধরদের তেমন হেলদোল চোখে পড়ে না। তাঁরা সবাই কলকাতায় চলে গেছেন। সম্প্রতি ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস তৎপর হয়ে নিজ দায়িত্বে রাজীবপুরকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আলোকিত করার সুপারিশ রাজ্য সরকারের কাছে করেছেন।

One thought on “অশোকনগর পত্তন থেকে আজকের সংস্কৃতি চর্চা | ধারাবাহিক – ৫

  1. নিষ্ঠ গবেষণায় দলিল হয়ে উঠছে ক্রমশ এই লেখা। লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভূমিপুত্র হয়ে যেভাবে তিনি ভূমি সংলগ্ন ইতিহাসকে তুলে আনছেন তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

Comments are closed.