মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিরূপ সমালোচনা (প্রথমে) করলেও, সামগ্রিকভাবে মধুসূদন প্রশংসাই পেয়েছিলেন সাহিত্যক্ষেত্রে । আসলে বলার আঙ্গিক, ভাষা যেমনই হোক, উদ্দেশ্যের সততা ও নিরপেক্ষতাই হল আসল, তার একটা আলাদা জোর থাকে। রামকে ভীরু, দেবনির্ভর, কাপুরুষ… নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করার পর মধুসূদনের মুণ্ডু কাটার দাবি ওঠেনি সেভাবে। সেই মেঘনাদ বধ নিয়ে গৌতম হালদার অসাধারণ নাটক করলেন , যা বাংলা নাট্যকে সমৃদ্ধ করল, চমকিত করল… এভাবেও হয়, একটা ছন্দোবব্ধ ভাষাকে এভাবে সংলাপে আনা যায়! শরীর আর মন এভাবে একাত্ম হয়ে ছবির মত কথা বলে তাল ও সুরের সঙ্গে মিতালি করে!
মূলত শাঁওলি মিত্রই শুরু করেছিলেন। অনেকের মতে ইরাবতী কার্ভে, তাঁর ‘যুগান্ত’ দিয়ে শুরু করেন একটা বিশেষ দিকে যাত্রা। যাইহোক বাংলা নাট্যের ক্ষেত্রে আমরা শাঁওলি মিত্রকেই ধরি এই ধরণের নাট্যচিন্তার। সেই যে তিনি দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে অবিস্মরণীয় পালা তৈরি করলেন ‘নাথবতী অনাথবৎ’ (প্রথম অভিনয় :১১ অগাস্ট ১৯৮৩), পরে আরো কিছু চরিত্র নিয়ে ‘কথা অমৃত সমান’। ব্যাস শুরু হয়ে গেল বাংলা নাট্যের এক সহজ পথ, একক নাট্যের সরল এক রাস্তা। কী না বাল্মীকি আর ব্যাসের দর্শনের যত রাজ্যের ভুল বের করা। সেই ভুল ধরছি কারা, আমাদের মত সব নাটককাররা, যাঁরা পনের পাতার একটা নাটক লিখতে গিয়ে চরিত্র আর প্লট ঠিক রাখতে পারি না। মহাকাব্য কোন সমাজ ও দর্শনকে ভিত্তি করে তৈরি? মূলত কোন উদ্দেশ্যকে প্রতিভাত করার জন্য এত বড় আয়োজন? যার ভিতর অজস্র যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির প্রবল সহাবস্থান, যেখানে ভগবানের বুকে ভক্ত পদাঘাত করলে ভগবান বলে ওঠেন, ‘আপনার পায়ে আঘাত লাগেনি তো!’, যেখানে স্বয়ং ব্রাহ্মণ নিজের মৃত্যুর সংকল্প করে দুর্গাপুজো করেন পরম শত্রু যজমানের অনুরোধে, যেখানে মহামায়াকে মূল শক্তি ধরা হয়েছে প্রবল পৌরুষকে একপাশে শরীর সরিয়ে… সে-সব প্রকৃতার্থে না বুঝেই, বা বুঝেই এ যুগের নিরিখে আপাত কোনও অন্যায়কে তুলে, বা আমাদের মোটা বুদ্ধি বা মোটা দৃষ্টিতে কিছু একটাকে নিয়ে চটজলদি একটা নাটক নামিয়ে দেওয়া। দু’চারটে অনুবাদের রামায়ণ, মহাভারত পড়ে নেওয়া, সঙ্গে নৃসিংহপ্রসাদ, দীপক চ্যাটুজ্জের একটা দুটো বই। ব্যাস গবেষণা শেষ, নাটক শুরু।
শাঁওলি কিন্তু তাঁর নাটকের ভূমিকায় বলেছিলেন, “পাঠক নিশ্চয় বুঝবেন মেয়েদের প্রাধান্য থাকলেও, পুরুষদের নিয়ে টিপ্পনী কাটা হলেও এ নাটক নারীবাদীদের তরফের নাটক নয়। আমার মনে হয় ‘নাথবতী অনাথবৎ’ ও তা ছিল না। এ নাটকে যে সব নারীরা প্রাধান্য পেয়েছে তাঁরা মানুষ হিসেবে জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রভূত কষ্ট পেয়েছে। যুগে যুগে মানুষকে যে জটিলতা, যে কষ্ট, যে সমস্যার মরুভূমি পার হতে হয়েছে তা প্রকাশ করার চেষ্টাতেই এ নাটক লেখা”। শাঁওলি নারীপুরুষের সংকীর্ণ বিভাজন না করলেও, সংকীর্ণ নারীপুরুষ নিজেরাই বিভাজিত হয়ে বসে আছে সহজে দ্রুত এগিয়ে যাবার উন্মাদনায়।
আসলে একতরফাভাবে কথা বলে যাওয়ার ক্ষেত্র রয়েছে, চরিত্রটিকে নিজের মত করে সাজিয়ে নেওয়ার সুবিধে আছে, আর কী চাই… তবে মহাকাব্যিক চরিত্র নিয়ে প্রতীকী নাটক প্রাণবন্তও হয়ে উঠেছে অনেক ক্ষেত্রেই। এ বিষয়ে প্রথমেই বলি অসীম চট্টরাজের ‘অথ কৃষ্ণ কথা’র কথা। এ নাটকের স্যাটায়ার যেমন, যেমন রূপাকার্থ, তেমনি এর বিন্যাস ও সংলাপ। ‘সাহত্যিকা’র প্রযোজনায় এ নাটক অভিনীত হয়েছে বহুবার। কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের ‘শূদ্রায়ন’ ও একটি অন্য ধরনের নির্মাণ। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ও অনুসন্ধানী এক নাটক এটি। বহরমপুর ঋত্বিক এ নাট্যের অভিনয় করছে। এ নাটকের সার্থক রূপ বেশ আমরা দেখেছি কিছু মঞ্চায়নের অনেক বছর পরে আবার। ‘অশোকনগর নাট্যমুখ’ প্রযোজনা ‘গান্ধারী’ (নামভূমিকায় সঙ্গীতা চক্রবর্তী) আর একটি এ ধরনের নাটক যার বিন্যাস ও গঠনের উদ্দেশ্য সৎ ও নিরপেক্ষ এবং যার নির্মাণে জড়িয়ে আছেন সত্যব্রত রাউতের মত ভারত জোড়া খ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ।
