বেলাশেষের আরতি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত চলে যাওয়ার একবছর|

সংকলন – অসীম দাস

বেলাশেষের আরতি চলে যাওয়ার একবছর কিভাবে কেটে গেলো। তিনি নেই একথা ‘ভাবতেই ব্যথায় মন ভরে যায়’ আমাদের ।
১৬ জুন ২০২১ বাংলা থিয়েটারের ছিল শোকের দিন। অপরিহার্য সময়ে ছেড়ে যাওয়া পথে তাঁর ‘কত কি করার ছিল বাকি’! যে কিনা অসময়ের নাট্যবন্ধু, নান্দীকারের স্তম্ভ। বিখ্যাত এবং কিংবদন্তি ভারতীয় বাঙালি মঞ্চাভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

ভারতীয় থিয়েটারে অভিনয়ে তাঁর অবদানের জন্য তিনি ২০১১ তে সংগীত নাটক অাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অাকাডেমিও তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। তাঁর সহজ সরল ও প্রাণবন্ত অভিনয়ের পাশাপাশি গান, আবহ সংগীত প্রয়োগের জন্য প্রিয় বাঙালি দর্শক মুগ্ধ।

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। দীর্ঘ দিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। ডায়ালিসিস চলছিল তাঁর। এমনকি, একুশ দিন আইসিইউতেও ভর্তি ছিলেন স্বাতীলেখা।
মঞ্চ দাপিয়ে কখনও অভিনয় কখনওবা বেহালা হাতে নিয়ে বেড়ানো সেই অভিনেত্রীর পথ চলা থমকে গেল। চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘বিমলা’।

১৯৮৪ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাদাকালো চলচ্চিত্রে অভিনয়ের যাত্রা শুরু স্বাতীলেখার। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘ঘরে বাইরে’-র ‘বিমলা’ অভিনয় নিয়ে আজও প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাংলা ছবির দর্শক। ১৯৯২ সালে ‘সিটি অফ জয়’, ২০১৬ তে মুক্তি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ধূমকেতু। এই ছবিতে আম্মার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বাতীলেখা। ২০১৯ তে সুদীপ চক্রবর্তীর ছবি বরফ এ দেখা গেল তাঁকে অনেকদিন পর। শাশুড়ির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি । বৌমা ইন্দ্রাণী হালদার। একদিকে পর্বতারোহণে গিয়ে ছেলের না ফেরা, অন্যদিকে বৌমার সঙ্গে সাংসারিক সমীকরণ। যথাযথভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। ঘরে বাইরের পর অনস্ক্রিন সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে অনেকদিন কাজ করা হয়নি তাঁর। মানুষের ভালো লাগার অন্দরে সেই থেকে সৌমিত্র ও স্বাতীলেখার জুটিকে পছন্দ করেছিলেন অনুরাগীরা। দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর আবার হাতে হাত রেখে আরতিকে সাবলম্বী করতে সৌমিত্রর সঙ্গেই পর্দায় ফেরা। প্রযোজক -পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে বড় পর্দায় আবার দেখা হয় তাঁদের । ‘বেলাশেষে’ ছবিতে সৌমিত্র-স্বাতীলেখার রসায়ন দেখে আপ্লুত দর্শকদের জন্য ফের ২০২২ এ মুক্তি‘ বেলাশুরু’-তে অভিনয় করেন তাঁরা। কিন্তু ছবি মু্ক্তি পাওয়ার আগেই চলে গেলেন নায়ক-নায়িকা। গত বছর নভেম্বর মাসে মৃত্যু হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। জুনের বুধবার চলে গেলেন স্বাতীলেখাও।

