চক্রব্যূহ | পিয়াল ভট্টাচার্য

[একটা থানার ইন্টারোগেশন রুম। টেবিলের সামনে বসে আছেন মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক। হাত মুখ বাঁধা। নাম মানব বিশ্বাস। সিভিল ড্রেসে পুলিশ বিপ্লব কর এসে মানবের মুখ হাত খুলে দেয়। মানব হাঁপাতে থাকে।]

বিপ্লব – জল খাবেন?

(মানব ঘাড় নাড়ে, বিপ্লব জল দেয়। এক গ্লাস জল খায় মানব।)

বিপ্লব – আর এক গ্লাস দেবো ? (মানব ঘাড় নাড়ে। বিপ্লব আরও এক গ্লাস জল দেয়। এটাও এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মানব।)

বিপ্লব – আর ?

মানব – না, আমায় কতক্ষণ এভাবে আটকে রাখবেন আপনারা ?

বিপ্লব – স্যার আসবেন, প্রশ্ন করবেন, তারপর স্যার যা সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনাকে আটকে রাখা হবে না ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি কিছু জানি না।

মানব – কিন্তু আমায় এভাবে আটকে রাখার কারণ কী? গত দু-দিন ধরে তো আমি বলেই চলেছি যে আমি খুন করিনি। এমন কী খুনের বিষয়ও আমি কিচ্ছু জানি না।

বিপ্লব – ঠিক আছে। আপনি এগুলো স্যারকে বলবেন। স্যার যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই ফাইনাল। এই বিপ্লব করের হাত পা বাঁধা ওপর মহলের কাছে।

মানব – কিন্তু আমি যখন অপরাধী নই, তখন কেন আমি অন্যের ডিসিশান মানবো? যেখানে অপরাধের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগই নেই।

বিপ্লব – আপনি কি মানবেন না মানবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। আমরা স্যারের অর্ডার বুঝি। আপনাকে যখন আমি গ্রেফতার করি, তখন খুনের actual spot থেকে আপনার distance ছিল ৩০ মিটার। আপনার জামায় লেগেছিল রক্তের ছিটে, ছুরিটা পড়েছিল আপনার বাঁ পাশে। সেই অবস্থায় আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছিলেন।

মানব – এতে কী করে প্রমাণ হয় আমি খুনি? এই ছুরিতে কী আমার finger print পাওয়া গেছে? আর আমি যদি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েই থাকি, তাহলে murder এর স্পটে কেন ঘুমোবো? আপনি একবার ভাবুন, পৃথিবীতে কোনো অপরাধী কি খুনের ছুরি পাশে রেখে, রক্ত মাখা জামা পরে, স্পটে ঘুমোতে পারে? আপনার logic কি এই equation টা মেলাতে পারছে?

বিপ্লব – দেখুন, মানব বাবু – আপনার শুরুতেই একটা ভুল হচ্ছে। আপনাকে কেউ আমরা অপরাধী বলছি না, আপনি অভিযুক্ত, সন্দেহভাজন। তাই এ ধরনের লোককে বন্দী করে, তাকে জেরা করে যাচাই করার প্রভিসন আমাদের যথেষ্ট আছে। দুই, আমি লজিক দিয়ে কিছু আনাল্যসিস করি না। এটা আমার কাজের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। আমি বড়জোর আপনাকে অপরাধী হিসেবে assume করতে পারি, ব্যাস।

মানব – assume ! আন্দাজ! আপনার আন্দাজ ভুলও তো হতে পারে ?

বিপ্লব – পারে, hundred present পারে।

মানব – তাহলে ? তাহলে এই ভাবে একজনকে হ্যারাস করার কি মানে? আগে নিজেরা স্যাঙ্গুইন হন। তারপর তাকে এরেস্ট করুন। আচ্ছা, বলুন তো আপনার ইনডিসিশানের জন্য আমি বা আর পাঁচজন মানুষ কেন সাফার করবে ?

