দীপা ব্রহ্ম
শরৎচন্দ্রের মেজদার নিয়ম-নিষ্ঠার সেই সন্ধ্যেটা আজও আমাদের কৈশোর ছুঁয়ে যায়। এই গল্পে শ্রীনাথ বহুরূপীর হঠাৎ আগমন যে কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিয়েছিল তা আমরা এখনও যেন দেখতে পাই। বহুরূপীদের কাজই এমনতর। অবিকল হয়ে ওঠার মধ্যে তাঁদের বাঁচা। তাই না সেদিন মেজদার ওই দশা হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে বাড়ির পাশে ঝোপের মধ্যে এতো বড়ো একটা বাঘের মুখ দেখে। আমাদের কিশোর মনে ওই বহুরুপীকে ঘিরে কত যে প্রশ্ন ছিল। সেই সব অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন পৌঁছে গেলাম বীরভূম জেলার বিষয়পুর গ্রামে। কথা হলো বহুরূপী শিল্পী উত্তম মণ্ডলের সঙ্গে। মুর্শিদাবাদ জেলার ভাস্তর থেকে এক ব্রাহ্মণ এখানে এই অঞ্চলে এসে ওর বাবা জ্যাঠাদের বহুরূপী সাজে উৎসাহিত করেন। বাতলিয়ে দেন বহুরূপী প্রদর্শনের নানা প্যাঁচ পয়জারও। সেই শুরু। তারপর এ গ্রামের প্রায় ঘরে ঘরে বহু বহুরূপী শিল্পী রয়েছেন।
উত্তমবাবু বললেন, বহুরূপী সাজতে তাঁর খুব ভালো লাগে। তাই নিজেকে নানারূপে সাজান। অচেনা গ্রামে গিয়ে মানুষকে আনন্দ দেন। মনের কথা জানান। তাঁরাও তাঁর আত্মীয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু শুধু আনন্দ দিলেই হবে না। পেটেও তো দিতে হবে। তাই পাশাপাশি চাষবাসও করতে হয় তাঁকে। আবার যখন অচিন গ্রাম থেকে ডাক আসে সংসারের বেড় ছেড়ে ছুটে, মন বলে পালাই পালাই। প্রত্যন্ত গ্রামে নানা সাজে সেজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হরেক সংলাপ আওড়ে যান অবলীলায়। কখনও কালীমাতা, কখনও কৃষ্ণ , কখনও শিব, কখনও চেয়ারে বসা হঠাৎ বাবু, কখনও সামাজিক ব্যাধিমুক্তির শ্লোগানে মুখর হন। অবসরে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত পড়ে, জেনে নিজেকে তৈরি রাখেন উত্তম বহুরূপী।
একই অঙ্গে অনেকরূপ দেখতে যখন ছেলে বুড়োরা ঘিরে ধরে, তারও আনন্দ আর ধরে না। সাজের সঙ্গে সংলাপ ও তখন গলগল করে বেরিয়ে আসে। দিনের পর দিন ভিন গ্রামে অস্থায়ী ডেরায় থেকে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। লক্ষ্য একটাই মানুষকে আনন্দ দেওয়া। দিন সাতেক খুব খুশি হলে তার পরে ঘরে ফেরার পালা। যাওয়ার আগে নন্দ ঘোষ বা গোয়ালিনীর বেশে গ্রামের বউ ঝি-দের থেকে পাওনা গণ্ডা বুঝে নেওয়া। এ বড়ো আজব কায়দা, পয়সা উপার্জনের।
উত্তমবাবুরা একসঙ্গে ছয়জন কাজ করেন। তবে উনিই দলপতি। বাবা বিজয় কুমার মণ্ডলের কাছ থেকে তিনি গান শিখেছেন। প্রায় চল্লিশ রকম পোষাক আছে তার সাজার
