বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি আর বাণিজ্য শহর সাঁইথিয়ার মাঝামাঝি ধল্লা একটি ছোট্ট গ্রাম। অধিবাসীরা অধিকাংশই তপশিলি জাতি উপজাতির। এই গ্রামেরই ছেলে দেবব্রত ভাণ্ডারী সিউড়ির আত্মজ নাট্য দলের নির্ভরযোগ্য অভিনেতা হয়ে উঠেছে অনেকদিন। ক্ষৌরকার বংশের ছেলে দেবব্রতর জাত ব্যবসা ক্ষৌরকার বৃত্তি। বাবা এই বৃত্তির সাথে এখনও যুক্ত। দেবব্রতও জীবন যুদ্ধের জন্য এই পেশাকেই বেছে সে । সিউড়ি শহরে এক টুকরো জায়গায় কোর্টের সামনে তার সেলুন। পেশার পাশাপাশি অভিনয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল তার বরাবরই। নিজেকে যুক্ত করেছিল তাই ‘এখনই’ নাট্য সংস্থার সঙ্গে। সিউড়ির থিয়েটার জগতের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে। সেই সূত্রেই পরিচিত নাট্যবন্ধুর মাধ্যমে থিয়েটারে যুক্ত হওয়া। পরে সিউড়ির অভিনেতা মুকুল সিদ্দিকি আত্মজ নামে নতুন দল গঠন করলে দেবব্রত সেই দলে যোগ দেয়। আত্মজর কর্ণধার অভিনেতা মুকুল সিদ্দিকি অভিনয়ে অনুপ্রাণিত করে দেবব্রতকে। থিয়েটারের নেশায় মুকুলের সঙ্গে দেবব্রতর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পেশা বজায় রেখে থিয়েটারের নেশা বাঁচিয়ে রাখার জন্য মুকুল তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
শুরু হয় আত্মজ দলের নাসিরুদ্দিন মোল্লা নাটক দিয়ে। অভিনয়ে দর্শকদের নজর কাড়ে দেবব্রত ভাণ্ডারী। সারাদিন সেলুন চালিয়ে রাতে রিহার্সাল দিয়ে সিউড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ধল্লা গ্রামে ফেরা। বর্তমানে সিউড়ি থেকে সরিয়ে এনে এখন সেলুন চালায় নিজের গ্রামেই। কখনো বাস ধরে, কখনো টোটোয় করে গ্রাম থেকে সিউড়ি যেত রিহার্সাল দিতে। পরে মুকুল সিদ্দিকি তার একটা পুরনো স্কুটার মেরামত করে দেবব্রতকে দেয়, যাতে রিহার্সাল দিতে আসার সুবিধা হয়। চল্লিশ আর পঞ্চাশের মাঝামাঝি বয়সে দাঁড়িয়ে থাকা দেবব্রত সংসার জীবনে প্রবেশ করেনি। মায়ের মৃত্যুর পর নিজেই রেঁধে খায়। কোনো-কোনো দিন রিহার্সাল দিতে রাত হলে বা বাইরে থিয়েটার করে ফিরে গ্রামে ফিরতে না পারলে মুকুলের ঘরেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। পরদিন আবার গ্রামে ফিরে সেলুন চালানো এসব এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
দেবব্রতর কথায় – থিয়েটার করি বলেই তো কত মানুষ চিনেছে আমাকে। অভিনয়ের পর মঞ্চ থেকে নেমে মানুষের প্রশংসা পেলে জীবন ধন্য মনে হয়। থিয়েটারের জন্যই কোন একাকীত্ব স্পর্শ করতে পারেনি তাকে। আত্মজ দলের ন হন্যতে , ইভারেস্ট, সবার ওপরে, তিতলি, নাসিরুদ্দিন মোল্লা, অরূপকথা প্রভৃতি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে দেবব্রত অভিনেতা হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছে। অথচ সুযোগ হয়নি থিয়েটার প্রশিক্ষণ বা কর্মশালায় থিয়েটার চর্চার। অভিনয় করতে করতেই সে অভিনেতা হয়ে উঠেছে। থিয়েটার করছে নেশায়। তাই পেশাটাও ধরে রেখেছে সে।
আত্মজর নির্দেশক মুকুল সিদ্দিকি বললেন – দেবু খুব সিরিয়াস অভিনেতা, বাইরে দলের কল শো থাকলে পেশাকে পিছনে ফেলে থিয়েটারের নেশায় মঞ্চে নামে। এক সময় ওষুধ সরবরাহ, বাস কণ্ডাক্টারিও করেছে সে।বিয়েতে, শ্রাদ্ধে, উপনয়নে ক্ষৌরকার হিসাবে ডাক পড়ে। কিন্তু এসবের জন্য কখনো থিয়েটারের শো থাকলে পেশা সামলে নেশার টানে ছোটে সে। শুধু অভিনয় নয়, মঞ্চ সাজানো, দলের আয় ব্যয়ের হিসাব সামলানো সব কিছুতেই নির্দেশক মুকুলের সহযোগী দেবব্রত। কোন আত্মপ্রচার নেই, নিজেকে নিয়ে অহঙ্কারও করে না। তার কথায় থিয়েটারে যুক্ত হয়েছি বলে বেঁচে গেছি, পেশা আর নেশা নিয়ে আনন্দেই আছি ।