বিপ্লব – আবারও আপনার ভুল হচ্ছে। আপনি এখন আর পাঁচজন মানুষ নন, আপনি সন্দেহভাজন।

মানব – দেখুন, আপনাকে আমি একবার বলি, আপনি সবটা বুঝবেন। বিশ্বাস করুন, এই খুনটার বিষয়ে আমি কিছু জানতাম না। আমি ওকে মানে, যিনি মার্ডার হয়েছেন তাকে চিনতাম ও না। সত্যি বলছি। সেদিন একটু বেশি অ্যালকোহল ইনটেক করেছিলাম। বার থেকে যখন বেরোই তখন প্রায় রাত বারোটা বেজে গেছিল, প্রথমে ভেবেছিলাম, কিছু হবে না, আগেও তো বহুবার এভাবে বাড়ি ফিরেছি। নিজের মতো করে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিছুদূর যেতেই পা- টা বড্ড টলছিল, শরীরের ব্যালান্স রাখতে অসুবিধা হচ্ছিল। সামনে হঠাৎ পার্কের বেঞ্চটা চোখে পড়ে। মনে হয়েছিল ওখানে কিছুক্ষণ জিড়িয়ে নেশাটা একটু কাটাই। কিন্তু কখন যে নেশার ঘোরে দুচোখে ঘুম জড়িয়ে এল, কখন যে আমি পার্কের বেঞ্চটায় টানটান করে শুয়ে পড়েছিলাম— বিশ্বাস করুন, কিছু মনে নেই। কে কাকে কখন খুন করে আমার জামায় রক্ত ছিটিয়ে ছুরিটা পাশে রেখে চলে গেছিল—কিচ্ছু বুঝতে পারি নি। ঘুম ভাঙার পর দেখলাম আপনি সামনে দাঁড়িয়ে—

বিপ্লব – আমাকে দেখে কি আপনি ভয় পেয়ে গেছিলেন ? ভূত টুত ভেবেছিলেন নাকি ? তা হতে পারে, আমায় এখন কম বেশি সকলেই ভূত ভাবে। শালা আমার কপালটা দেখুন। আমার প্রকৃত পরিচয়ে কেউ ভয় পায় না, অথচ বিপ্লব ভূত বা ভূত বিপ্লব ভেবে আঁতকে ওঠে। যাগ গে, আমায় এসব বলে লাভ নেই, যা বলার স্যারকে বলবেন।

মানব – আশ্চর্য ! আপনি তো কিছু শুনতেই চাইছেন না, বুঝতেও চাইছেন না। দেখুন বিপ্লব বাবু— আপনি যদি আমার ব্যাপারটা, আপনার ওই অনুমানটা স্যারকে বলেন– আমার মনে হয় উনি আমায় অ্যাটলিস্ট সন্দেহ করবেন না, আমার কথাগুলো খুব নিরপেক্ষ ভাবে শুনবেন—

বিপ্লব – হাসালেন মশাই, ওই ধনপতি সরকার নিরপেক্ষ হয়ে এই মানব বিশ্বাস এর কথা
শুনবেন ! আপনি কোন জগতে বাস করেন ?

মানব – কে ধনপতি সরকার !

[ধনপতি র প্রবেশ]

ধনপতি – আমি — আমিই ধনপতি সরকার।

মানব – আপনাকে আমার চেনা লাগছে কেন?

ধনপতি – কারোর মুখের সাথে মিল পাচ্ছেন হয়তো। বা আগে কোথাও দেখেছেন— আপনার কাছে পরে আসছি, একটু বিপ্লবকে সালটে নিই। ও বেচারার অনেক কাজ। আবার অন্য কোথাও অন্য কাউকে ধরতে যেতে হবে। সত্যি বিপ্লব— তুমি শুধু ধরা ছোঁয়া করেই গেলে, প্রমোশন আর পেলে না।

বিপ্লব – কপাল স্যার, শুধু দৌড়েই গেলাম। আমার বোধহয় গ্রহচক্রে দোষ আছে। আজ পর্যন্ত আমার কোনো কিছুই ফ্রুটফুল হলো না। তার আগেই কেমন যেন সব বাইফারবেট হয়ে যায়—

ধনপতি – যাই হোক, বেসিক কথাগুলো কি তোমার সাথে ওনার হয়েছে?

