বিরহ | অসীম দাস

চাইলে একা অভিনয় হতে পারে আবার – লোকটা, পুরোহিত, টহলদার ও অন্যান্য চরিত্র মিলে করা যেতে পারে।

মন্দির প্রাঙ্গণ। হতে পারে রাধা মাধবের মন্দির, পর্দা উঠলে দেখা যাবে সেখানে সন্ধ্যা আরতি চলছে। একটা লোক (বয়সঃ ৩৫, অশিক্ষিত। পরনে লুঙ্গি, হাফ হাতা জামা) প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে।

ভক্তরা তখন গাইতে থাকে — “বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা”…

মাঠ – ঘাট বাগানের ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে মন্দির চাতালের বাইরে দাঁড়ায় লোকটা। প্রচন্ড হাঁপাতে থাকে, একটু দাঁড়িয়ে জিড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে। প্রধান পূজারীকে ঘন্টা বাজিয়ে আরতি করতে দেখা যায় , অন্যান্যরা শঙ্খ, কাঁসর, ঢোল করতাল বাজাতে থাকে।

লোকটা – (ফ্রন্ট স্টেজে দেখা যায় লোকটাকে) যাক বাবা, কেউ তাহলে আমায় দেখতে নি। সেই দুপুর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বড্ড খিদে পেয়েছে। সব সহ্য করা যায় কিন্তু খিদে, তাকে কিছুতেই বোঝানো যায়না। (গানটা আবার জোড়ে শোনা যায়) ওই তো মন্দিরে ঠাকুরের নাম গান হচ্ছে বোধহয়! না যাই, যদি সেখানে একটু খাবার দাবার পাওয়া যায় !

(কীর্তনের আওয়াজ আগের থেকে আরও বাড়ে, লোকটা ধীরে ধীরে সবার পেছনে এসে গামছাটা পায়ের কাছে জড়িয়ে দেয়াল ঘেঁসে বসে পড়ে। যাতে লুঙ্গিটা দেখা না যায়। বসে পড়তেই একটু পর লোকটার ঘুম জড়িয়ে আসে দু’চোখে। কখন কীর্তন শেষ হয়ে গেছে খেয়াল নেই তার। প্রসাদ নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেছে। পুরোহিত প্রসাদ নিতে ডাকে, সাড়া না দিলে ধাক্কা দেয় লোকটাকে)— এই যে, কইগো, ঘুমিয়ে পরলে যে, প্রসাদ— নাও, ধরো — !

লোকটা – পোসাদ? (অবাক হয়) ও পোসাদ, দিন, (হাত বাড়ায়) আরেকটু হয়না? (হাতটা বাড়িয়ে রাখে তারপর সরিয়ে নেয়, প্রসাদ খেয়ে নিয়ে গায়ে মুছে নেয়) আচ্ছা ঠিক আছে, (স্বগত বলে) পেটে যে এক সমুদ্র খিদে! এইটুকুতে কি কিছু হয়! (ধীরে ধীরে মন্দির ফাঁকা হয়ে যায়। গামছাটা কোমরে কাপড়ের মত পড়া ছিল। এবার গামছাটা খুলে ঝেড়ে মুছে মন্দিরের চাতালে বসে)

