ছবির কথা – প্রমিতা ভৌমিক

Chobir Katha

বর্ষার এক সন্ধেতে ছবি তৈরির অভিজ্ঞতা ও ভাবনা নিয়ে কিছু কথা লেখার একটা প্রস্তাব আসে হঠাৎ। প্রথমে কিছুটা অবাক হই। কারণ এই কাজের জগতে আমি নেহাতই নতুন। কীভাবে, কী কথা কতটুকু বলব— সেটা বুঝে ওঠার আগেই লেখা দিতে সম্মত হয়ে যাই। তাই কোন কথা কতটা কেমনভাবে লিখব— সেটা না ভেবে লিখতেও শুরু করে দিই।

প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, খুব ছোট থেকে ফিল্ম বানানোর কথা আমি ভাবিনি। কলেজে পড়িয়েছি, গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করেছি, কবিতা লিখেছি, গল্প লিখেছি, ছবি তুলেছি, পাহাড়ে-সমুদ্রে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি, নির্জন যাপনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি দীর্ঘ সময়। কিন্তু কোথাও একটা ছবি তৈরির আগ্রহ, উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত তাড়া করে চলেছিল আমাকে। যে কথা বলতে চাই, যেভাবে বলতে চাই, তা কবিতা, গল্প, গদ্যের মাধ্যমে বলে উঠতে পারছিলাম না। যেভাবে প্রকাশ করতে চাই নিজেকে, তা পেরে উঠছিলাম না। আমার ভাবনা, আমার তৈরি করা চরিত্ররা ছবির মত ফুটে উঠছিল এবং তাদেরকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে। আমি যেভাবে দেখছি, সেভাবেই তাদের তুলে ধরতে ইচ্ছে করছিল ক্রমশ। ইতিমধ্যে একটা কাব্যনাটক লিখি, মনোলগ লিখি। তারপর ধীরে ধীরে মনে হয়; আমার ভাবনা, আমার চিন্তাস্রোতকে ফিল্ম মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরার কথা।

খুব ছোট থেকে প্রচুর ফিল্ম দেখার অভিজ্ঞতা ছিল। আমাদের বাড়িতে ছবি দেখার একটা পরিবেশ ছিল এবং সেই সূত্রে নানা ধরনের ফিল্ম দেখার সুযোগ পেয়েছি বরাবর। ছবি তুলতে ভালবাসতাম; তাই ক্যামেরা, লেন্স সংক্রান্ত একটা ধারণা ছিল। কিন্তু একটা ছবি বানানোর জন্য যে প্রথাগত শিক্ষা প্রয়োজন, তা ছিল না। যেটুকু কাজ করেছি এবং করছি— তার সবটাই কাজ করতে করতে শেখা। যাকে বলা যায় self taught। কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে, ভুল শুধরেছি, আবার সেই কাজ ঠিক করেছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। এক দশকের বেশি সময় ধরে যেসব কবিতা লিখেছি, একসময় তাকে ছবির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করার ইচ্ছে প্রবল হতে থাকে। সেখান থেকে আমারই একটা দীর্ঘকবিতা নিয়ে তৈরি করি পোয়েট্রি ফিল্ম। করি একটা শর্ট ডকুমেন্টারি ফিল্ম। তারপর শর্ট ফিল্ম। এখন একটা ফিচার ফিল্ম তৈরির কথা ভাবছি এবং কাজ এগোচ্ছি।

প্রথম শর্ট ফিকশনের কাজ— ‘পরিচয়’। ‘পরিচয়’-এর হাত ধরে পরিচয় ঘটে গেছে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে। এই ছোট ছবি আসলে মেয়েদের আত্মপরিচয় খোঁজার গল্প। একজন গৃহবধূ এবং একজন সম্পূর্ণ অন্যধরনের পেশায় থাকা নারীর জীবনের একদিনের গল্প। একেবারে বিপরীত মেরুতে বাঁচা দুজন মানুষ এখানে ফিরে তাকায় একে অপরের দিকে এবং নিজের দিকে। এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী এবং কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুজনেই স্বনামধন্য অভিনেত্রী। অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং অসামান্য অভিনয় দক্ষতা তাঁদের। দুজনেই কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন, নানা পরামর্শ দিয়েছেন। ওঁদের সহায়তা ছাড়া এই কাজ কখনওই সম্ভব হত না। এছাড়া ছিল ছোট্ট শিল্পী সহচরী। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও বেশ মজার। ‘পরিচয়’ আজ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত হয়েছে এবং পুরস্কৃত হয়েছে। এর কৃতিত্ব ছবির অভিনেত্রী এবং সমস্ত কলাকুশলীদের।