বিপ্লব – হ্যাঁ স্যার, তবে উনি সব কিছুই তো ডিনাই করছেন।

ধনপতি – কী মানব বাবু ! আপনি বিপ্লবের সাথে সামান্য সহবস্থান করতে পারলেন না। এতে হয়তো আপনার ভালোই হত। আমি যদি এবার আপনার উত্তর জানার জন্য আপনাকে প্রশ্ন করতেই থাকি, আপনার স্বীকারোক্তি পাবার জন্য যদি ওই লকআপের অন্ধকারে ঢুকিয়ে থার্ড ডিগ্রী দিই—তখন কিন্তু কিছু বলতে পারবেন না। এই হচ্ছে আপনাদের সমস্যা। আপনারা কো-অপারেটও করবেন না, আবার সামান্য উনিশ বিশ হলে চিৎকার করে বলবেন এই সিস্টেমটাই নাকি পুরো রুড, ব্রুটাল, হার্টলেস। খুনটা করেছিলেন কেন?

মানব – আমি কতবার বলবো, আমি খুন করি নি। ইভেন যে ইন্সিডেন্টটা হয়েছে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। ওই মৃত মানুষটাকে আমি চিনতামও না। আমি তো ওনাকে সব বলেছি।

ধনপতি – এবার আমায় বলুন। আবার, শুরু থেকে—

মানব – দেখুন স্যার, আমি ওনাকে—

ধনপতি – আহ– বিপ্লবের পালা শেষ হয়ে গেছে। বিপ্লব, তুমি যাও। মানব বিশ্বাস— আপনি এবার ধনপতি সরকারের মুখোমুখি। বলুন। ঠিক আছে শুরুটা আমিই করছি। আপনার বয়ান অনুযায়ী আপনি প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত বারে বসে মদ্যপান করেছেন। আপনি কি নিয়মিতই নেশা করেন এইভাবে?

মানব – মাঝে মাঝে, যখন কিছু ভালো লাগে না-তখন নেশা করি।

ধনপতি – বাড়িতে কে কে আছে আপনার?

মানব – কেউ নেই। আমি একা।

ধনপতি – স্ট্রেঞ্জ! বিয়ে করেন নি কেন? আচ্ছা বিয়ে নয় নাই করলেন, প্রেমিকা-টেমিকাও কেউ নেই! ( মানব মাথা নীচু করে বসে থাকেন ) – সময় কাটান কী করে? এইভাবে নেশা করে —?

মানব – না, নেশা বলতে শুধু মদ নয়— আমি টিভি দেখি, খবর শুনি, সিরিয়াল, ফেসবুক, শেয়ার বাজারের ওঠাপড়া দেখি, তারপর আমি বিভিন্ন কালচারাল, সোশ্যাল অরগানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত আছি, সময় কেটে যায়— তবে, এসব যখন আর কিচ্ছু ভালো লাগে না, তখন ওই একটু— সেদিন কেন অতটা খেয়েছিলাম জানিনা– বিশ্বাস করুন স্যার, আমি খুন করিনি।

ধনপতি – সেটা পরের কথা, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। বার থেকে বেরোনোর পর আপনি ঠিক কী কী করেছিলেন? পর পর বলুন।

মানব – বারোটার একটু আগে ওয়েটার এসে বলে স্যার বার ক্লোজ হবে, আমি বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসি। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি ।

ধনপতি – হাঁটতে থাকেন কেন? ট্যাক্সি বা কোনো ক্যাব তো নিতেই পারতেন।

মানব – হ্যাঁ, হয়তো পারতাম। ম্যাক্সিমাম দিন ট্যাক্সিই ধরি। সেদিন কেন হেঁটেছিলাম— জানি
না।

ধনপতি – বুঝলাম। তা পার্কের বেঞ্চিতে হঠাৎ গেলেন কেন?

মানব – পা টলছিল, হাঁটতে পারছিলাম না। বেঞ্চটা দেখে মনে হয়েছিল একটু জিড়িয়ে নিই—

ধনপতি – স্ট্রেঞ্জ! আপনি যে বার থেকে বেরিয়েছিলেন, সেই বার থেকে পার্কের ডিস্ট্যান্স কতটা জানেন তো? প্রায় তিনশো মিটার। তা অতখানি টলতে টলতে আসার পর আপনার হঠাৎ মনে পড়লো যে আপনার পা টলছে, আপনি আর হাঁটতে পারছেন না।

মানব – হ্যাঁ স্যার। সত্যি বলছি।

ধনপতি – কেসটা কেমন হল বলুন দেখি— তিনশো মিটার আপনি হেঁটে এলেন। তখন একবারও মনে হল না কিছু, একটা বেঞ্চ দেখে এই রকম উৎকট রিয়ালাইজেশান! তাও আবার দুম করে। বলছি বিশ্বাস বাবু, এটা বিশ্বাস করতে কেমন একটা খটকা লাগছে না!