কিন্তু এ সব তো ব্যতিক্রমের মত, আরো অজস্র নাটক এই মহাকাব্য দুটি থেকে নির্মিত হচ্ছে, যা স্রোতে গা ভাসানো ছাড়া আর কিছু নয়। মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মহাকাব্য সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘রামায়ণে ভারতবর্ষ যাহা চায় তাহা পাইয়াছে’ (রামায়ণ, প্রাচীন সাহিত্য)। ‘মহাভারতে একটা উদাত্ত শিক্ষা আছে, সেটা নঙর্থক নয়, অর্থাৎ তার মধ্যে একটা হাঁ আছে’ (মহাত্মা গান্ধী, চারিত্রপূজা)। ‘য়ুরোপিয় মহাকবি হইলে পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়েই মহাভারত শেষ করিতেন। কিন্তু আমাদের ব্যাস বলিলেন রাজ্য গ্রহণ করায় শেষ নহে, রাজ্য ত্যাগ করায় শেষ। (চিঠিপত্র -৫)। এত সব কথা বোঝার বা অন্তস্থ করার সময় সত্যই কি আমাদের আছে !
এইবার আসি, আর একটু অন্য ধরনের কথায়। আচ্ছা, আর কোনও ধর্মগ্রন্থ নেই এ বিশ্বে! সেই সব গ্রন্থের চরিত্র বা তার নানাবিধ মূল্যায়ন নিয়ে কেন বাংলা নাটকে হয় না! হয় না তা নয়, ‘অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটারে’র ‘বিষাদকাল’ (?) নাটকে দেখেছিলাম অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধর্ম নিয়ে কিছু সংলাপ শোনাতে, এই স্পষ্টতা এইভাবে, এত নির্ভিকভাবে খুব কমই দেখা যায় বাংলা নাট্যে। আমি অনেক খ্যাত নাট্যকারের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছি, শুধু বিশেষ এক ধর্ম নিয়ে এত রূপক, এত প্রতীক আর এত অসাম্য তুলে ধরার প্রবণতা কেন? দেখেছি তাঁদের নিস্তব্ধতা। আসলে আমাদের বিপ্লবী সত্ত্বার সীমা ততটাই, যতটার মধ্যে কোনও বিপদের আঁচ নেই। কে চায় নিজের কাটা মুণ্ডু দেখতে… নাটক যখন লিখি, তখন কলকাতা বা অন্য শহরের অভিজাত এলাকাতেই বিপ্লবের বাণী শোনাতে হবে, দু- একটা মোমবাতি মিছিলে হাঁটতে হবে, আর…।
আমি তো দেখি এখন যাঁরা গরীব মানুষের যন্ত্রণা নিয়ে কথা হচ্ছে , কীভাবে তাঁদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতারিত করা হচ্ছে, ধর্মের জালে কীভাবে তাঁদের বেঁধে ফেলা হয়েছে… এই সব নিয়ে নাটক লেখেন বা করেন, তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু উপাদেয় আহার, বিলাসী যাপন এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অট্টালিকায় অভ্যস্ত। এঁরা উইকিপিডিয়া দেখে তথ্য সংগ্রহ করেন আর ফেসবুকে বিপ্লব উৎপন্ন করেন। ফেসবুকে এখন অদ্ভুত এক অন্ধকার তৈরি করেছে, সেখানে জন্মদিনের কেক থেকে সমুদ্রতটে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্তগুলি পর্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক করে তোলায় আমাদের অধিকাংশ সিদ্ধ। ব্যক্তিগত কিছু নেই আর। দলে দলে দলবদ্ধ ফেসবুকীয় জীব !
এইভাবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি বাল্মীকি আর ব্যাসের ভুল ধরে নিজেদের এক শ্রেণির মানুষের কাছে ‘নিরপেক্ষ’ ও বোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে, আর এক শ্রেণির কাছে… বললাম না। শুধু বলব এ বাংলা নাট্যের দৈন্য… অন্য ধর্মের অন্য চরিত্রকে কাটাছেঁড়া করে, রূপকে, প্রতীকে জর্জরিত করে লিখুন না কেউ একটা বাংলা নাটক… দেখি বিপ্লব আর বিপ্লব এখন বাংলা নাট্যে কোথায় আছে…?
দারুণ লেখা। প্রয়োজনীয়ো বটে।
বেশ তলিয়ে ভেবে নির্যাসটুকু তুলে আনলে। অভিনন্দন। অত্যন্ত গভীরে চমৎকারিত্ব। শুভেচ্ছা, ভালোবাসা আর 🙏