দীপা ব্রহ্ম
যে জেলাগুলোতে লালমাটি ছুঁয়ে আছে, সেই অঞ্চলগুলোই আদিবাসী অধ্যুষিত। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া লাগোয়া এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যে গোটা দুর্গাপুজো জুড়ে একটা নাচ খুবই প্রচলিত। নাচটি হল ‘দাসাই’। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের পথে পথে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত রাস্তা জুড়ে এঁরা নাচেন। মূলত এটা একটা যুদ্ধ নাচ। মাথায় ময়ূরের পালক দিয়ে পুরুষরাই এ নাচে অংশ নেন। এবার পুজোয় পুরুলিয়ায় থাকার সুবাদে হঠাৎ নবমীর দিনে পুরুলিয়ার ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এলাকা গড়জয়পুর বাজারে এ নাচ দেখলাম। কথাও হল এ নাচের দলের সর্বজ্যেষ্ঠ নেতা নন্দ মুর্মুর সঙ্গে। অযোধ্যা পাহাড়ের আগে একটা আমে তাঁদের বাস। তিনি বললেন, এ নাচের নাম ‘দশই মঞ্জুরা’। লক্ষ্য করলাম ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে কী সুন্দর পা ফেলে ফেলে একদল কিশোর দাসাই নাচ পরিবেশন করছে। কখনও দলটি এগিয়ে যাচ্ছে আবার তালে তালে পিছিয়ে যাচ্ছে। মাদল, ধামসা, বড়ো করতাল নিয়ে মাথায় জম্পেস পাগড়ি বেঁধে তাঁরা নেচে চলেছেন। কারো হাতে রয়েছে লাঠি। পরনের রঙিন কাপড়গুলো হয়তো বা তাঁদের মা-কাকিমাদের।
এই নাচের একটা অদ্ভূত ইতিহাস আছে। দাসাই আদিবাসী ভাষায় একটা মাসকে নির্দিষ্ট করে। বাংলা ক্যালেন্ডারের আশ্বিনই হলো সেই মাস। এই নাচের মাধ্যমে এঁরা এঁদের দেবতা ‘হুদুর দুর্গা’কে খুঁজে বেড়ান। এই নাচ মুলত আর্যদের বিরুদ্ধে অনার্যদের জেহাদের নাচ। সুকৌশলে চাতুরি করে আর্যরা হুদুর দুর্গাকে মেরে ফেলেন। এই সময়টাকেই তাই এঁরা এই নাচের জন্য বেছে নিয়েছেন। দশমীতে তাঁদের দেবতাকে মেরে ফেলা হয়। একটি তুলসী তলায় থান তৈরি করে সেখানে এ নাচ হোত। একে ‘মাঝি থান’ বলা হয়। এখানে তিন দেবতার নামে তিনটে পাথর রেখে পুজো দেওয়া হয়। আগে যখন জঙ্গলে ঘেরা ছিল প্রান্তর, তখন এই নাচের মাধ্যমেই ওষধি গাছ-গাছালি সংগ্রহ করার রীতির প্রচলন ছিল। সেই সংগ্রহ এখন বদল হয়েছে দ্রব্য, অর্থ সংগ্রহে।
অরণ্যের অভাবে অরণ্যের মানুষজন নেমে এসেছেন পথের ভিড়ে। প্রথা অনুযায়ী দশমী তিথিতে নানা আচার অনুষ্ঠান, পুজো-অৰ্চনা করার পর তুলসীগাছসমেত পুজোর অন্যান্য সামগ্রীও জলে ফেলে দেওয়া হয়। নন্দ মুর্মুর কাছ থেকেই জানলাম দু-ধরনের দাসাই নাচের কথা। একটি আনন্দের, অন্যটি দুঃখের। ষষ্ঠীর আগে পর্যন্ত মুখের দাসাই আর ষষ্ঠীর পরে দশমী পর্যন্ত দুঃখের দাসাই। তাই এঁরা কেউ নতুন পোশাক পরেন না।
আর্য-অনার্যের লড়াই, মা দুর্গার সৃষ্টি এসবই পুরাণ কথা। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যারা নিজেদের স্থানিক অবস্থান নিয়ে গর্ব করি, আধুনিকতার বড়াই করি, পাশাপাশি আমাদের সৃষ্টি, জাতির জাগরণ কোন পথে এলো, কোন্টা ঠিক কোন্টা ভুল, সবই যেন গুলিয়ে যায় এই সব মানুষের বিশ্বাসের কাছে। এঁরাই তো আদি বাসিন্দা, এঁরাই তো মাটি-পাথর-প্রকৃতির সবচেয়ে নিকটের। অরণ্যের অধিকার এঁদের। তাই কী দাসাই নাচের জন্য এঁরা এই দিনগুলিকেই বেছে নিলেন? তাহলে কী এক গোষ্ঠীর আনন্দের আর এক নাম অন্য গোষ্ঠীর দুঃখ এই নাচের কেন্দ্রবিন্দুর কারণ আমাকে নাড়িয়েছে। সেই মানুষগুলোর কথা—তাঁদের অতি সরল ভিড়ে হারানো মুখ আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠেছে। তাঁদের বিশ্বাস, প্রত্যয় আমার অবস্থানগত স্থানটি নিয়ে বহু প্রশ্নচিহ্ন আবর্তিত হয়েছে, নিজের কৃষ্টির দিকে আঙুল তুলেছে। তাহলে কি চাপিয়ে দেওয়া দেবত্বের শিকার আমরা। আমাদের উৎসব। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এই লোকজ আবেদনের কাছে বড়োই আপেক্ষিক মনে হয় যেন।
💐
নিয়মিত এই লেখা পড়লে বাংলার লোকনাটক নিয়ে সমৃদ্ধ হওয়া যেত।