দীপা ব্রহ্ম
রুখ সুখা, লাল মাটির ওপর আঁক দিতে দিতে পথ চলেছি। আনন্দ-দুঃখ, কালো-সাদা, সবুজ-লাল-এর মায়ায় কখন যেন থমকে গেল সেই ছবি। পথ গিয়ে পৌঁছালো অতীতের অতলান্তে। যেখানে সেই শাল-পিয়ালের শেকড় এতটুকু জলের সঙ্গে ছুঁয়েছে মাটির হৃদয়। ভাদুমণি—বড়ো আদরের নাম বটেগো। রাজার দুলালী মহা-সতী। মানভূমের কালীরাজ দুহিতা। আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সেই মানবী-ই দেবী। গোটা ভাদর মাস জুড়ে তাঁর পূজা হয়, তাঁর মূর্তি স্থাপনা করে। তবে ভাদুকে নিয়ে নানা লোক নানা মতবিধান দেন। বীরভূমের লাভপুরের মাটির মানুষ নাড়ুগোপাল মুখার্জী জানালেন, ‘ভাদু রাজার মেয়ে। তাঁর বিয়ে স্থির হলো। ভাদুর সেই পাত্র বনের মধ্যে দিয়ে আসবার সময় দস্যুদের আক্রমণে মারা যায়। ভাদু লগ্নভ্রষ্টা হন। কিন্তু তিনি তাঁর হবু স্বামীর চিতায় সহমরণে যান। ভাদুমণির পিতা ভাদুর স্মৃতিতে তাঁরই মূর্তি গড়ে গোটা ভাদ্রমাস জুড়ে তাঁকে নিয়ে গান করেন।’
সীমান্ত বাংলার বর্তমান পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুরের কিছু অংশে ভাদু গানের প্রচলন রয়েছে। ভাদুর আখ্যান সম্পর্কে আবার কেউ বলেন, রাজকুমারী ভাদু সমাজের এক অতি সাধারণ ছেলের প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সমাজের শ্রেণি ব্যবধান তাঁকে তাঁর প্রেমিকের সাথে মিলিত হতে দেয় না। তাই ভাদু আত্মহত্যা করেন। লোক-গবেষকরা মনে করেন, মানভূমের রাজার একমাত্র সুন্দরী কন্যা ভদ্রেশ্বরী। প্রতিদিন রাতে বনের মধ্যে মন্দিরে তিনি পুজো করতে যেতেন। রাজা কৌতূহলবশত পিছে পিছে গিয়ে দেবতার মূর্তির সামনে মেয়ের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। শোকাতুর রাজা সেই থেকে প্রজাবৃন্দকে আদেশ দেন গোটা ভাদ্রমাস জুড়ে তাঁর আদরিণী ভাদু মায়ের মূর্তি স্থাপন করে যেন পুজো করা হয়।
লোকগাথা সময়ের পাকে আবর্তিত হয়ে নানা রূপ নিলেও সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছেন দেবী ভদ্রেশ্বরী বা ভাদু। নাড়ুগোপালবাবু ভাদুগান করেন। তাঁর দলের নাম সুরুলিয়া ন্যাড়াইচণ্ডী ভাদুগানের দল। প্রায় পনেরো বছর ধরে তিনি এই সংগীত জগতে রয়েছেন। পেশা চা বিক্রি, নেশা সংগীত পরিবেশনা।
তিনি জানালেন, যেহেতু ভাদুগান ভাদরের চড়া রোদে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গান করে বেড়ানো হয় তাই সেই রীতি মেনে গানের আসরে ছাতা রাখা হয়, রাস্তায় নিরাপত্তার
জন্য বল হিসাবে থাকে লাঠি, বহুদিন ধরে ঘুরে বেড়ানোর রসদের জোগাড়ে থাকে বস্তা, থাকে ধামা, রাতে পথচলার জন্য হ্যারিকেন রাখা হয়। আমি নিজেও ভাদুগানের আসরে উপস্থিত ছিলাম। তখন আমিও বুঝিনি কেন এই জিনিসগুলি রেখে ভাদুর মূর্তির সামনে গান ও নাচ পরিবেশিত হয়। এখন শিল্পীর বিশ্লেষণে সবটা বোঝা গেল। কত প্রতীকী অথচ কত সরল এই লোক বিন্যাসটি। ভাদু গানের দুলকি শুধলাম নাড়ুগোপালবাবুর সুললিত কণ্ঠে ‘শুনুন মধুর বাণী ‘–
ভাদুর গানে জানাবো আজ ভাদুর কাহিনি মদন রাজা পিতা ওগো পদ্মাবতী জননী।
মানভূম জেলায় জন্ম ভাদুর…
ভাদু যে রাজনন্দিনী।।
ভাদুর বিয়ে ঠিক হল বর্ধমানে
রাজার কুমার পাত্র হবে, রাজকুমার,
রাজার কুমার পাত্র হবে খুশী যে ভাদুমণি।।
শুনুন মধুর বাণী।
ভাদুর জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু নিয়েই ভাদুর গান। তবে খুবই বিষাদময় তাঁর পরিণতি। ‘বিচ্ছেদএ আখ্যানের সঙ্গী’, জানালেন নাড়ুগোপালবাবু। কথা বলতে বলতে আখ্যান থেকে বাস্তব ছুঁয়ে গেলেন তিনি। তাঁর জীবনও দুঃখে ভরা। গান, আসরের প্রতি প্রেম কখন তাঁর মানব প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটলো তিনি এখনও তা বুঝতে পারলেন না। একটি ছেলে ও একটি মেয়েও আছে তাঁর। কিন্তু নেই ঘরে ফেরার টান। ঘরণী যে ঘর ছেড়েছেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। অভিমান, ভুল বোঝাবুঝির পাল্লা ভারি করে তাঁর স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে থাকেন। নাড়ুগোপালবাবু তাই বোধহয় আরো বেশি করে সংগীতকে আঁকড়ে ধরেছেন। দুঃখ, অভিমান চেপে তিনি জানালেন, ‘আমি ভালোই আছি। কোনও দুঃখ নেই আমার। এতদিন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিগত স্পেসে গিয়ে কোনো শিল্পীর সাথে কথা বলিনি। মনটা ভিজে গেল বটে। নাড়ুগোপালবাবু জানালেন, ‘প্রচুর মানুষের ভালোবাসা আমি পাই, দেখুন শিল্পীর জীবনে বেদনা তো থাকেই।’
এই শূন্যতাই তাঁকে ভাদুগানের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। বর্তমানে ভাদু গানের সুরের প্যারোডি সম্পর্কে তিনি কিছুটা শঙ্কিত। তবে তাঁর আশা, নতুন ছেলেরা নতুনভাবে ভাদুকে আবিষ্কার করবে। ভাদুমণিকে বাঁচিয়ে রাখবে।
অপর ভাদু-শিল্পী পুরুলিয়া কাশীপুরের সঞ্জয় সূত্রধর জানালেন, ভাদু আসলে দেবী। তাঁর দল ‘ভাদু লোক শিল্পী সঙ্ঘ’। একই অঞ্চলের শহর ও গ্রামে ভাদুকে নানাভাবে পুজো করা হয়। তিনি বললেন, তাঁর ঠাকুমা বা মামিমা যে ভাদুগান করেন, তার যে সুর আর তাঁর গাওয়া ভাদুগানের সুরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গোটা ভাদ্রমাস জুড়ে রাত্রি জাগরণ করে এই অঞ্চলের গ্রামের নানা বয়সের মেয়েরা ভাদুগান করেন। এখানে ভাদুর বিরাট মূর্তি গড়ে, তাঁর কোলে কৃষ্ণকে দেওয়া হয়। প্রসাদ হিসাবে থাকে খাজা, মিষ্টি ইত্যাদি। সঞ্জয় সূত্রধর ইলেক্ট্রনিক্স-এর কাজ করেন। ভাদুগান তাঁর নেশা। তিনি বলেন, ‘হিন্দি সিনেমার চটুল গান, বাংলা সিনেমার চটুল গানের চাপে এই লোকজ সংস্কৃতি তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। বলা যায় ভাদু গানের লড়াই তার নিজের আঙ্গিকের সঙ্গেই পরিবেশন – কথা- সুর- তাল- লয়ের সঙ্গেই। তবু গোটা মানভূমে ভাদু পূজিত হন। রূপনারায়ণ, কংসাবতী, অজয়ের বাঁকে বাঁকে তাঁর জীবনকাহিনি বর্ষার টাটকা জলে ফুলে ফুলে ওঠে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।