জনৈক তরুণ অভিনেতা এবং পরিচালক কয়েক বছর ধরে আক্ষেপ করছেন, সাহিত্য সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ বাংলা নাটক কেন লেখা হচ্ছেনা? এই একই অভিযোগ বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে অনেকেই করেছেন। এই আক্ষেপ যথার্থ। কিন্তু সর্বৈব সত্য নয়।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে সত্যিই কি ভালো নাটকের অভাব ঘটেছে? যদি প্রশ্ন তোলা হয়, এই পঁচাত্তর বছরে যেসব বাঙালি নাট্যকাররা নাটক লিখেছেন, সেগুলো কি সবি অকিঞ্চিৎকর? বিভিন্ন নাটকের দলের পরিচালক মশাইরা সব সময় কি ভালো নাটক কদর করেছেন? তাঁদের হাতে যেসব বাংলা নাটক পৌঁছে গিয়েছিল, সেই নাটকগুলোকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাঁরা কি বুঝতে পেরেছিলেন যে এর সাহিত্যমূল্য বর্তমান? তাহলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেশাদার মঞ্চের প্রভুদের কাছে ঘুরতে ঘুরতে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল কেন? শিশির ভাদুড়ীর মত নাট্য পুরুষরা তারাশংকরকে অবহেলা করেছিলেন কেন? ইংল্যান্ডের দিকে যদি তাকানো যায়, সেখানেও দেখা গেছে বর্নার্ড শ এর মত মানুষকেও সে যুগের পেশাদার মঞ্চে মঞ্চে নিজের নাটক ফেরি করতে গিয়ে হতাশ হতে হয়েছিল কেন? ইবসেনের মত নাট্যকাররাও নিজেদের সময় যথেষ্ট মূল্য পাননি কেন?
তারাশঙ্করের মত আরো অনেক মানুষকে হতাশ হয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্য মাধ্যমগুলোতে বিচরণ করতে হয়েছিল। একদিক থেকে এটা ভালোই হয়েছিল। তারাশঙ্কর, বনফুল, প্রমথনাথ বিশী এমন অনেক নাম রয়েছে যারা সেসময়ের বাংলা থিয়েটারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথকেও বাংলা থিয়েটার চূড়ান্ত ভাবে অবহেলা করেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেসময়ের বাংলা থিয়েটারের দৈনতার চেহারা বড়ই নির্মম। পাবলিক থিয়েটারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি নিজেই নিজের নাটকগুলোকে মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্র নাটকের জনপ্রিয়তা আজও কি দেখতে পাওয়া যায়? নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে পাবলিক থিয়েটার একরকম বর্জন করেছিল।
পঞ্চাশের দশকের গ্রুপ থিয়েটার রবীন্দ্রনাথকে মাঝেমধ্যে গ্রহণ করলেও, তখনো তাঁরা ধুয়া তুলেছিলেন যে, উন্নত মানের বাংলা নাটক লেখা হচ্ছে না। তাই তাঁরা ইউরোপের তৃতীয় শ্রেণীর নাটকগুলো বাংলায় প্রচলন করার চেষ্টা করেছিলেন। এঁরা বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়দেরও পাত্তা দেয়নি। এই অভিযোগ স্বয়ং উৎপল দত্তের। তিনি নিজে রবীন্দ্রনাথ, বার্নাড শ, শেক্সপিয়ার প্রযোজনা করবার পর নিজেই কলম ধরেছিলেন। এবং বাংলা থিয়েটারকে শক্তিশালী নাটক উপহার দিতে পেরেছিলেন। যে বাংলা থিয়েটার শেক্সপিয়ারের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই বাংলা থিয়েটারে ষাটের দশকের রথী মহারথীরা ঘোষণা করেছিলেন , শেক্সপিয়ার বাতিল। শেক্সপিয়ারের নাকি বর্তমান সময়কে চেনা যায় না। আরো অনেক অবাঞ্ছিত কথাবার্তা তাঁরা বলতেন। ব্রেখটকে আমদানি করা হলো স্রেফ বৈচিত্রের খোঁজে। ব্রেখটের রাজনৈতিক দর্শন না বুঝে হাস্যকর কান্ড কারখানা বাংলা থিয়েটারের আমরা ঘটতে দেখেছি। ব্রেখট বিশেষজ্ঞ উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়রা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়রা যা করছেন সেগুলো ব্রেখট নয়!