যাক, কেউ তাহলে আমাকে চিনতে পারেনি, বুঝতেও পারেনি, আমি যে জাতে মুসলমান! এই মন্দিরে আমি তো দেবতার পোসাদ খেলাম — তাতে কি আমার জাত চলে গেল? আমি কি কাফের হয়ে গেলাম? তা আবার হয় নাকি? আচ্ছা, তুমিতো হিন্দুদের ভগবান — সত্যিই কি জাত বলে কিছু হয়? এই যে আমারই গ্রামের লোকেরা আমায় মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে — দেখো ভগবান — দেখো — এইযে আমার হাত দুটো —সারা গা — এই যে দেখো — কুঞ্চির দাগ, — শালারা মেরে কি হাল করেছে আমার (ডান হাত দিয়ে বাম হাতে ছুঁয়ে দেখে, ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে) উফ কি ব্যথা! — কারে দেখাই? (নিজের কপাল চাপড়ে) তোমারও তো একই অবস্থা ঠাকুর — তোমারও তো প্রাণ নেই, তুমি তো পাথর — তা না হলে এই মহামারির দিনে আমার বন্ধু নিতাই, সে কেনো কাজ খুঁইয়ে না খেতে পেয়ে মরতে বসেছে ? — তার কি দোষ বল? — তার তো তোমার নামেই নাম– নরহরি — (খিল খিলিয়ে হাসে) সব জানি গো — সব জানি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থে যেমন লেখা আছে জানি — তেমনি কোরান, হাদিসে তাই লেখা আছে ! কি ঠিক বলিনি! — ও আল্লা বলো, আর ভগবান , তলে তলে সব ব্যাটাই এক ! যত মরণ এই ছোটলোকদের — আমার মত গরিবদের — জানো, আমাকে আমাদের ওই মৌলবী সাহেব — মসজিদের গো — বড় বড় দাঁড়ি রাখতে বলেছিল — দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তে বলেছিল — হুমকি দিয়েছিল — হিন্দুদের ঠাকুর দেবতার গান গাইবিনা —।

আমিও মুখের ওপর বলে দিয়েছি — শুনবোনা আপনার কোনো ফতোয়া — আমার মন যা চায় আমি তাই করবো — কারো কথা শুনবো না। আমার কোনো জাত নেই — আমি মানুষ — মানুষের আবার কি জাত গো!—-

(মন্দির বন্ধ করছে পুরোহিত, আলো কমে এসেছে মন্দিরের)

রাত হয়ে গেছে, শুনশান চারিদিক। ওই মন্দিরের চাতাল ফাঁকা হয়ে গেল। (চারিদিক ভালো করে দেখে)

মন্দিরের দরজায় তালাও পড়ে গেল। এই যে ঠাকুরমশাই, ঠাকুর মশাই — শোনেন না —শুনছেন (চিৎকার করে ডেকে ওঠে) না, শুনলো না, — আমার স্ব- জাতির লোকেরাই শুনলো না, আর তো অন্যরা– যাক গিয়ে — (তাচ্ছিল্যের সুরে) এই ভিন গাঁয়ের ঠাকুর মন্দিরের চাতালে না হয় আজকের রাতটা কাটিয়ে দেবোক্ষণ — তারপর ভোর হবার আগেই — আবার বেড়িয়ে পড়তে হবে যে —- কিন্তু কোথায় যাবো —? কি করবো? খাবো কি? চারিদিকে যে মহামারি — হাজারে হাজারে মানুষ মরছে — কাজ নেই — লোকে খেতে পারছে না — আমার কাছে যে একটাও পয়সা নেই — যা ছিল ওই হারামির বাচ্চারা কেড়ে- কুঁড়ে নিয়ে নিয়েছে —
তেষ্টা পেয়েছে বড়ো — একটু পাণী অথবা একটু জল — জল-পাণী –যা হোক একটা কিছু হলেই হতো — (এদিক ওদিক খোঁজে, কিছুই পায় না) কি আর করা যাবে — কোথায় আর খুঁজব, গামছাটা গায়ে দিয়ে এই চাতালেই শুয়ে পড়ি — সারা গা, হাত দুটো বিষের মতো ব্যাথা — জানি, আমার এ কষ্ট শোনার কেউ নেই —

(পেছন মুখ করে মাথা থেকে পাছা পর্যন্ত যতটুকু ঢাকা গেছে গামছা দিয়ে, বাদবাকি লুঙ্গিটুকু দেখা যায় লোকটার। শুতে শুতেই ক্লান্তিতে ঘুম এসে যায়)

(রাতের টহলদার লাঠি হাতে আসে, অনেকটা পথ হেঁটে আসছে , বয়স্ক অবাঙালি মানুষ, নিজের মনেই বকতে থাকে সে)

টহলদার – জাগতে রহো — জাগতে রহো — শালা, কইভি নেহি — চারিতরপ্ শুনশান —৷ চোর ভি কাহাসে আয়েগা! করুনাকে লিয়ে পুরে দেশমে লোকডাউন মানারাহা হ্যায় সব লোক — সবটা ছুট্টি হ্যায় লেকিন মেরা কই ছুট্টি নেহি হ্যায়! কেয়া ভগবান — সব আকেলা ঘরমে! — হামভি আকেলা — আপ ভি আকেলা। ক্যায়াক্যারে, মজবুর হু ম্যায়, পাপি পেটকা সওয়াল — (নিজের সব পকেট খোঁজে) খইনিভি নেহি সাথমে! — রাস্তামে কই মিলযাতা, তো আচ্ছা হোতা —