এই লেখা যখন লিখতে বলা হয় আমাকে, তখন বিশেষভাবে শর্ট ফিল্মে সুদীপ্তাদির (চক্রবর্তী) সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছিল। এই সম্পর্কে লিখতে গেলে আসলে বলতে হবে অনেকটা। যেদিন প্রথম সুদীপ্তাদির বাড়িতে যাই ছবির স্ক্রিপ্ট শোনাতে, সেই অভিজ্ঞতা সত্যিই এক অন্য অনুভবের। এর আগে পর্যন্ত আমি কোনওদিন কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীকে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাইনি। এটাই আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা এবং তা ঘটে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে— এটা সত্যিই সৌভাগ্যের। একবার স্ক্রিপ্ট শুনেই কাজ করতে রাজি হন সুদীপ্তাদি এবং জানান, এর আগে তিনি কোনও শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেননি। কাজের শুরু থেকে কখনও আমাকে বুঝতে দেননি যে, আমি নতুন কাজ করছি। প্রত্যেকটা শটের শেষে আমার দিকে তাকিয়ে যখন বলতেন— ‘ঠিক আছে?’; তখন আমি ভাবতাম, এত বড় মাপের অভিনেত্রীকে শট ঠিক আছে বলার যোগ্য হয়ে উঠেছি কিনা!

আমি স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ে বিশ্বাসী। একটা দৃশ্যে একটা চরিত্রের কাছ থেকে আমি কী চাইছি, কতটা চাইছি— সেটা বলে দিতাম। তারপর অভিনেতা ক্রমশ চরিত্র হয়ে উঠতেন। এটা একটা প্রক্রিয়া। এখানে একজন পরিচালকের যতটা ‘ইনপুট’ থাকে, ততটাই থাকে অভিনেতা-অভিনেত্রীর। আসলে এই পুরো কাজটা খুব আন্তরিকভাবে, আনন্দের সঙ্গে করেছি আমরা। শুধুমাত্র পেশাগতভাবে নয়, কোথাও একটা মনের টান এবং যোগ ছিল ইউনিটের সকলের। আর এই যোগটা না থাকলে কখনও কোনও কাজ সফল হতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস।

‘ছবির কথা’ নিয়ে লিখতে বসে মনে হচ্ছে, আসলে এটা ছবি শুরুর কথা। একটা জার্নির সূচনা। জীবন এমন একটা পথ, যেখানে নানা ধরনের, নানামুখী যাত্রা লেখা থাকে। মানুষ তার মত করে হেঁটে যায় সেই পথ। নিজের খেয়ালে চলতে চলতে কখনও থমকে দাঁড়ায়, কখনও বাঁকবদল করে, কখনও বা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আমার কাছে ফিল্ম মেকিং একটা ‘জার্নি’, একটা ‘যাপন’। একেবারে ভাল লাগা, ভালবাসা এবং নিজেকে প্রকাশ করার তাগিদে এই পথে এসে পড়া, এই পথে হেঁটে চলা। আর পথ চলতে গেলে কাঁকর-নুড়ি-পাথর, আঘাত-অনিশ্চয়তা-অসহায়তা থাকবে— সে কথা কে না জানে! তবে সৃষ্টির ভেতরে যে ‘আনন্দ’ জমা হয়ে থাকে, তা চিরন্তন, তা শাশ্বত। তবু শেষ পর্যন্ত এই পথচলাতেই ‘আনন্দ’।