চেহারাটা সবার মধ্যে থাকলেও নজর কাড়ে। গায়ের রং শ্যামবর্ণ, চওড়া বুকের ছাতি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। মেদহীন পেটাই শরীর। বাসুদেব ভাল্লার কথাই বলছি। একজন রায়বেঁশে শিল্পীর যা যা গুণ থাকার দরকার সবটাই তাঁর আছে।
রায়বেঁশে বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি প্রাচীন মাধ্যম। রাজা মানসিংহের ফৌজ এই নৃত্য করতে করতেই শত্রুদের আক্রমণে এগিয়ে যেতো। বাসুদেব জানালেন, রায়বেঁশে দুই ধরনের। একটি রায়বেঁশে নৃত্য, অন্যটি রায়বেঁশে যুদ্ধ নৃত্য। শরীরের নানা কসরত রায়বেঁশেকে বাংলা লোকনৃত্যে একটা বিশেষ জায়গা দিয়েছে। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান সংলগ্ন এলাকায় রায়বেঁশের চলন অনেকদিন ধরেই রয়েছে।
লোকশিল্পী শিবরাম প্রামাণিকের মতে, ‘রায়’ মানে বড়ো ও বেঁশে অর্থাৎ বাঁশ থেকে যা তৈরি। একে ঘিরেই শারীরিক কসরত ও নানা ব্যায়ামই রায়বেঁশে। ‘আয়রে দশবিশে, চল্লিশে ছিয়াল্লিশে ভয় কি সে?’ দামামার তালে তালে হেলে দুলে এই শিল্পীরা রায়বেঁশের কসরত দেখান। কখনো তাঁরা মুখে আওয়াজ তুলে শত্রুর উদ্দেশ্যে ফরমান জারি করেন। বীরভূমে গুরুসদয় দত্ত যখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তখন তাঁরই প্রচেষ্টায় রায়বেঁশে বাংলার মাটিতে প্রাণ পায়। প্রায় দুই হাজার মানুষ নিয়ে ছোট্ট একটি গ্রাম সাহোড়া। এটি মুর্শিদাবাদ জেলায়। এখানেই থাকেন বাসুদেব। অভাব তাঁকে বেশি পড়াশোনা করতে দেয়নি। গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লাঠি খেলা ও শারীরিক নানা কসরত, ব্যায়াম তাঁকে উৎসাহিত করে। তাঁর বাবা-ঠাকুরদাকে এ গ্রামের জমিদাররা নিজেদের রক্ষাকর্তা হিসেবে আনেন। সেই সূত্র ধরেই বাসুদেবের রক্তে বইছে রায়বেঁশে। জ্যাঠামশাই এর কাছে প্রথম শুরু। তারপর গ্রামের দীনদাস বৈরাগ্যের কাছে যোগব্যায়াম শিক্ষা। এরই মধ্যে রায়বেঁশের ইতিহাস তাঁকে আরো বেশি করে এই মাধ্যমটিতে আকর্ষিত করে।
দীনদাস তাঁকে নিয়ে যান রায়বেঁশে শিল্পী স্বাধীন বিশ্বাসের কাছে। বেশ কিছু বছর চলল রায়বেঁশের মহড়া। গুরু স্বাধীন বিশ্বাস-ই তাঁকে দল গড়তে বলেন। সাহোড়া রায়বেঁশে যুব গোষ্ঠী। রায়বেঁশের প্রাথমিক বা মূল যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সেটি একটি সুস্থ সবল শরীর। শরীরকে সুঠাম রাখার জন্য, সতেজ রাখার জন্য চাই সুষম খাবার। প্রত্যন্ত গ্রামের এইসব মানুষ কোথায় পাবে সেই পথ্য? জমি জায়গা চাষবাসে খরচ দিনদিন বেড়েই চলেছে। বাসুদেব জানালেন, সংস্কৃতির টানে ঠিক-ঠাকভাবে জমিতেও সময় দিতে পারছেন না। আবার জমিতে কাজ না করলে সংসারও চলবে না। একটা দোটানায় চলছে তাঁর জীবন। তবু শিল্পকে শুধু ভালোবেসে বিনা পারিশ্রমিকে নতুন ছেলেদের তিনি রায়বেঁশের নানা মারপ্যাঁচ শেখাচ্ছেন। ‘পয়সা কোথায় পাবে আমার এই গ্রামের ছেলেরা, যে তাদের শিখিয়ে আমি পয়সা নেবো?’ এই সরল আপাদমস্তক শিল্পী মানুষটাকে শতকোটি প্রণাম।
নিভৃতে, সবার আড়ালে শুধু রায়বেঁশেকে তুলে ধরার জন্য এই সাধক সাধনা করে চলেছেন। উদ্দেশ্য একটাই আরো নতুন নতুন দল হবে যাঁরা রায়বেঁশেকে বাংলা লোকআঙ্গিককে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যাবে। তবে এখন সরকারের প্রশ্রয় যে রায়বেঁশে শিল্পীদের উৎসাহ দিচ্ছে একথা জানালেন বাসুদেব।
এভাবেই বীরভূমের আলয় পণ্ডিত, বর্ধমানের দুঃখহরণ পণ্ডিত একান্ত নিজস্ব প্রচেষ্টায় এই মাধ্যমটিকে ভালোবেসে কাজ করে চলেছেন। ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকা এই লোকশিল্পটির এখন খানিকটা অস্তিত্বের সংকট। জমিদারদের যুদ্ধবাহিনীর এটি একটি অংশ ছিলো। সেই জমিদার প্রথাও আজ অস্তাচলে, সেই লাঠিয়াল বাহিনীও। কিন্তু রায়বেঁশেকে ভালোবেসে দারিদ্রকে হেলায় হারিয়ে মাধ্যমটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে আজও কিছু মানুষ লড়াই করে চলেছেন। মানুষকে আনন্দ দিতে তাঁরা প্রস্তুত। হোক শত কষ্ট বাঁচার। রায়বেঁশেতে তার কোন আঁচড় লাগবে না। এই তাঁদের পণ।
অত্যন্ত জরুরি লেখা। জয় হোক।