‘ঘরে বাইরে’-তে সেই সময় দাঁড়িয়ে সন্দীপ-বিমলার চুম্বন দৃশ্য ঝড় তুলেছিল দর্শক মহলে। সেই যুগে বাংলা ছবিতে চুম্বন জল-ভাত ছিল না। স্বাতীলেখা বলেছিলেন- “কিন্তু জানো, আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। ৭-৮ বার টেক দিতে হয়েছিল। বারবার ওঁর শালে আমার হাত চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই দৃশ‍্যে শাঁখা পলা দেখানোটা খুব দরকার ছিল, অর্থাৎ এয়ো-স্ত্রী র চিহ্ন। সৌমিত্রবাবু এত সহজ করে দিলেন বিষয়টি, নবাগতা আমি কত সহজেই করে ফেললাম বিষয়টি। এখনও মনে পড়ে”।

১৯৭০ সালে ইলাহাবাদে মঞ্চজীবন শুরু তাঁর। মঞ্চজীবনে পেয়েছেন বিভি করন্থ, তাপস সেন এবং খালেদ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য। ১৯৭৮ সালে ‘নান্দীকার’ নাট্যদলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি। সেখানেই আলাপ ও প্রেম হয় নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে। তার পরে বিয়ে এবং সংসার। মঞ্চে ‘খড়ির গন্ডি’,ফুটবল এ প্রথমে ক্রাউড পরে হরির মাসি, ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’, ‘মাধবী’, ‘পাতা ঝরে যায়’ ইত্যাদিতে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন স্বাতীদি। নান্দীকার-এর বেশ কিছু নাটকের সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার দীর্ঘ স্মৃতিচারণায় দৃশ্যতই আবেগবিহ্বল ও শোকসন্তপ্ত। তিনি বলেন – ‘ওঁর চলে যাওয়ায় কতটা ক্ষতি হল তা পরিমাপ করতে পারব না। আমার অভিনয় জীবন শুরুই ওঁর হাত ধরে। আমি যেদিন অভিনয় করব বলে এসেছিলাম নান্দীকারে, সেদিন আমি অভিনয় করার যোগ্য কিনা আমাদের সেই পরীক্ষা উনিই নিয়েছিলেন। আমাকে নির্বাচনও করেছিলেন উনি। এবং তারপর তো মঞ্চে ওঁর সঙ্গে চৌত্রিশ বছর ধরে অভিনয় করেছি। কাছের মানুষ, বাড়ির মানুষ, চার দেওয়ালের মানুষ চলে গেলে যেমন হয়, তেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে ‘।

বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন – ‘যাঁরা থিয়েটার ও চলচ্চিত্র ভালবাসেন তাঁরা স্বাতীদিকে মনে রাখবেন। এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, স্বাতীদি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবটা মুছে যাবে। এটা ঠিকই যে, থিয়েটারটা সিনেমার মতো থেকে যায় না, কিন্তু যাঁরা থিয়েটারের দর্শক, তাঁরা ভীষণ ডেডিকেটেড। তাঁরা অত চট করে সব ভুলে যান না।
‘স্বাতীদির যে লম্বা কেরিয়ার। সেখানে বিচিত্র সব কাজ। সেই ‘গ্যালিলিওর জীবন’ থেকে শুরু করে ‘ শানু রায়চৌধুরী’ একক, ‘শেষ সাক্ষাত্‍কারে’ ছোট্ট একটা অংশ, ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’, থেকে ‘নাচনি’ পর্যন্ত। ওয়ান্ডারফুল জার্নি ‘।

শহরের আর এক নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, স্বাতীলেখার চলে যাওয়াটা বাংলা থিয়েটারের অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি বলেন- ‘এটা পূরণ হওয়ার নয়। উনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। কয়েকদিন আগেই রুদ্রবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। স্বাতীলেখার মৃত্যুতে আমাদের থিয়েটারের একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
ব্যক্তিগত স্মৃতি অসংখ্য। কোনটা বলব। ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ সূত্রে একটা কথা মনে পড়ছে। উনি এমনিতে খুব একটা লিখতে চাইতেন না। কিন্তু ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ দেখে নাটকটা কেমন লাগল তা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে একটা লেখা ইংরেজিতে লিখে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আজও রেখে দিয়েছি। ওটা একটা প্রেরণা।’

