বাংলা নাটকে বাংলা ও বাঙালি কোথায়? | সুব্রত কাঞ্জিলাল

সাধারণত এইরকম প্রশ্ন আমাদের মনে উদিত হয় না। আমরা অনেক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করি, নাটকের রাজনীতির ব্যাপারে কতটা ঠিকঠাক হলো। শ্রেণী সংগ্রাম দেখাতে পারলাম কিনা। যারা এসবের বিরোধী তারা ভাবেন, নাটকের গল্পটা জমলো কিনা। গল্পটা টাচি হলো কিনা। পাবলিক গ্রহণ করবে কিনা। মেসেজ ব্যাপারটা দিতে পারা গেল কিনা। ইত্যাদি।

মৃত্যুর আগে বহু লেখায় এবং আলোচনায় বিজন ভট্টাচার্য অনবরত বলতেন, গণনাট্যের নাটকে গণের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে? যাদের জন্য নাটক তাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে? আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে এত নাটক লিখলেন, বিশেষ করে আপনার গ্রাম জীবন নিয়ে লেখা নাটকগুলো, যার মধ্যে বাংলার সাংস্কৃতিক মুখ খুঁজে পাওয়া যায়। দলগুলো অভিনয় করেনা কেন? বিজনদা বলেছিলেন, চোলাই কালচার, ইমপোর্টেড কালচার বাংলা থিয়েটার সিনেমাকে কব্জা করে ফেলেছে।

ঋত্বিক ঘটক বলতেন, হলিউডের ইমপোর্ট করা ফরাসি , জাপানি, রাশিয়ান কালচারাল সিনেমার সমাজ মানুষ আমি দেখতে চাই না। বিশ্বাস করি না। একইভাবে সত্যজিৎ রায় বলছেন, তিনি ছবি করতে আসার আগে বাংলা সিনেমা হলিউডের সেট, কালচার নকল করতো। এখান থেকে বের হতে হবে। নইলে আমাদের বাংলা সিনেমার মুক্তি নেই।

ফরাসি পরিচালক রেনোয়া কলকাতায় এসেছিলেন তার ‘দা রিভার’ ছবির শুটিংয়ের জন্য। সত্যজিৎ রায় সহ আরো অনেক সিনেমা প্রেমী বাঙালি ছুটে গিয়েছিলেন ফরাসি পরিচালকের কাছে। অনেক পরে সত্যজিৎ রায় লিখছেন, হলিউডের চোখ দিয়ে বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবনকে দেখার বিরুদ্ধে ছিলেন পরিচালক রেনওয়া । ঠিক এই জায়গাতে আমার চেয়ে অনেক বেশি খাঁটি বাঙালি ছিলেন ঋত্বিক ঘটক।

বেশ বুঝতে পারছি, আমাদের নাট্যকর্মীদের অনেকেই এতটা এগিয়ে এসে বুঝতে পারছেন না, আমি ঠিক কি বলতে চাইছি। কেন বলতে চাইছি। এই প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কি। থিয়েটার সিনেমা ইউরোপ থেকে আসা একটি শিল্প মাধ্যম। এই মাধ্যম পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে এই মাধ্যম নিয়ে যারা কাজ করেন, শিল্প সৃষ্টির কথা ভাবেন, তাদের অনেকে প্রথমেই যেটা ভুলে যান তা হল, নিজের দেশের, নিজের জাতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের দিকটা। যেমন আমাদের বাংলা দেশের যাত্রা হল অতি সুপ্রাচীন অভিনয় কলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। তার সঙ্গে জেলায় জেলায় রয়েছে আরো অনেক রকম লোক নাটক। এগুলো জাতীয় জীবনের গভীরে আত্মার আত্মীয় হয়ে রয়েছে। বাঙালি জাতির নানা রকম উৎসব পার্বণ সম্পন্ন হয় না এইসব লোকনাট্য গুলোকে বাদ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাইতো তিনি সাধারণত বিলিতি থিয়েটারের অনুকরণে নাটক লেখার চেষ্টা করেন নি। যাত্রার আঙ্গিক গ্রহণ করেছেন। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোও যাত্রাপালা এটাও মনে রাখতে হবে।

চীন দেশের থিয়েটার অপেরা ধর্মী। বিলিতি থিয়েটারের সঙ্গে চীনের অপেরা মিশিয়ে নিয়েছে ওই দেশের নাট্যকর্মীরা। এশিয়া মহাদেশের আরো অনেক দেশে ইওরোপীয় থিয়েটারকে নিজের দেশের লোকশিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে সাঙ্গীকরণ করে নিয়েছে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশেও এই ধারা প্রচলিত। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ তাদের জন্মলগ্ন থেকে এই বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিল। আমরা যদি গণনাট্যের উল্লেখযোগ্য নবান্ন নাটকের প্রযোজনার দিকটা দেখি, তাহলে দেখা যাবে, প্রসেনিয়াম থিয়েটারের মঞ্চে নবান্ন অভিনীত হলেও, নাটক রচনায়, উপস্থাপনার বিভিন্ন দিকগুলোতে বাংলা সংস্কৃতির চিহ্নগুলো বেশ স্পষ্ট ছিল। ঋত্বিক ঘটকের নাটকগুলোও এই ধারায় রচিত হয়েছে।