মানব – স্যার, আমরা কম বেশি তো সকলেই কোনো কিছুর মধ্যে ঢুকে পড়ি, আর মাঝপথে গিয়েই রিয়ালাইজ করি আগের কাজ বা সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। তারপর থেমে যাই। মানুষের ধর্ম স্যার এটা।

ধনপতি – কেয়া বাত! এ রকম দুম করে ফিলোজফিক্যাল হওয়াও কিন্তু মানুষেরই ধর্ম। কিন্তু কী জানেন তো, বাস্তবের প্রশ্নচিহ্নের সামনে আপনাদের এই তত্ত্ব কথা মাঝে মাঝেই ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

মানব – আমার কিন্তু সত্যিই ওই বেঞ্চটা (দেখে—)

ধনপতি – বেশ– । এবার আমি বলি। একজন মানুষ যদি ঘন্টায় দশ কিলোমিটার স্পীডেও হাঁটে, তাহলে তার তিনশো মিটার হাঁটতে সময় লাগা উচিত কম বেশি আঠেরো মিনিট– ইনটক্সিকেটেড হলে আরো বেশি লাগবে, ধরুন তিরিশ মিনিট। রাত বারোটায় বার থেকে আপনি হাঁটতে শুরু করলেন। ট্যাক্সি নিলেন না। কারণ কোনো সাক্ষী রইলো না, গাড়ির আওয়াজ রইলো না। আপনার কথা মতো চিত্ত দাসের মিস্টার জ্ঞানকুমারকে মেরে ফেলার কথা ছিল বারোটা পঁচিশের মধ্যে। আপনি সাড়ে বারোটা নাগাদ গিয়ে চিত্ত দাসের হাতে টাকাটা দিয়ে জ্ঞানকুমারের লাশটা দেখে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরার প্ল্যান করেছিলেন। পার্কের মধ্যে মাঝরাতে মাতাল, পাতাখোরেরা নেশা করতে আসে। আপনিও মাতাল হয়েই ঢুকেছেন। যদি দু’চারজন কেউ দেখেও ফেলে, তার ওই গতে বাঁধা ধারণাই করবে, সন্দেহ বিশেষ করে খুনের সন্দেহ কেউই করবে না। তাই আপনি সুন্দরভাবে বেছে নিলেন পার্কের লোকেশন। কিন্তু গিয়ে দেখলেন চিত্ত ব্যাটা তখনও জ্ঞানকুমারকে মারেনি। ফলে, চিত্তের থেকে ছুরিটা নিয়ে আপনিই বসিয়ে দিলেন জ্ঞানের পেটে। কিন্তু আপনি জানতেন না সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বিপ্লব মাঝে মাঝে টহলে বেরোয়। বিপ্লবের সাইরেন শুনে চিত্ত পালিয়ে গেলেও আপনি পালাতে পারলেন না, তাই মাতাল হয়ে ঘুমের অভিনয় করার চেষ্টা করতে লাগলেন। শুধু তাড়াহুড়ো করে রক্তমাখা জামাটা আর ছুরিটা সরাতে পারলেন না। প্ল্যানটা ভালোই ছিল—কিন্তু ওই, অপরাধী তার চিহ্ন ফেলে যায়—

মানব – আপনি কী লেখক? যদি লেখক হন, তাহলে বলবো থ্রিলার গল্প লেখক হিসেবে খুবই কাঁচা—।

ধনপতি – কেন বলুন তো। বিশ্বাসবাবুর কি এটা বিশ্বাস হল না! সমস্যাটা কোথায় লাগলো?

মানব – জ্ঞানকুমার খুন হয়েছেন, মানে যে খুন হয়েছে তার নাম যে জ্ঞানকুমার— জানলেন কোত্থেকে?

ধনপতি – আরে মশাই, আমি ধনপতি সরকার— এত বছর ইনভেসটিগেশন লাইনে আছি— আর কে কোথায় মরে গেল, মরার নাম জানবো না!

