তিপ্পান্ন পূর্ণ বালুরঘাট ত্রিতীর্থ | অতনু গঙ্গোপাধ্যায়

বাংলার আধুনিক থিয়েটার ২২৭ বছর পার হয়ে গেল। তারপর অনেক নক্ষত্রের সুপারনোভা হয়ে হিমশীতল বৃদ্ধ হয়ে গেছে। শ্যামবাজার থেকে তপন থিয়েটার সব মঞ্চগুলির গায়ে বলিরেখার দাগ। সেই আলোকিত নীহারিকাপুঞ্জের থেকে অনেক দূরে আছে এক একাকি নক্ষত্র। ভারতবর্ষের শেষ স্টেশনের আরেকটি অপরিহার্য স্বাক্ষরের নাম- ত্রিতীর্থ। প্রতিষ্ঠা ১৯৬৯ সাল ২৬ অগাস্ট । ১৯০৯ সাল ইংরেজ রাজত্বে নাট্যমন্দির ছিল এডওয়ার্ড সিনেমা হল। স্বাধীনতার পর নাট্যমন্দির নামকরণ এবং নিয়মিত থিয়েটার চর্চা শুরু। নাট্যমন্দির নামেই ছিল নাট্যদলের নাম। সেই দল ভেঙে ত্রিশূল, তরুণ তীর্থ আর নাট্যতীর্থ মিলে নতুন দল ত্রিতীর্থ নাট্যদলের জন্ম। প্রতিষ্ঠাতা হরিমাধব মুখোপাধ্যায়।

এই দল যেভাবে জন্ম নেয় যেনো একটি সুপারনোভার পর অপর একটি তারা। সেভাবেই বালুরঘাটের নাট্যমন্দির থেকে পথ বেয়ে গতি বাড়িয়ে জন্ম ত্রিতীর্থের তারপর নাট্যতীর্থ আরো অনেক অনেক দলের। এটা অনেকটা ইওন্ডাকশন প্রক্রিয়া। নাট্যমন্দিরের ব্যাটন এসেছিল দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী হয়ে মন্মথ রায়ের পথ ধরে জাতীয়তাবাদী ভাবনা ও সামাজিক নাটক মঞ্চস্থ করার মধ্যে দিয়ে সমসাময়িক বিনোদনমূলক দৃষ্টি আকর্ষণের মধ্যে দিয়ে। সত্তরের দশক থেকে অভিমুখ ঘুরে যায় ত্রিতীর্থের হাত ধরে। তখনও বালুরঘাট ছিল একটি সীমান্ত আবিষ্টমন একটি মফস্বল। ত্রিতীর্থ পালটে দিল নাটকের অভিমুখ। দিনাজপুরের নাটক বিদেশি ভাষার বাংলা নাটক, ডাইমেনশন,গল্পের গতি আর কুসংস্কার বিরোধী, সাব-অল্টার্ন লড়াইয়ের গল্প ইত্যদি এক ঝাঁক নাটক মঞ্চস্থ করে ফেলল। একটি একটি করে ক্ল্যাসিফায়েড উদাহরণ দেওয়া যায় যেমন- জল, বিছন, দেবীগর্জন, সাব- অল্টার্ণ লড়াইয়ের ত্রিতীর্থের মঞ্চসফল নাটক। আবার ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী ও সামাজিক শোষণের ছায়ায় দেবাংশী, পীরনামা। একটি নিম্ন- বর্গীয় হিন্দু পরিবারের ধর্মীয় পরিচয়ে আত্মসংকট এবং অপরটি মুসলিম ধর্মীয় সংকট। বিদেশি নাটকের মধ্যে নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, গ্যালিলিও, মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, সামাজিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক,ব্যক্তি পরিচায়ক সংকট- এত ডাইভারসিফায়েড ডাইমেনশন বালুরঘাট শহরের কাছে নতুন। এর সাথে বাংলার নাট্যমঞ্চে একটি বিশেষ অবদান- আঞ্চলিক ডায়লেক্টকে নাটকে ব্যবহার করা। যদিও যাদের ভাষা তারা হয়ত দর্শক আসনে কমই ছিল কিন্তু নাট্য অভিধানে এর একটা একাদেমিক গুরুত্ব আছে। তারপর সত্তর দশকের পর-পরই ধীরে ধীরে বালুরঘাটের তথা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সামাজিক ভার্সের মুখ হয়ে উঠতে থাকে। জমির লড়াই আর প্র‍্যাগম্যাটিক ইয়ং জেনারেশনের সাংস্কৃতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে ত্রিতীর্থের জল, বিছন, দেবীগর্জন। যার ফলে ত্রিতীর্থের এক নাট্যআবহ বালুরঘাট তথা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই হল। এ যুগ নক্ষত্রের পূর্ণবিরাজ যুগ যদিও রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক শাখার এত জৌলুস ছিল না।

