মীরাবাঈ- নারী মনের বিষন্ন চুপকথা | ব্রতীন রায়

১৯৬০ সালে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘মীরাবাঈ’ পাঁচ কিংবা ছয়ের দশকের ঝঞ্ঝাময় সময় বিম্ব; সন্দীপনী উদ্ভাষে চিত্রিত তৎকালীন কোন মফঃস্বল জীবনের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মেটাফর। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অশোকনগরের ‘অমল আলো ‘ নামক সুগঠিত একান্ত নাট্যাঙ্গনের আলো আঁধারিতে বসে ওই সময়ের ছেদযতি চিহ্ন সমেত একটা অধ্যায়কে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ করে দেয় ক্যানডিড থিয়েটার প্রযোজিত, সুদীপ্ত ভূঁইয়া পরিচালিত উক্ত গল্পের নাট্যরূপ। একজন নারীর গল্প ‘ মীরাবাঈ’ যিনি রূপে, প্রগলভতায় এবং শৃঙ্গারে সাতটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার পরও আকর্ষণীয়, গ্লানিহীন অমলিন। প্রতিদিন সকালে স্নানঘরে তিনি ধুয়ে ফেলেন সব ক্লেদ, লাল পাড়ের শ্বেত বসনে জড়িয়ে নেন মায়াবী কুহুক। অথবা ‘মীরাবাঈ’ তৎকালীন (নিশ্চিতভাবে বর্তমানেরও) সামাজিক আবহে নারীর অবদমিত আকাঙ্খা , অসম্মানের প্রতীকী রূপায়ণ, ক্ষয়িষ্ণু পুরুষতান্ত্রিক যৌথ পরিবার কাঠামো তথা পাড়া কালচারের বিপন্ন অবয়ব। হয়তো ‘মীরাবাঈ’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজের অনিশ্চয়তা, সংশয়, ক্ষীয়মান শীতল দীর্ঘশ্বাসের আবর্তে খাঁচার পাখির মত হাফিয়ে ওঠা জীবন এবং সেই জীবন ঘিরে আবর্তিত হওয়া কালো গরম ভালোবাসা। কিম্বা সতীত্বের যে আর্কিটাইপ চাপিয়ে দেওয়া হয় নারীর দেহ ও মনে, ‘মীরাবাঈ’ তার এক করুণ আয়রণি। সন্দীপনের অপ্রথাগত ন্যারেটিভ ভেঙে যে সংলাপ বা নৈঃশব্দ তৈরি করেছেন সুদীপ্ত তার মধ্যে তিনি নিপুণ দক্ষতায় বুনে দিয়েছেন এর সবকটি পরত। অন্তরঙ্গের ঘনিষ্ঠ নরম অন্ধকারে বসে দর্শক হিসেবে উপলব্ধি করি অমল আলোর উদ্ভাষ যা অতীতদর্শী।

‘মিনিম্যালিস্টিক থিয়েটার’ সফল উৎক্ষেপণ লক্ষ্য করা যায় এই নাটকের গঠন ও চলনে। দর্শকের সাথে অনুভূমিক থেকেও সে লাভ করে নান্দনিক উচ্চতা যেখানে প্রকৃত শিল্পের বিচরণ। একটি মোমবাতি, উচুঁ দাঁড় আর দুটি চাবুক ছাড়া প্রপস বলতে আর কিছুই নেই। নিরাভরণ অভিনয়স্থল এবং কাহিনীর অনুচ্চারিত দ্যোতনা বাহী আবহ সঙ্গীতের (সঙ্গীত: তমাল মুখোপাধ্যায়, গান নির্বাচন: প্রিয়ঙ্কর দে) সাহচর্যে নাটকটি গল্পের সব মোচড়, সুক্ষতায় মোড়া রূপককে ছুঁয়ে যায়। মীরা বৌদির দ্বিমাত্রিক বিনির্মাণ যেন তার মনের খণ্ডিত সত্ত্বার প্রতিনিধিত্ব করে। গল্পের কথকের দিদি ও মীরা বউদির কথোপকথন এবং তাদের পারস্পরিক চরিত্রবদলের মধ্যে দিয়ে দর্শক যেমন মূল গল্পের নির্যাসকে পেয়ে যায়, তেমনই স্পর্শ করে চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘এন্যুই’ য়ের অন্তরমনকে। মীরা বৌদির সাদা বিছানার চাদরে বিশেদার লিখে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ (“যতবার আলো জ্বালাতে চাই/নিবে যায় বারে বারে/ আমার জীবনে তোমার আসন/গভীর অন্ধকারে।”) শুধু গোপন অভিসারের মুহ্যমান স্মারক নয়, এই গল্পহীন গল্পের আত্মভূমি যেটিকে সঠিক বিশ্লেষণে মূর্ত করেছেন নির্দেশক। ওই দুই চরিত্রে মৌমিতা ভূঁইয়া ও চিত্রা সাহার বাচিক এবং শারীরিক অভিনয়, সঙ্গে সুদীপ্তর মর্মভেদী ভয়েসওভার নাটকের উজ্জ্বল দীপ্তি যা পূর্ণতা দেয় নাট্যে এবং গল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন রূপকল্পের। পারেক সাহেবের উচ্চগ্রামের প্রলাপ ‘দরজা খোল’এর অনুরণন সমান্তরাল রেললাইনের ওপর দিয়ে আওয়াজ করে ধাবমান মালগাড়ির মত নিষ্পেষিত করে মীরাবাইয়ের তনুমন। আর তার রেশ ছড়িয়ে যায় দর্শকমনেও। তবে এ ধরনের তন্নিষ্ঠ প্রযোজনা আরো প্রাণবন্ত হতে পারে সরাসরি গানের তৎসহ বাদনযন্ত্রের প্রয়োগ প্রক্ষেপণের মাধ্যমে। মাননীয় নির্দেশক, একটু ভাবতে পারেন!

নাটক: মীরাবাঈ
মূল রচনা: সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের
প্রযোজনা: ক্যানডিড থিয়েটার
পরিচালনা: সুদীপ্ত ভূঁইয়া

One thought on “মীরাবাঈ- নারী মনের বিষন্ন চুপকথা | ব্রতীন রায়

  1. খুব ভালো রিভিউ লিখেছেন ব্রতীন।
    নাটকটি দেখার ইচ্ছে রইলো।

Comments are closed.