(চাতালের উপর বসতে যায়। কিছু একটা চোখে পড়ে, চক্ষু স্থির হয়ে যায় লোকটাকে শোয়া দেখে)

আরে, মন্দিরকি সিঁড়িপে কোই আদমি সোইয়া হুয়া লাগতা হ্যায়? হাঁ, সাহি তো —- (নিচু হয়ে দেখে) লুঙ্গি প্যাহেনকে সোইয়া হুয়া লাগতা হ্যায়? ইয়ে কন্ হো সাকতা হ্যাই? লুঙ্গি প্যাহেনা হুয়া শালা মুসলমান তো নেহি — ! নেহি তো ক্যায়া — লাগতা তো হ্যায় ! হে কৃষাণ ভগবান— ক্ষমা করো — আপকা মন্দির অচ্ছুৎ করদিয়া হ্যায়? শালা — (বলেই হাতের বড় লাঠিটা দিয়ে স্ব- জোরে মাথা লক্ষ্য করে বসিয়ে দেয়)

( চিৎকার করে ওঠে লোকটা, ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে, মাথা ফেটে রক্ত বের হয় মানুষের)

লোকটা – আঃ, আঃ — রক্ত, ইশ-শ্, তুমি আমারে মারলে? আম্মাগো কি যন্ত্রণা — ! রক্তে ভেসে যাচ্ছে দুই হাত — (ভগবানের দিকে হাত দেখিয়ে) দেখো ভগবান, লাল রক্ত — (টহলদারকে দেখায়)

টহলদার – তু শালা মুসলমান হ্যায় না? তেরেকো ম্যায় দেখা হু মোল্লাপাড়া মে, তু মুসলমান হোকে হামারা মন্দিরপে শোয়া হুয়া, ইতনা হিম্মত —!

লোকটা – আমি মুসলমান হই আর হিন্দু হই, না দেখে না শুনে, একটা নিরপরাধ মানুষকে এই দুর্দিনে এভাবে মেড়ে মাথা ফাটিয়ে দিলে? এই কি মানুষের পরিচয়? তোমার কি কাকা একবারও হাত কেঁপে উঠলো না ?

টহলদার – ফির মু লড়াকে বাত করতা হ্যাই মেরে সাথ ?

লোকটা – তুমি কি জানো আমি কত অসহায় ? আমার নিজের গ্রামে ঠাঁই নেই — তোমাদের গ্রামেও ঠাঁই নেই — তবে কি আমার কোথাও ঠাঁই নেই —? আমার এ বিরহ শোনার কি তবে কেউ নেই —? হে আল্লা — হে ভগবান — ! দেখো — কত অসহায় আমি —, কত অসহায় — (গামছা মাথায় চেপে ধরে কাঁদতে থাকে)

টহলদার – আভি ইহাসে ভাগ, নেহি তো —

লোকটা – চলে যাচ্ছি — এক্ষুণি চলে যাচ্ছি —, আমি সেখানেই যাবো — যেখানে সত্যিকারের মানুষ বাস করে — যেখানে ধর্ম নেই — উঁচু নিচু ভেদাভেদ নেই — রক্ত নিয়ে খেলা নেই — জাতপাত নিয়ে হানাহানি নেই — সেখানেই আমি মানানসই ! —

টহলদার – (বুঝতে পারে তার ভুল হয়েছে, অনুতপ্ত হতে দেখা যায়।)
(লোকটা মিডল ডিপ স্টেজের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সাইক্লোরামায় বড় আরও বড় হতে দেখা যায়, আবহ সঙ্গীত বেজে ওঠে নেপথ্যে)

“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে ”

নমস্কার

One thought on “বিরহ | অসীম দাস

  1. এত ছোট পরিসরে এত স্পষ্ট মায়াময় সুন্দর একটা লেখা— বেশ লাগলো পড়তে—

Comments are closed.