মানব – আপনি যদি সবই জানেন, তবে আমায় ইন্টারোগেট করছেন কেন?

ধনপতি – সত্যিটা জানার জন্য। মানে আমি যা বললাম, সেটাকেই সত্যি বলে আপনি সায় দিচ্ছেন কিনা, সেটা বোঝার জন্য—

মানব – দিতে পারছি কই– খটকা লাগছে। যদি বা ধরে নিই আপনার গল্পটাই সত্যি, আমিই খুনি। খুন হবার পর আপনি মৃত জ্ঞানকুমারের নাম জানলেন, কিন্তু ওই যে আরেকটা লোকের নাম বললেন, চিত্ত দাস না কে !— তাকে যে আমিই খুন করতে সুপারি দিয়েছি, আপনি জানলেন কোত্থেকে? যদি চিত্ত দাস ধরা পড়ে, আর চিত্ত যদি আমার নাম বলেই দেয়— তাহলে আমাকে এতদিন আটকে রাখা, জেরা করাটা তো একটা ফার্স হচ্ছে— তাই না। বললাম না, আপনি থ্রিলার গল্প লেখক হিসেবে খুব কাঁচা।

ধনপতি – পয়েন্ট, আপনার বুদ্ধি আছে মানব বাবু। এই মিডিয়া, সোশাল মিডিয়া আমার লেখা নিয়ে এত ভালো কথা লিখে ফেলেছে, পুরষ্কার-ফুরষ্কার এত দিয়ে দিয়েছে— নিজেকে বেশ একটা নামজাদা পাক্কা লেখক বলেই ভাবতে শুরু করেছিলাম। নাহ, বেসিক জায়গাতেই দেখছি সমস্যা আছে। মানতে হচ্ছে আম পাবলিকের মধ্যে এখনো কিছু পার্সেন্ট সেন্স আর কালচারাল সেন্স– দুটোই বেঁচে আছে।

মানব – ওটুকু যে কজন বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তারাই তো আপনার বন্ধু হতে পেরেছে নাকি! নাহলে বাকিরা তো সবাই আপনার—

ধনপতি – কতদিন গোলামচোর খেলিনি, এই রকম টেবিলে বসলেই তাস খেলার কথা মনে পড়ে যায়। এই নিন, সিগারেট খান।

মানব – এবার একটু ঝেড়ে কাশুন তো— কেসটা কী!

ধনপতি – আরে, ওই শালা জ্ঞানকুমার, আমার অ্যান্টিলবি ছিল। আমার এগেইনস্টে একটা দল- তৈরী করছিল। ওর টার্গেট ছিল আমায় সরানোর, সরিয়ে আমার জায়গায় বসা। দেখলে বুঝতে পারবেন না বাইরেটা কি সিম্পল, ভেতরে ভেতরে বিরাট লোভ— ক্ষমতার। আমি ভদ্দরলোকের মতো প্রস্তাব দিলাম, বন্ধুত্বের হাতও বাড়ালাম। শুনলো না। তখন এই বিপ্লব আর চিত্ত বললো এসব জ্ঞান ফ্যানকে শুধু শুধু প্রশ্রয় দিয়ে লাভ নেই, সরিয়ে ফেলতে। বুকে হাত দিয়ে বলছি, না খোঁচালে এই ধনপতি সরকার কারুর কোনো ক্ষতি করেনি। আমি নির্ঝঞ্ঝাট, শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমার মুখ দেখলে বলুন, একবারও মনে হয় আমি খুনি। আমি মানুষকে বাবু, প্রিয়, মিত্র ছাড়া সম্বোধন করি না।

মানব – ধ্যুর মশাই, যা-তা বলবেন আর আমি মেনে নেবো? এই তো আমি, আপনার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আপনি আমার গায়ে খুনির তকমা লাগাননি? আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেননি?

ধনপতি – আরে মানব বাবু, কো ল্যাটারাল ড্যামেজ কথাটার মানে জানেন? আমার তো একটা সেফগার্ড দরকার ছিল। ভুলবশত সেটা আপনার ওপর এসে পড়েছে। আমি তো ভুল স্বীকার করে আপনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছি নাকি! ওই হারামজাদা জ্ঞান- কুমারের খুনের দায় কাউকে তো নিতে হবে!