ত্রিতীর্থের ৫৩ বছর পূর্তিতে গিয়ে মনে হল- সুপারনোভা যুগ নেমে এসেছে। যে মানুষকে ঘিরে কলরব ছিল তিনি তার প্রিয় সংস্থার আলোকিত অঙ্গন ছেড়ে বসে আছেন নীরব অন্ধকারে। আজ তার জন্য মঞ্চ অনেকটা খালি লাগছিল, মনটাও। ত্রিতীর্থের নাটকের বৈশিষ্ট্যের প্রধান স্তম্ভ ছিল গল্প বলা। যে গল্পের সাথে থাকবে কিছু সামাজিক ম্যাসেজ। উত্তর- আধুনিকতার যুগে গল্পের প্রবহমান স্রোত আদি, মধ্য ও অন্ত ধারার প্রবহমানতা খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। আলো, মুদ্রা,শব্দ, বিভঙ্গ এখন এক-একটা চরিত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন বালুরঘাটে নতুন নতুন নাটকের দল আছে। নাটক করছে সমমন, বালুরঘাট নাট্যকর্মী। তাদের নাটকে কলকাতার আলো প্রক্ষেপণের সাহায্য নিচ্ছে, মঞ্চ করে তুলছে অনেক স্পন্দনশীল, স্কুল ড্রামার মাধ্যমে বিছন তৈরি করা, যৌথ পরিচালনার মাধ্যমে নাটককে চেষ্টা করছে সোস্যাল মিডিয়ার মুখগুলিকে কিছুটা ফেরানোর। নতুন কাব্য রচনা এবং মহাকাব্যকে ঘিরে আখ্যান নির্মাণ হয়। আমরা চাইব ত্রিতীর্থ বেঁচে থাকুক। নাটকের একটু মন্দা সময় যাচ্ছে বটে তবে মন্দা আমাদের সর্বত্র।

সমিতের বক্তব্যের সাথে একমত- একদিন মানুষ যান্ত্রিক অডিও ভিস্যুয়াল মাধ্যমকে রিজেক্ট করে সরাসরি ইন্ট্যারাকশনের মাধ্যমকে (যার মধ্যে নাটকও পড়ে) আবার বেছে নেবে। ত্রিতীর্থের ৫৩ তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে কিছু ভাবনা, কিছু ছবি রাখলাম। আমি বিশ্বাস করি- কোনো শিল্প মাধ্যম একাকি মেধার ফসল নয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য মাধ্যমের প্রভাব পুষ্ঠ, ঋদ্দ্ব করে। ত্রিতীর্থের কুশীলবদের টিম স্পিরিটকে শ্রদ্ধা জানাই।

One thought on “তিপ্পান্ন পূর্ণ বালুরঘাট ত্রিতীর্থ | অতনু গঙ্গোপাধ্যায়

  1. ত্রিতীর্থ কে আমাদের শুভেচ্ছা জানাই।

Comments are closed.