পাবলিক থিয়েটার চিরকাল বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাটক নির্বাচন করেছেন। জনগণের রুচির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। বক্স অফিসের দিকে তাকিয়ে সস্তা, লঘু, এমনকি তৃতীয় শ্রেণীর নাটক বছরের পর বছর মঞ্চস্থ করেছেন। বাংলা থিয়েটারের অবনমন ঘটিয়েছেন। সুস্থ রুচির, শক্তিশালী নাট্যকাররা তাঁদের কাছে বিভীষিকার মত ছিল। বাংলা কথাসাহিত্যের দিকপালরা কখনো নাটক লিখতে উৎসাহিত হতেন না। কারণ তাঁরা জানতেন, তাঁদের নাটক গৃহীত হবে না।
উৎপল দত্তের মতো আরো দুই একজন পরিচালক গিরিশ ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, অমৃতলাল বসুদের নাটক মঞ্চস্থ করে প্রমাণ করেছিলেন, যে বাংলায় ভালো নাটক চিরকাল কম লেখা হলেও লেখা হয়েছে। সেই সব নাটক যত্ন নিয়ে প্রযোজনা করলে দর্শকের আশীর্বাদ লাভ করা যায়। মন্মথ রায় তাঁর নিজের যুগে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। যেমন জনপ্রিয় ছিলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। এঁদের নাটক আমরা অস্বীকার করতে পারি কি?
গ্রুপ থিয়েটারের আরেকটি প্রবাহ ষাটের দশকের পর থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। যেখানে মূলত ছোট বা একাঙ্ক নাটক নিয়ে চর্চা হতো। অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, আশির দশকের পর থেকে এখানেও আরেক ধরনের বাজারি মনোভাব গড়ে উঠেছিল। এই বাজার হল প্রতিযোগিতা মঞ্চে পুরস্কার পাবার এবং কল শো শিকার করবার কৌশল। প্রথমদিকে এই নাটকগুলো বামপন্থী রাজনীতির প্রচারমূলক হয়ে উঠেছিল। গণনাট্য সংঘের ধারায় দলীয় রাজনীতির পরাকাষ্ঠা দেখা যেত। বামপন্থী সরকারের আগমনের পরে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার জোঁয়ার ভাটার টানে সংকুচিত হতে শুরু করল। রাজ্য সরকারের কৃপা লাভের দিকে অনেকেই গা ভাসিয়ে দিলেন। এঁরা কর্পোরেট মিডিয়ার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত। এখানে মূলত একেবারে তরুণ দের আগমন ঘটেছিল। যাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাট্যকর্মী মূলত ছিলেন আবেগপ্রবণ। বিশ্বনাট্য , ভারতীয় নাটক, এমনকি বাংলা নাটকের ইতিহাস না জেনেই এঁরা কাজে নেমে পড়েছিল। যথাযথ থিয়েটার শিক্ষা এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে ছিলনা। আজও নেই। কলকাতা কেন্দ্রিক এলিট থিয়েটারের দাদাদের নকল করার দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। এরা স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখট, পিস কাটর, বোয়ালদের নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। এখানে গোর্কি , চেখভ, বার্নাড শ , ইবসেন, বা বিশ্বের তাবড় তাবড় নাট্যকারের নাটক নিয়ে খুব একটা চর্চা করেনা।
এদের মধ্যে গভীরতর রাজনৈতিক বিশ্বাস, নন্দনতত্ত্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চর্চা বা চিরায়ত নাট্যসাহিত্য নিয়ে অনবরত গবেষণা করার বিষয়টা অনুভূত হয় না। যখন যে নাট্যকার প্রতিযোগিতা মঞ্চে পুরস্কার পাওয়ার প্রতিযোগিতা স্পেশাল নাটক দিতে পেরেছেন, সেই নাট্যকার কে মাথায় তুলে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে দেখা গেছে যে বাম জমানায় বামেদের প্রচারযন্ত্র যেসব নাট্যকারকে মূল্য দিয়েছে, সেইসব নাট্যকারদের প্রতিষ্ঠা এসেছে। দেখা গেছে যে, প্রকৃত অর্থে গুণি নাট্যকারদের সরে যেতে হয়েছে। কারণ তাঁরা প্রতিযোগিতার জন্য স্পেশাল নাটক লিখতে প্রস্তুত ছিলেন না।