জন্য। মেকাপ টিউব, পাউডার, জিংক অক্সাইড, ভূসাফালি, সিঁদুর, মিনারঙ দিয়েই সাধারণত তিনি নিজেকে সাজান। পশ্চিমবাংলায় তো বটেই। বাংলার বাইরেও এই শিল্প মাধ্যমটি ছড়িয়ে আছে। উত্তমবাবুর ছেলেও এখন এই শিল্পে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এভাবেই বিষয়পুরের সনাতন চৌধুরী ব্যাধ, সুকুমার চৌধুরী ব্যাধ, সাঁইথিয়ার রবি সাহারা মানুষকে অকৃত্রিম আনন্দ দিয়ে থাকেন নানারূপে নিজেদের প্রকাশের মাধ্যমে। কিন্তু উত্তম মণ্ডল আক্ষেপ করে বলেন, নতুন যাঁরা সাজছেন তাঁদের বোধহয় আরও পোক্ত হতে হবে। পড়াশোনা আর বয়স উপযুক্ত না হলে কখনোই ভালো বহুরূপী হওয়া যাবে না। আসলে দেশ ও দশের সম্পর্কে ধারণাটা স্বচ্ছ থাকা দরকার।
তুচ্ছ অর্থের মায়ায় যেন এই মাধ্যমটির শিল্পমূল্য নষ্ট না হয়ে যায়। আমি যে অঞ্চলে থাকি, সেখানে আমাদের নাট্যমেলায় আর এক বহুরূপীর সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের আলাপ। তিনি সুবলদাস বৈরাগ্য। ওঁর মুখেই শুনি ছোটোবেলায় তিনি যাত্রা করতেন ও ফিমেল সাজতেন। তারপর শ্রীনাথ বহুরূপীর গল্প এই মাধ্যমে যুক্ত করায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করে।
ছোটোবেলায় নানা চড়াই-উৎড়াই তাঁর জীবনকে খাঁটি সোনা করে গড়ে তোলে। সুবল দাস এখন বৈষ্ণব সুবল দাস বৈরাগ্য। এক ছন্নছাড়া ভিন্ন জীবন তাঁকে শেখায় মানুষকে আনন্দ দিতে। কত চোখের জল চোখে রেখেই বোধহয় দেশকাল জয় করে পৃথিবীর দূর সীমা আমেরিকাতেও তিনি বাংলার এই লোকমাধ্যমটিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমেরিকার সরকার তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন। জার্মানি, রাশিয়াতেও গেছেন তিনি। কিন্তু একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। মানুষটার এতটুকু দম্ভ নেই। এখানে যখনই মেলায় আসবার কথা বলা হয়েছে ঠিক সময় মতো উপস্থিত হয়ে গেছেন। থাকা-খাওয়ার কোনো চাহিদা নেই। নিজের মতো করে থেকেছেন। আর ঠিক ঠিক সময়ে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে স্থানীয় মানুষদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অর্ধনারীশ্বর সাজ ও অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করে, মাটি-মুখী মানুষটির প্রতিটি অভিনয়ে সংলাপের শব্দচয়ন আমাকে বিস্মিত করে। নজরুল-রবি সাজের মধ্যে অনেক বড়ো একটি বার্তা তিনি দিয়ে যান। বারবার দেখেও মন ভরে না। এটাই বোধ হয় বহুরূপী শিল্পের জাদু। তাঁর গুরুর থেকে শেখা এই মোহিনীবিদ্যা ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার জেলায় জেলায়, অনামী জনপদে।
শেষে বলি —
সজ্জায় হয়ে ওঠো কখনও পুরুষ কখনও নারী।
রবি কবির আলোয় মাতিয়ে ভুবন করো তাঁরি।।
দুখু মিঞার দীপ্ত কন্ঠ স্পষ্ট তোমার বচনে। দিনদয়ালের স্বপ্নে সাজো, গুরুর গুরু তাঁরেই ভালো।
নমি তোমায় আরো সবায় ধাত্রীদেবের চরণে। প্রণাম -সালাম একসঙ্গে কও প্রকৃত মানুষ হওয়ার কারণে।
অনেক অজানা বাংলার লোকশিল্পের রঙ নিয়ে দীপাদির লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছি,জানছি অনেক কিছু।