তুলসী লাহিড়ীর দুঃখীর ইমান, উৎপল দত্তের তিতাস একটি নদীর নাম ইত্যাদি নাটক বাংলা লোক নাট্যের স্বাদ গন্ধকে গ্রহণ করেছে। ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে এপার ওপারের অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তবে এই ধরনের চর্চা তেমনভাবে বেগবান হয়ে উঠছে না কেন?

পথের পাঁচালী ছবিতে আমরা কি হরিহর ,সর্বজয়া, অপু, দুর্গার গল্প দেখি? একই সঙ্গে আমরা গ্রামীণ বাংলার মুখ আবিষ্কার করি। হরিহরের সংসারে দুঃখ আছে দারিদ্র আছে। কিন্তু বাংলার প্রকৃতি তার অসামান্য রূপ বৈচিত্র্য নিয়ে অপু দুর্গার চারিদিকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। এখানে আছে কাশফুল, জল পদ্ম, ধানক্ষেত, সবুজ প্রান্তর, ঋতু পরিবর্তন, মেয়েদের ব্রত কথা, দুর্গাপূজা। সত্যজিৎ বাবুর অশনি সংকেত ছবিতে মানুষের সৃষ্ট ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আছে। তবু এখানে আশ্চর্য করা প্রকৃতির সৌন্দর্য এইসবকে ঘিরে রেখেছে।

মানুষের জীবন প্রকৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। প্রকৃতি থেকে দূরে মানুষের জীবন সম্পূর্ণতা লাভ করে না। ঋত্বিক ঘটকের প্রায় প্রতিটি ছবিতে প্রকৃতি ও মানুষের অঙ্গাঙ্গি বসবাস দেখতে পাওয়া যায়। ঘটক বাবুর ছবিতে আমরা আদিম পৃথিবীর আদিবাসীদের উৎসব ও দেখি। স্রষ্টা আমাদের বলেন, এই যে তোমাদের নাগরিক জীবন এটা স্বয়ম্ভু নয়। তোমাদেরও একটা আদিম জীবনের ঐতিহ্য রয়েছে।

আমাদের বাংলা নাটকের চরিত্রগুলোর মুখের সংলাপ থেকে বোঝা যায়, এরা বাঙালি। ব্যাস ওই পর্যন্ত। এরা কি খায় ভাত না রুটি? এদের মধ্যে বাঙালি জীবনের কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যের সংস্কার কতটা আমরা বুঝতে পারি না! যতক্ষণ নাটক চলে ততক্ষণ এরা জটিল জীবন সমস্যা নিয়ে কথা বলে, ঠাট্টা তামাশা করে, এমনকি যুদ্ধও করে। কিন্তু প্রতিটি চরিত্রকে তাদের রুচি বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধ, আচার ব্যবহার, শিল্পের প্রতি অনুরাগ কিছুই বোঝা যায় না।

হাওড়া ব্রিজ, শহীদ মিনার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এর ছবি তুলে কি বোঝানো যায় কলকাতার মুখ?

কলকাতার অন্তর আত্মাকে জানতে গেলে পায়ে হেঁটে বড় বড় রাস্তার পেছনে বড় বড় বাড়ির পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে যেতে হবে সরু সরু গলির মধ্যে। নরকের মতো অন্ধকার বস্তি জীবনের ছবি তুলে দেখাতে হবে। দেখাতে হবে ভাগীরথী নদীর দুই পাড়ে সভ্যতার অবশেষ গুলো। ফরাসি পরিচালক রেনোয়া তার রিভার ছবির শুটিং করতে এসে গঙ্গার দুই পাড়ের প্রাচীন সভ্যতার অবশেষ অনুসন্ধান করেছিলেন।
শাপলা ফুল, পদ্ম ফুল, কাশফুল আর গঙ্গার ওপর জেলেদের ছোট ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরার ছবি তুলেছিলেন।