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এ কথা বলতে পারি যে, বিভিন্ন দলের রুচি, চাহিদা বিভিন্ন রকম। পরিচালকরাও নাটক নির্বাচন করতে গিয়ে জনরুচির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। পরিচালকদের দক্ষতা, রুচি , বিশ্বাস এক্ষেত্রে বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। দক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রীর অভাব ও অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। বহু দল ও পরিচালকের মুখে শুনেছি, দাদা আপনার লেখা নাটকটি খুবই ভালো। কিন্তু সাধারণ দর্শক বুঝতে পারবে না। অনেকবার শুনেছি, এত কঠিন কঠিন নাটক লেখেন কেন? এমন সব বিষয় আপনার নাটকে উঠে আসে যা আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। আমরা দাদা একটু সহজ নাটক, একটু হালকা নাটক পছন্দ করি।
প্রতিযোগিতা মঞ্চে বিচারকরাও অনেকে আমাকে বলেছেন, আপনার নাটক আসলে প্রতিযোগিতা মঞ্চের জন্য নয়। কলকাতার বড় বড় দলের জন্য। শিক্ষিত দর্শকদের জন্য। বেদনার সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, প্রতিযোগিতার মঞ্চ কেন্দ্রিক ছোট নাটকের সর্বনাশের মূলে রয়েছে অযোগ্য বিচারক মন্ডলী। আধুনিক থিয়েটারের বিন্দু বিসর্গ না জানা, নাট্যসাহিত্য মন্থন না করা জ্যাঠামশাই বৃন্দ এক ধরনের তরল বাংলা একাঙ্ক নাটকের জন্ম দিয়ে গেছেন।
উন্নত মানের নাটক গল্প কবিতা ইত্যাদি সৃষ্টির জন্য উর্বরা জমির প্রয়োজন। বন্ধ্যা জমিতে উন্নত ফলনশীল চাষের জন্য আবাদ করবার কোন প্রচেষ্টা কি আমরা দেখেছি? প্রতিভাবান নাট্যকারের জন্য আমাদের কি করণীয় সেটা কি আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি? উৎকৃষ্ট নাটক বৃষ্টির মত আকাশ থেকে কি বর্ষিত হয়? নতুন যুগ নতুন সময় নতুন মানুষ নতুন ভাষা গড়ে ওঠে। আমাদের নাটকের দল, নাট্যকর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদি পেছনে পড়ে থাকেন, আর দাবি করেন কেন ভালো নাটক লেখা হচ্ছে না, সেটা কি সঙ্গত দাবী হয়ে ওঠে? আপনি নিজেই তো প্রস্তুত নন! আপনি নিজেই জানেন না কাকে বলে ভালো নাটক! আপনি পরিচালক হিসেবে বছরের পর বছর তরল বস্তাপঁচা নাটক নিয়ে পথে চলেছেন। আপনি নিজে কখনো কি ক্লাসিক নাটক মঞ্চস্থ করার সাহস দেখিয়েছেন? স্বাধীনতার আগে এবং পরে আশির দশক পর্যন্ত অসংখ্য উন্নত মানের নাটক রচনা হয়েছে যার সন্ধান আপনি কি রাখেন?
বিগত পনেরো বছরে কেন ভালো নাটকের আকাল পড়ল, থিয়েটার চর্চা তলানিতে এসে ঠেকেছে, এসবের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কারণগুলো আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন? এর মধ্যেও যেসব নাট্যকার বর্তমান সময়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছেন, আপনি কি তাঁদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন? বাজার অর্থনীতি সমাজের সমস্ত দিকগুলোকে গিলে ফেলেছে। মানুষের মস্তিষ্কে দখল নিয়েছে কর্পোরেট মিডিয়ার আগ্রাসন। ভালো নাটকের জন্য জমি তৈরি করুন। দুর্বার সাহসের পরিচয় রাখুন। দেখবেন হাতের কাছে অনেক উন্নত মানের নাটক পাওয়া যাচ্ছে। নীলদর্পণ, বঙ্গে বর্গী, আলমগীর, বিসর্জন, রক্তকরবী, চাক ভাঙা মধু, কল্লোল, টিনের তলোয়ার, ইত্যাদি নাটকের জন্ম সম্ভব হয়েছিল সেই সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলন ও লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে। আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে ভারতের সবচেয়ে বড় দুঃসময়ের প্রেক্ষাপটেও সৃষ্টি থমকে গেছে। শিল্পীদের কালি কলম শুকিয়ে গেছে। আজ আর কেউ বাংলার প্রাচীন কবিদের মতো বলেনা, আমি আঙুল কাটিয়া কলম বানাই চোখের জল কালি।
অত্যন্ত আধুনিক এবং জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক।