১৯৪৭ এ ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে । এক বছরের মাথায় ২৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। ওপার বাংলার মানুষ না হয়েও দেশভাগের যন্ত্রণা, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ বিনিময়, এ এক ভয়ংকর অভিশাপে বাঙালির কোমরকে সেদিনই ভেঙে দিয়ে ছিল ইংরেজ। কিছু মিরজাফর মানুষের হয়তো এতে সমর্থন ছিল! তলায় তলায় জাতিবিভেদ এবং পরবর্তীতে লুঠ সন্ত্রাসের কবলে নিশ্চিহ্ন মানুষদের অর্থাৎ ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু দুঃস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করে তোলা সরকারের প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করেন। সেই কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, কাপড়ের মিল এবং আরো সব হাতের কাজে সাবলম্বী করে তুলতে সেই সব মহিলাদের প্রশিক্ষণ এবং অর্থ উপার্জনের জন্য হরিপুর অঞ্চলের কাছাকাছি প্রোডাকশন লেবার সেন্টার খোলার জন্য (পি এল ক্যাম্পের কাছাকাছি ) জায়গা পরিদর্শন, কথাবার্তা, মাপজোক শুরু হলো। এই সময় বিধান রায় চলে গেলেন সুইজারল্যান্ড। সেখানে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন ইগুলু টাইপের কিছু অ্যালুমিনিয়ামের ঘর। ঘরগুলো ডাঃ রায়ের মনে ধরে যায়। দেশে ফিরে এসেই বাস্তুকারদের সাথে কথা বলে সুইজারল্যান্ডের ঘরের আদলে অশোকনগরে তৈরি করে ফেলেন অ্যালুমিনিয়ামের গোল ঘর। এর মধ্যে একটিতে গড়ে ওঠে প্রোডাকশন সেন্টার।
এই ধরনের বিশেষ অ্যালুমিনিয়াম গোল ঘর ভারতবর্ষে প্রথম নির্মাণ করা হয়। এরপরে বিধান চন্দ্র রায়ের স্বপ্নের নগরী কল্যানীতেও এই ঘর তৈরি করেছিলেন। গোলঘর নামেই জানি, কিন্তু শুনেছিলাম ইংরেজ আমলে যখন অশোকনগর বাইগাছি একটা অস্থায়ী এয়ারপোর্ট ছিল এই ঘর গুলো তখন সিগন্যাল রুম ছিল। সেই সময় বাড়ি তৈরিতে কোনো লোহার ব্যবহার হতো না, ইট সুরকি সিমেন্ট দিয়েই ইটের পিলারের উপর স্লাব নির্মাণ করতো। ছোটবেলায় দাদু ঠাকুমারা বলতেন এখানে অর্থাৎ গোলঘরের পাশের মাঠে নাকি সন্ধ্যা হলেই ডাকাডাকি করতো ভুখা শিয়ালের দল। গ্রামের বাড়ির গোয়াল ঘরে, হাঁস মুরগি ধরতে হানা দিত। ধাওয়া দিয়ে শিকার করে নিয়ে আবার ঘন জঙ্গলে ঢুকে যেত বলে দুষ্টুমি করলে বাচ্চাদের ভয় দেখানো হত , কথা না শুনলে বলা হত শিয়াল এসে ধরে নিয়ে যাবে ! বাচ্চারা তাই বিশ্বাস করত।
পূর্ববর্তী আর এ এফ বাইগাছির কন্ট্রোল টাওয়ার তৈরি হয় ১৯৪৪ সালে। ভবনটির আকৃতি ষড়ভুজাকার তাই এর নাম গোলঘর। বাইগাছি এয়ারফিল্ডের সময় থেকে এই বিশেষ বিল্ডিংটি বিমান চলাচল নিরীক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো এবং শত্রু অনুপ্রবেশকারীদের উপর নজর রাখতেও ব্যবহৃত হতো। এখান থেকে তিনশো মিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি জীর্ণ প্রাচীর দেখা যায় যেটি ছিল ফায়ারিং রেঞ্জ। উল্লেখ্য পি এল ক্যাম্প ও প্রোডাকশন সেন্টার কিন্তু আলাদা। ভৈরবতলার কাছে হলো পি এল ক্যাম্প। তার ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা।
অশোকনগর পি এল ক্যাম্পের অদূরে শরৎ কলোনী নিকটবর্তী এই ভগ্নদশাগ্রস্থ এই স্থাপত্যটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের লাইট হাউস ছিল। বর্তমানে এই স্থাপত্যটির স্থানীয়দের মুখে মুখে ফেরে ‘ফাঁসি ঘর’ বা ‘গোল ঘর’ নামে। লোক-মুখে শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই স্থানে কর্মরত এক কর্মী এখানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, যার কারণেই এই স্থাপত্যটির নাম হয়ে যায় ‘ফাঁসী ঘর’। আবার এও জানা গেছে ইংরেজরা অবাধ্য নীলচাষীদের গুম করে দিয়ে ফাঁসি দিয়ে দিত। চারিদিকে কোনো জনবসতি ছিল না। বহুদূরে দু’একটা টালির চালার ঘর। ইংরেজ দেশ ছাড়ার পরও দিনের বেলায় সেখানে জনমানস যেতে সাহস করত না। যদিও এই ধারণা নিয়ে অনেক মতাদর্শই প্রচলিত রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। যদিও এই স্থাপত্যটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, বর্তমানে পিকনিক স্পট। স্থানটিকে ভুতুড়ে ঘর বললেও মন্দ হয় না।
১৯৫৪ সালে ১৩ নভেম্বরে প্রথম এই অঞ্চলে এই গোলঘরে বসবাস শুরু হয়। হুগলীর উত্তরপাড়ার ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে ২০০ উদ্বাস্তু পরিবারকে ১০০টি ঘরে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। প্রোডাকশন সেন্টারে ট্রেনিং করে কাজও পান তাঁরা। এখানে তাঁত সহ বিভিন্ন ট্রেডের উৎপাদন করা হতো। প্রোডাকশন সেন্টারে কর্মরত পরিবারদের পরে ৬নং স্কিমে, শরৎপল্লীতেও পুনর্বাসন দেওয়া হয়। পরে যদিও এই প্রোডাকশন সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই ঘরগুলোতে ঐ পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন। যাঁরা আজ এই শহরের বর্তমান নাগরিক। স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে আজও এই অশোকনগর শহরে গোলঘর দেখা যাবে। অনেকে ভেঙে গুড়িয়ে সু- বসতযোগ্য গৃহ নির্মাণ করে নিয়েছেন। গরমের সময়ে এই বাড়ি গুলিতে প্রচন্ড গরম হলেও ঝড় বৃষ্টিতে কোনো ক্ষতিই হতো না। বিজ্ঞান সম্মত এই গোলঘর এখন শুধুই আমাদের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কেউ কেউ দেখতে আসেন শহরে। গোলঘর এখন স্মৃতির ছবি হয়ে দেয়ালে স্থান পেয়েছে।