রুশ দেশের নাট্যকার চেখভ একটা চেরি বাগানের ইতিহাস নিয়ে আস্ত নাটক লিখে ফেলেছিল। প্রাচীন চেরি বাগান। রুশ সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করা চেরি বাগান। সেই বাগানটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে নতুন সভ্যতার প্রতিনিধিদের কাছে। আমরা জানতে পারছি, রাশিয়াতে ওই নাটকের যেসব অভিনয় হয়েছিল, সেখানে রুশ ঐতিহ্যের প্রাচীন সংগীত ও নৃত্য কলার ব্যবহার হয়েছিল। ওই গল্পের আদলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর জলসাঘর গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায় সিনেমা নির্মাণ করে ছিলেন। সেই ছবিতেও পরিচালক যেসব সংগীত ব্যবহার করেছিলেন, পদ্মা পাড়ের পুরনো বাংলার রূপকে তুলে এনেছিলেন সর্বোপরি অস্তমিত সামন্ত প্রভুদের জীবনযাত্রার বিশ্বাসযোগ্য ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

উৎপল দত্ত তিতাস একটি নদীর নাম গ্রামীণ বাংলার মাঝি মল্লা জেলেদের জীবনযাত্রার ছবি মিনার্ভা থিয়েটারে যেভাবে তুলে এনেছিলেন তার তুলনা বাংলা থিয়েটারে বিরল। অনেক পরে আমরা আরও একটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছিলাম টিনের তলোয়ার নাটকের মুখোমুখি হয়ে। রঙ্গমঞ্চের পরিসরের ১০০ বছরের বেশি পুরনো বাঙালি জীবনের যেসব ডিটেলিং, আচার-আচরণ, সংস্কার, মূল্যবোধ, নাগরিক জীবনের বিশ্বাসযোগ্য ছবি আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যা অবিস্মরণীয়।

কটা বাংলা নাটকে শারদীয়া উৎসবের অনুরণন পাওয়া গেছে? মহালয়ার ভোরের আকাশ ছুঁতে পেরেছে?

কাশফুলের বাগানের মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলো ছুটোছুটি করেছে? বাঙালি জীবনের প্রেম ভালবাসা বিতর্ক ষড়যন্ত্রের পুকুর ঘাটের দৃশ্য উঠে এসেছে রঙ্গমঞ্চের ক্যানভাসে? কলকাতার নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কালচারাল সিম্বল বাড়ির ছাদগুলো। কত বৈচিত্র্য তার। দোতলা বাড়ি, তিন তলা, চারতলা, এমনকি পাঁচ দশ তলা বাড়ির ছাদে ঘটে যাওয়া বাঙালি জীবনের দুরন্ত ইতিহাসের সন্ধান কোন নাট্যকার কবে করেছেন? কিংবা ধরুন কোন অখ্যাত বা বিখ্যাত রেলস্টেশনের গল্প। আমরা অপুর সংসার সিনেমাতে দেখি, অপু একটা বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে বাস করে। পাশেই রেল ইয়ার্ড। রেল লাইনের উপর দিয়ে তার আসা যাওয়া। স্টিম ইঞ্জিনের হুইসেল তাকে যেন ডেকে বলে, তোমাকে যেতে হবে। অনেকদূর যেতে হবে। কলকাতার এই চিলে কোঠার ঘর তোমার অনিষ্ট নয়। অপু তার বন্ধুর সঙ্গে নৌকা করে চলে যায়, পদ্মা পাড়ের আর এক জীবনে।
পদ্মা নদীর মাঝি কিংবা সমরেশ বসুর গঙ্গা পাড়ের মাঝি মল্লারদের জীবন সংগ্রাম বাংলা রঙ্গমঞ্চে উঠে এলো কই? বলুনতো আমাদের কটা বাংলা নাটক বাঙালির ইতিহাস চেতনা এবং সময়ের কাছে দায়বদ্ধ ছিল?
তাহলে কি আমরা আমাদের থিয়েটারের কর্মীরা বাঙালির ইতিহাস চেতনা থেকে নিজেদের বিযুক্ত করতে চান? আমরা কেন ভুলে যাই যে, কোন জাতি যখন তার নিজের ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হয়, সুপ্রাচীন ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিজাতীয় সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি বলে গ্রহণ করে, তখন জাতি যেমন অধঃপতিত হয়, তার জীবন হয়ে ওঠে বিপন্ন! তার সামাজিক এই বিপন্নতা ধ্বংস করে দেয় সেই জাতিকে, জাতির সংস্কৃতিকে!
আমরা কি বুঝবো না যে আফ্লুে এন্ট সোসাইটি আসলে মানব সভ্যতার শত্রু। মেট্রোপলিটন শহর এক ধরনের কসমেটিক সভ্যতার নামান্তর।

বিগত ৩০ বছরে কি তারও বেশি হবে, আমরা অবিরত ডুবে যাচ্ছি এক বিকৃত মানসিকতা আর অমানবিক রাজনীতির পাতালে। ভাবুন বন্ধু ভাবুন। কোন পথে মুক্তি আমাদের সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন। থিয়েটার যদি সমাজ দর্পণ হয়, তাহলে আমরা সবচেয়ে বড় থিয়েটারের শত্রু।