ওঁনার মৃত্যুর একবছর পর মনের কথা লিখতে মন চাইল আমার। তবে সমালোচনা নয় হয়ত ভালোর জন্যই আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। আমরা ভুলবশত অভিমানী মন ভারাক্রান্ত করে ছিলাম এতদিন। সেদিনটা ছিল ২০০২ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একটা দুপুর।
উত্তর কলকাতার ১১৯, বিবেকানন্দ রোড পিন ৭০০০০৬, লাল রঙের পুরনো বাড়ি। জীবনে একবারই আমার যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন ল্যান্ডফোনের যুগ। অভিই ওদের বাড়ির ফোন থেকে সম্ভবত রাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট কর্নফাম করেছিল। মফস্বলের নতুন নাটকের কাগজ, অপরিচিত নাটকের দল তখন অশোকনগর নাট্যমুখ। ‘ছেলেমানুষ’ দুই পত্রিকা সম্পাদকের বারংবার চেষ্টার ফলে দেখা মিলল অবশেষে। দিনটা মনে নেই, তখন বোধহয় ফুটবল নাটকটা নিয়মিত হতো। নিচতলাটা স্যাঁতস্যাঁতে প্রায় অন্ধকার। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে আসতে বললেন। পুরনো দিনের বাড়ি। দেখা হলো, মুখটা গম্ভীর । বসতে বলেছিলেন কিনা মনে নেই! অনেক আশা নিয়ে বাংলা থিয়েটারের মহিরুহ সেনগুপ্ত পরিবারের অন্দরমহলে পা রেখে বুকটা ভয়ে ভরে উঠেছিল। টেপরেকর্ডার সঙ্গে বয়ে নিয়ে গেলেও কোনো স্বরই বন্দী করতে পারিনি মনে আছে। প্রশ্নগুলো রেখে বলেছিলেন সিদ্ধার্থর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বলেছিলাম — ম্যাডাম, ছাপা হয়ে গেলে কয়েকটি সংখ্যা দিয়ে যাবো। স্বাতীদির জবাবে এতটুকু ভনিতা ছিল না সেদিন। হয়তো জনপ্রিয়তা আর ব্যস্ততার চাপে আশাহত পথে হাঁটলেও সত্যিটা সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে বলতে শিখিয়েছিলেন। সেদিনের কথাটা কেনো জানি আজও কানের পাশে বড্ড বেসুরে বাজে — আমাকে দেবার দরকার নেই, নাটকের অবসরে পড়াশোনার এত চাপ পড়বার সময় কোথায় ! অহেতুক ওয়েস্টবিনে হারিয়ে যাবে! হয়তো নষ্ট হওয়ার কথা বলতে চেয়েছিলেন। হয়তো আমাদের মতো মফস্বলের কাগজে ওয়ালাদের এই কাগজ বিক্রি করলে দুটো পয়সা আসবে! এই ভেবে বলেছিলেন ভয়ংকর সত্যিটা!
তারপর আমরা বেড়িয়ে যেতে বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে শোয়ে যাবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন ম্যাডাম। ধীর পায়ে নেমে এলাম দুজনে। সেদিনের মনভার করা বিকেলে একে অপরের দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম, হাল ছাড়লে চলবে না, ভালো করে পত্রিকা বের করতে হবে। নাট্যমুখ নাট্যপত্র দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রকাশকাল মে ২০০২ সাল। সেই সংখ্যায় হেডলাইন করলাম – ‘মেটালিক স্বপ্ন আমাকে ছোঁয় না ‘।
আপনার স্বপ্ন আমাদের ছুঁয়ে থাকুক, আমাদের তৃপ্তি দিক আপনার অশেষ কাজ।
আপনি যেখানেই থাকুন আমাদের মধ্যে থাকুন, ভালো থাকুন।