মানব – তা বলে আমি কেন?

ধনপতি – আরে মশাই, তখন আপনি ছাড়া কে ছিল বলুন তো হাতের কাছে? প্লাস এটা তো বুঝতে হবে, ঘুমন্ত মানুষ হচ্ছে ইম্পলিমেন্টেশনের বেস্ট মিডিয়াম। যাগগে বাদ দিন এবার একটা জব্বর প্ল্যান দিন তো দেখি, এই পুরো কেসটা গুটোনোর— না হলে শুধু শুধু আপনাকে এর দায় নিতে হবে। আমি তো হেল্পলেস, আমার দিকটা একটু বুঝুন।

মানব – দেখুন আপনি চাইলে আমাকে মেরে ফেলতেই পারেন, আমাকে এই খুনের দায় নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলতেও বলতে পারেন— কিন্তু তাতে করে কি এই কেসটা পুরো গুটিয়ে যাবে? যাবে না, দেখুন আমি আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মতো— আপনার পজিশন ছোঁয়ার সামান্য ক্ষমতাও আমার নেই। একটু চাপ দিন কি একটু সুবিধে— আমি আপনার হয়ে হাত তুলে দেবো। কিন্তু এই বিপ্লব আর এই চিত্ত, মনে রাখবেন ওরা কিন্তু আপনার সাবঅর্ডিনেট। ওরা যদি মনে করে, তাহলে ওরা প্যাকড হয়ে আপনার বিরুদ্ধে কনস্পিরেসি করতেই পারে। আরে এই খুনের ব্যাপারে কিন্তু ওরা সব কিছু জানে। বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। আর একজনকে সরান। হয় বিপ্লব নয় চিত্ত। একটা গেলেই দেখবেন আরেকটা সুড়সুড়– (হাসি)

ধনপতি – হুম, মন্দ বলেন নি।

মানব – তাহলে ওই কথাই রইলো ধনপতি বাবু, আমি উঠি, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগলো—

ধনপতি – আরে মশাই, এতো তাড়া কীসের? একটু হিসেবটা সাজিয়ে নিতে দিন। আমি যে খুনি এটা জানে ক’জন? আপনি, বিপ্লব, আর চিত্ত। তার মানে চিত্ত আর বিপ্লবের মধ্যে একটাকে সরালে আরেকজনের কিন্তু আপনার সঙ্গে গাঁঠবাঁধার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে, টু ইজটু ওয়ান।

মানব – আমি! আমি তো বলেই দিলাম, আমি খুব সাধারণ, আম আদমি।

ধনপতি – ওটাই তো চিন্তার, আম আদমি বহুত অপারচুনিস্ট হয়। তার চেয়ে আমি একটা প্ল্যান দিই দেখুন তো কেমন লাগে। আমি যদি তিনজনের মধ্যে দুটোকে সরিয়ে দিই, একটাকে কন্ট্রোলে আনা কোনো ব্যাপার নয়। এবার কোন দুজন? একটা খেলা খেলি চলুন তো। আমি এই কাঁচের গ্লাসটা টেবিলে রেখে ঘুরিয়ে দেবো, আপনি বলতে থাকবেন, মানব বিপ্লব চিত্ত, চিত্ত, বিপ্লব, মানব— যার নামে গিয়ে গ্লাসটা থামবে সে বেঁচে যাবে। চলুন, আমি গ্লাসটা ঘুরিয়ে যাই— আপনি বলতে থাকুন।

(ধনপতি গ্লাস ঘোরায়, গ্লাস ঘুরতে থাকে। মানব চুপ করে বসে থাকে।)

ধনপতি – আরে চুপ কেন? বলুন। নিন আবার শুরু থেকে শুরু করছি।

(নাটকটি অভিনয়ের পূর্বে নাট্যকারের অনুমতির প্রয়োজন।)

নমস্কার

2 thoughts on “চক্রব্যূহ | পিয়াল ভট্টাচার্য

  1. টানটান ছেট নাটকের প্লট, অনেক বিজনেস আছে। শর্ট ফিল্মও খুব ভালো হতে পারে। সাসপেন্স আছে।
    পিয়ালদা এগিয়ে চলুন।

Comments are closed.