অষ্টক পালাগান – দীপা ব্রহ্ম

বিজনদাকে আমি অনেকদিন আগে থেকেই চিনি। চাঁদপাড়ায় থাকেন। একটি অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। মানুষটার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আছে। উনি মূলত একজন অষ্টক শিল্পী । ‘অষ্টক’ বাংলার একটি অন্যতম লোকনাটক। অবিভক্ত বাংলার একটি লোকজ উপাদান। চৈত্রসংক্রান্তির সময় শিব-দুর্গাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশের ফরিদপুর, পাবনা, বরিশাল জেলায় অষ্টক প্রচলন ছিল। পরে এ বাংলায় মূলত নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগণা অঞ্চলে এই অনুষ্ঠান আজও হয়। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগণা অঞ্চলের অষ্টক পালার মধ্যে কিছু ফারাক আছে। উত্তর ২৪ পরগণার অষ্টক পালায় স্বরলিপি ও ব্রতচারী ধরে করা হয়। কিন্তু নদিয়ার এক লাইন অষ্টক গান গাওয়ার পর নানা রকম সুর বাজায়। কোন বাঁধাধরা নিয়মমাফিক হয় না। একতারা, দোঢোকি তালে অষ্টক পালা হয়। তবে এ গান সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে লোকের মুখে- মুখে ফেরে না শুধু পালার সময়ই শোনা যায়।

বিজনদা জানালেন, চৈত্রসংক্রান্তিতে তাঁদের যে ঠাকুরতলা, সেই দেলবাড়িতে (দেউলবাড়ি) পুজোর জন্য তাঁর পরিবারের সবাই এই পালাগান করে থাকেন। তাঁর কথার বিশ্লেষণে যে সামাজিক ব্যাধিমুক্তি অষ্টক পালার মাধ্যমে হয়, তা আমাকে বিস্মিত করেছে।

আজকের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি ফ্ল্যাট কালচার তো মফস্বলেও পা বাড়িয়েছে। পাড়ায় পাশের বাড়িতে কারা থাকেন, সেটাও অন্য পড়শীদের অজানা। কিন্তু বিজনদা জানালেন, এই অষ্টক পালার মাধ্যমে তাঁরা নানা পাড়ার মানুষদের একত্রিত করেন। এক ঘরোয়া পরিবেশে উঠোনে বসে তাঁরা রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ পালায় কাঁদেন, মজার দৃশ্যে হাসেন। পালা শেষে যে যার বাড়ি ফিরে যান। নানা পাড়ার মানুষদের মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি হয়, জান- পহচান গড়ে ওঠে। আর গোটা চৈত্র মাসে হরেক পাড়ায় অভিনয়ে দর্শকের দেয়া ‘পাব্বনি’র সবটাই তাঁরা ব্যয় করেন দেলবাড়ির পুজোর জন্য। নবগোপাল মন্ডল, অবনী সরকার, চন্দন মন্ডল, মনীন্দ্রনাথ আঢ্য অষ্টকের সুনাম ধরে রেখেছেন।

তবে এই সময়ে এসে অষ্টক লোকজ জনপদ কিছুটা সীমাবদ্ধ। বিজনদা জানালেন, তাঁর দল ‘বিজন মন্ডল অষ্টক সম্প্রদায়’ সরকারি উদ্যোগে কিছু অনুষ্ঠান পান বটে, তবে চৈত্রসংক্রান্তির সময়টা বাদ দিলে বছরভর খুব বেশি অনুষ্ঠান হয় না। তবে ক্লাবগুলির আমন্ত্রণে তাঁরা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, পুরস্কার পান। বিজনদার শিল্পীমন এই শূন্যস্থান পূরণ করতে তাই রামায়ণ, বাউল গান পরিবেশন করে। আসলে এটাই তাঁর নেশা ও পেশাও বটে। পৌরাণিক সুরে তালবাদ্য ঢোলক ব্যবহৃত হয় অষ্টকে সঙ্গে থাকে করতাল, হারমোনিয়াম, দোতারা, বাঁশি।

এই প্রজন্মের আর এক মহিলা অষ্টক শিল্পী অন্তরা সরকার। উত্তর ২৪ পরগণা চাঁদপাড়া ফুলসরা খরের মাঠে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। তিনি অষ্টকেরই ঘরের মেয়ে। অন্তরা তাঁর জ্যাঠামশাই বিজন মন্ডলের থেকেই অষ্টক পালাগান শিখেছে। তিনি চান এই অমূল্য সম্পদটিকে আরো বেশি করে ছড়িয়ে দিতে। তাই তিনি তাঁর পূর্বসূরীর কাছ থেকে শেখা এই শিল্পটিকে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের যত্ন করে অনুশীলন করান। তাঁর আশা, তাঁর ছোট্ট মেয়েটিও ভবিষ্যতে তাঁরই মত শিল্পী হবে।

বিজনদার থেকে জানলাম, অষ্টকের ‘শৈব্যা’, ‘রাধার মানভঞ্জন’ ইত্যাদি পালা তাঁরা করেন। কখনো অসুরনাশিনী কালীদেবীর পালায় মুখোশের ব্যবহারও হয়। রাধাকৃষ্ণের `নৌকাবিলাস’ পালা দেখতে-দেখতে মানুষের মনে অষ্টসাত্ত্বিক ভাব জেগে ওঠে। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টসখীর লীলামাধুর্য এই লোকনাটকটির মূল গায়নগাঁথা। গ্রামবাংলার মানুষ এরই মধ্যে খুঁজে পান ‘রস’, ‘আনন্দ’,’দুঃখ’। তাঁর বিশ্বাস, এভাবেই অষ্টক পৌঁছে যাবে নতুন প্রজন্মের শিল্প আঙিনায়, বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে যেন সাযুজ্য রেখেই বাংলা লোকসংস্কৃতি সোনার খাজনা।